আমি তখন থাকি রংপুরে, উচ্চমাধ্যমিক পাস করে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বসে আছি। এই সময় আমাদের শহরে গেলেন সৈয়দ শামসুল হক। তিনি তখন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ‘মার্জিনে মন্তব্য’ নামের কলাম লিখছিলেন। তাতে তিনি লেখালেখির করণকৌশল নিয়ে আলোচনা করতেন। তিনি বলেছিলেন, নতুন লেখকদের প্রচুর পড়তে হবে।
আমি রংপুর সার্কিট হাউসে যাই, সৈয়দ শামসুল হকের সাক্ষাৎকার নেব বলে। ১৯৮৩-এর শেষ বা ১৯৮৪-এর শুরুর দিকের কথা। আমি তাঁকে বললাম, ‘আপনি আপনার কলামে তরুণ লেখকদের উপদেশ দিয়েছেন প্রচুর পড়ার, পড়ার বাইরে কি তরুণ লেখকদের জন্য আপনার আর কোনো পরামর্শ আছে!’
তিনি তাঁর অননুকরণীয় নাটকীয় ভঙ্গিতে জবাব দিয়েছিলেন, ‘পড়ার বাইরে তরুণ লেখকদের জন্য আমার তিনটে পরামর্শ আছে—পড়ো, পড়ো এবং পড়ো।’ তিনি বলেছিলেন, ‘অনেকেই বলে থাকেন, বাংলাদেশে পড়ার মতো ভালো বই পাওয়া যায় না। আমি বিনীতভাবে জিগ্যেস করব, আমাদের মধ্যে কজন মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরোটা পড়েছি, আমাদের মধ্যে কজনই-বা বঙ্কিমচন্দ্র পুরোটা পড়েছি।’
বইমেলায় ভালো বই নেই, এই আক্ষেপ আমরা শুনে থাকি। যাঁরা এই প্রশ্ন করেন, আমি তাঁদের জিগ্যেস করব, ‘আমাদের মধ্যে কতজন রবীন্দ্ররচনাবলি পুরোটা পড়েছি, কাজী নজরুল ইসলাম পুরোটা পড়েছি, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরোটা পড়েছি!’
বইয়ের জগতের সুবিধা হলো, গতকাল কোনটা বেরিয়েছে, সেটা মূল্যবান নয়; যা মূল্যবান, তা মহাকালের মহাফেজখানায় চিরদিনের জন্য সঞ্চিত হয়ে যায়; সেটা আপনি যখন পড়বেন, তখনই ‘লেটেস্ট’। তা আপনি মহাভারত পড়ুন, কালিদাসের মেঘদূত-এর অনুবাদ পড়ুন, রুমির কবিতা পড়ুন। মাঝেমধ্যে ভাবি, ইদিপাস রেক্স-এর মতো এমন আধুনিক নাটক সফোক্লিস কবে লিখলেন, গত বছর, নাকি বছর ত্রিশেক আগে। ভাবা যায়, আড়াই হাজার বছর আগে লেখা হয়েছিল ইদিপাস।
যাঁরা বলেন, বইমেলায় ভালো বই নেই, তাঁরা কি একবার অবসর/প্রতীক প্রকাশনীতে ঢুঁ মারবেন? রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা, গীতবিতান, গল্পগুচ্ছ থেকে শুরু করে কাজী নজরুল, ওয়ালীউল্লাহ, তারাশঙ্কর-বিভূতি-মানিকের অপূর্ব সব সংকলনগ্রন্থ পুরোপুরি নির্ভুল এবং সুসম্পাদিত পাওয়া যায় প্রতীক/ অবসরে। আপনি চলে যান বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্টলে। দেশ-বিদেশের ধ্রুপদি বইগুলো বাছাই করে প্রায়-নির্ভুলভাবে প্রকাশ করে আসছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। আপনি এখানে তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস-এর অনুবাদও পাবেন, আবার সঞ্জীবচন্দ্রের পালামৌও পাবেন। ও হেনরি, ডি এইচ লরেন্স, চেখভ আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অনূদিত বই থেকেই পড়েছিলাম। যে বিসিএস পরীক্ষার্থীরা বাংলা সাহিত্যের ‘ভোরের পাখি’কে মুখস্থ করছেন, তাঁরা সেই বিহারীলালের কবিতার বই পাবেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে।