সরকারের ত্রিরত্ন বিড়ম্বনা
লিখতে বসে একটু সমস্যায় পড়লাম। অনেক বিষয়, কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখি? একেবারে টাটকা বিষয় ঘূর্ণিঝড় রিমাল। দীর্ঘ সময় ধরে এই ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে উপকূলীয় অঞ্চলসহ দেশের একটি বড় এলাকায় মানুষের জীবনে বড় সংকট তৈরি হয়েছে। অসংখ্য ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। মাছের ঘের, খেতের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাছপালা উপড়ে গেছে। বিদ্যুৎব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে। এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের দেশে নতুন নয়। প্রকৃতি যে বৈরী হয়ে উঠছে, এর দায় মূলত মানুষেরই। তবে যেহেতু প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের রেকর্ড ভালো, বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের আছে, সেহেতু আমি এ বিষয়ে লিখতে উৎসাহ পাচ্ছি না।
ভাবলাম ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মিত্র ১৪-দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক নিয়ে কিছু লিখি। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২৩ মে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে ১৪ দলের নেতারা কিছু ক্ষোভ-হতাশার কথা প্রধানমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরেছেন। এই জোট অপ্রয়োজনীয় মনে করলে বিলুপ্ত করার কথাও নাকি বলা হয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোটের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। জোটের শরিক দলগুলোকে শক্তি বৃদ্ধির তাগিদও দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ১৪ দলের বৈঠকে এমন কিছু কথাও বলেছেন, যেগুলো নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। যেমন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমার ক্ষমতায় আসতে অসুবিধা হবে না, যদি আমি বাংলাদেশে কারও এয়ার বেজ করতে দিই, ঘাঁটি করতে দিই। কোনো এক সাদা চামড়ারই প্রস্তাব। আমি একই জবাব দিয়েছি। আমি স্পষ্ট বলেছি, আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে, আমরা যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছি, দেশের অংশ ভাড়া দিয়ে বা কারও হাতে তুলে দিয়ে আমি ক্ষমতায় যেতে চাই না, ক্ষমতার দরকার নেই।
যদি জনগণ চায় ক্ষমতায় আসব, না হলে আসব না। এই কথাগুলো বললাম, কারণ সকলের জানা উচিত।’
তার মানে বাংলাদেশে সামরিক ঘাঁটি বানানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ আছে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেই চাপ উপেক্ষা করছেন। ক্ষমতায় থাকা না-থাকা তাঁর কাছে বড় বিষয় নয়। জনগণ না চাইলে তিনি ক্ষমতায় আসবেন না। এখানে এসেই একটু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, জনগণ চায় বলেই তিনি ক্ষমতায় আছেন। কিন্তু বিএনপিসহ বেশির ভাগ বিরোধী দল বলছে, সরকার ক্ষমতায় আছে জোর করে। লোকদেখানো একতরফা যে নির্বাচন দেশে হচ্ছে, তাতে জনমতের সত্যিকার প্রতিফলন ঘটছে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন হলে সরকারের পতন অনিবার্য। আবার আওয়ামী লীগ মনে করছে, বিএনপির প্রতি মানুষের আস্থা নেই বলেই দলটি নির্বাচন বর্জন করে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মজবুত করার পথে কাঁটা হয়ে কাজ করছে। এখন এই দুই দলের মধ্যে কোনো ধরনের সমঝোতা হওয়ার আশা নেই বললেই চলে। সে ক্ষেত্রে জনগণের চাওয়ার বিষয়টি ভোট ছাড়া আর কীভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠবে, সেটাও পরিষ্কার নয়। নির্বাচনের বিকল্প হলো আন্দোলন। বিএনপির ডাকে জনগণ তো জীবনবাজি রেখে আন্দোলনেও নামছে না। তাই দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি কথার লড়াই দেখা ছাড়া আপাতত আর করার কী আছে?
দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই বলে প্রচারণার জবাবে ১৪ দলের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘৪৪ টেলিভিশনের মধ্যে প্রায় ৩৪টি চালু আছে। সবাই কথা বলে, টক শোতেও কথা বলে, সারা দিন সমালোচনা করে, এত সংবাদপত্র, এত কথা বলার পরে বলে কথা বলতে দেওয়া হয় না। টেলিভিশনে সবাই যখন এইভাবে কথা বলে আমরা তো গলা টিপে ধরি না। কেউ বাধা দেয় না। যার যা খুশি বলে যাচ্ছে। তা সত্য-মিথ্যা যা হোক। ডিজিটাল বাংলাদেশে যে যার মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংযুক্ত হয়ে সমালোচনা, মিথ্যা, অপবাদ ছড়ানো হচ্ছে।’
এই যে ‘সমালোচনা, মিথ্যা, অপবাদ’ ছড়ানোর কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই প্রসঙ্গে দু-একটি কথা বলা জরুরি মনে করছি। দেশে এখন তথ্যের ছড়াছড়ি। অনেক সময় সত্য-মিথ্যা যাচাই করাও কঠিন হয়ে পড়ে। তবে আবার এটাও ঠিক যে সব তথ্য মানুষের কাছে সঠিক উপায়ে পৌঁছাক, সেটাও সরকার চায় না। এটা এখন অনেকেই বিশ্বাস করে, সরকার সমালোচনা শুনতে চায় না, প্রশংসা বা স্তুতিবাক্য শুনতে চায়। সরকারের মধ্যে যে খারাপ মানুষ বেশি, সেটা বললে সরকারের কেউ খুশি হবে না। অথচ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ তিনজন মানুষ সম্প্রতি যেভাবে ‘খবর’ হয়েছেন, তাতে কি সরকার এতটুকু বিব্রতবোধ করছে না?
ধামাচাপা দেওয়া এবং শাক দিয়ে মাছ ঢাকা বলে বাংলা ভাষায় দুটি বাক্য আছে। অনেক সময় অনেক কিছু ধামাচাপা দেওয়া সরকারের কোনো কোনো মহলের একটি প্রিয় কাজ বলে মনে হয়। আবার শাক দিয়ে মাছ ঢাকা, অর্থাৎ প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে প্রলেপ দেওয়া তথ্য বাজারে ছাড়া হয়। কিন্তু এবার ত্রিরত্নের খবর ধামাচাপাও দেওয়া যাচ্ছে না, কিংবা শাক দিয়েও ঢাকা যাচ্ছে না।