সুদহারের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশের ব্যাংকগুলোকে সুদহার নির্ধারণের এখতিয়ার দিয়েছে। সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মতো উন্নত দেশগুলোতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে বাংলাদেশের মতো অস্থিতিশীল অর্থনীতিতে এ পদক্ষেপ বাস্তবতা- বিবর্জিত। সরকার মনে করে, তাদের এ উদ্যোগে দেশের মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। আদতে তা অর্জন করা সম্ভব হবে না।
আগে ব্যাংকের সুদহারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সীমা বেঁধে দিয়েছিল। এখন ব্যাংকগুলোই নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। সুতরাং একেক ব্যাংক একেক রকম সুদহার গ্রহণ করবে। বাজারে একাধিক সুদের হার থাকবে। ইতোমধ্যে ভোক্তাঋণে সুদহার বেড়ে হয়েছে ১৩ শতাংশ; টার্ম ডিপোজিট বা মেয়াদি আমানতে তা সাড়ে ১০ শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংক তার নীতি সুদহার বা রেপো বাড়িয়েছে বিধায় বাজারে এর প্রভাব পড়ছে। এ নীতি সুদহার বাড়তে বাড়তে বর্তমানে ৮ দশমিক ৫-এ উঠেছে; অথচ গত অক্টোবরেও তা ছিল ৬ দশমিক ৫। নীতি সুদহার বৃদ্ধির অর্থ হলো, ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত সুদ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর গ্রাহকদেরও উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হবে।
মূল যুক্তিটা হলো, নীতি সুদহার বেশি থাকলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে নিরুৎসাহিত হয়। তখন গ্রাহকদের মধ্যেও অর্থের জোগান কমে। এতে সার্বিকভাবে দেশে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে। কিন্তু এ যুক্তি আমাদের দেশে খাটে না। বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে মূল্যস্ফীতির ঘটনা ঘটছে। সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার জন্য একদিকে সুদহার বাড়িয়ে দিচ্ছে; অন্যদিকে স্থানীয় মুদ্রার মান আরও ৭ টাকা কমিয়ে দিয়েছে। প্রতি মার্কিন ডলার ১১৭ টাকায় কিনতে হবে। এ সিদ্ধান্তে মূল্যস্ফীতি কমবে না, বরং বেড়ে যাবে। কারণ বিনিময় হার অর্থনীতির ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যখন ডলার ১১০ টাকা ছিল, তখন মূল্যস্ফীতি ছিল সাড়ে ৯ টাকা। এখন ১১৭ টাকায় ডলার কিনলে শিল্প থেকে শুরু করে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়বে। এ পরিস্থিতি অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতিকে আরও বেশি চাগিয়ে তুলবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের ঘটনা আমরা জানি। তবে আমাদের পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির ঘটনা মুদ্রা সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত নয়। দেশের বাজার প্রতিযোগিতামূলক নয়। কিছু লোক বাজার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার চেয়ে তাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো বিনিময় হার ঠিক রাখা। অথচ হঠাৎ ডলারের দর ৭ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হলো। এতে কিন্তু রেমিট্যান্স বাড়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বর্তমানে ডলারের অবাধ লেনদেন সম্ভব নয়। অনেক বাধানিষেধ আরোপ করা আছে। যতদিন আমরা আন্তর্জাতিক মুদ্রা বিনিময় অবাধ বা উন্মুক্ত করতে না পারব, ততদিন কার্ব মার্কেট বা আরেকটা বাজার থাকবে এবং সেখানে দাম একটু চড়া থাকবেই।
বাংলাদেশ ব্যাংক আশির দশক থেকে ‘প্রকৃত কার্যকরী বিনিময় হার’ যেভাবে নির্ধারণ করে আসছিল, সেটাই ভালো ছিল। হঠাৎ কর্তৃপক্ষ তা বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এখন বিনিময় হার কোন দিকে যাবে, বলা মুশকিল। সরকার ডলারের দাম একই সঙ্গে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেঁধে দিয়েছে। এখানে প্রশ্ন করা জরুরি, সর্বনিম্ন দর নির্দিষ্ট করে দেওয়ার মানে কী? জনগণ যত কমে সম্ভব ডলার কিনতে পারলে সেটাই আমাদের জন্য লাভজনক।
মনে রাখতে হবে, আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী আমরা রপ্তানি করছি। সুতরাং টাকার মান কমিয়ে ডলারের দাম বাড়িয়ে দিলে রপ্তানির পরিমাণ বাড়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশের রপ্তানি খাত ইন ইলাস্টিক তথা দরের ওঠানামার ওপর নির্ভর করে না। সুতরাং এসব খাতে রপ্তানি কিংবা রেমিট্যান্স বাড়বে বলে আশা করা যায় না। বরং এ পরিস্থিতিতে আমাদের আমদানি খরচ বাড়বে এবং অনেকের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। কারণ মূল্যস্ফীতি বাড়তেই থাকবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- মূল্যস্ফীতি
- সুদের হার