খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার মিথ ও বাস্তবতা
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রচারণার মধ্যেই আমরা জানতে পারছি, বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম খাদ্য আমদানিকারক দেশ। বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রতি বছর খাদ্য আমদানি করতে হচ্ছে এবং এ প্রবণতা বাড়ছে। সে জন্য অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, বাংলাদেশ কখনোই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না। এ অবস্থান প্রমাণ করছে অভ্যন্তরীণ খাদ্যের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ আমদানির ওপর কতটা নির্ভরশীল। গম, ভোজ্যতেল ও গুঁড়া দুধ পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। ভোজ্যতেলের ৯০ শতাংশই আমদানি করতে হয় এবং সে জন্য বাংলাদেশকে ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। গম বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য হলেও প্রায় ৭০ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে দেশে উৎপাদন হয় মাত্র ১০-১২ লাখ টন। চাহিদার বেশির ভাগ অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদন হলেও পেঁয়াজ যতটুকু আমদানি করতে হয়, তার প্রভাব বাজারে কতটা রয়েছে, এটি ভারতের রপ্তানি বন্ধের খবরেই টের পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক বাজার পরিস্থিতির কারণে আলুও আমদানি পণ্য হয়ে গেছে। চিনি তো আমদানি করতে হয়ই, এমনকি আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য যে চাল, সেটি আমদানিতেও বাংলাদেশের অবস্থান প্রথমদিকেই। ২০২১ সালে চাল আমদানিতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। এটি হলো আমাদের ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা’র চিত্র।
আমাদের কৃষিপণ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের কথাও বলা দরকার। এফএওর হিসাবে ২০২১ সালে বাংলাদেশ ৯ কোটি ৩৩ লাখ টন খাদ্যপণ্য উৎপাদন করেছে। আমদানি করেছে প্রায় সোয়া কোটি টন খাদ্যপণ্য। তারাই বলছে, চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, চা, বিভিন্ন ধরনের ফলসহ বাংলাদেশ ২২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় রয়েছে। করোনা মহামারির মতো বৈশ্বিক মহামারিতে যেখানে খাদ্যপণ্যের সংকটের শঙ্কা ছিল বিশ্বব্যাপী, সেখানে আমাদের কৃষকের দৃঢ়তায় খাদ্যশস্য কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উৎপাদিত হয়। অথচ খাদ্যপণ্য উৎপাদনে কৃষকের মুখ্য ভূমিকা থাকলেও তারা বরাবরই উপেক্ষিত।
খাদ্যপণ্য আমদানিতে তৃতীয় অবস্থানটি হঠাৎ আসেনি। দিনে দিনে আমাদের খাদ্যপণ্য আমদানি বেড়েছে। অবশ্য এ বছরের চিত্র ভিন্ন। ডলার সংকটের কারণে অনেক পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এর মধ্যে চাল অন্যতম। অনেক সময় বাজারে হস্তক্ষেপের জন্যও সরকার পণ্য আমদানি করে থাকে কিংবা বেসরকারিভাবে আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। যেমন হঠাৎ সম্প্রতি ডিম আমদানি করা হয়েছে। আগে অবশ্য এর সুফল দেখা গেলেও কয়েক বছর ধরে আমদানি করেও বাজারের ঊর্ধমুখী প্রবণতা ঠেকানো যাচ্ছে না। যেমনটা চালের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কয়েক দফায় আমদানি করেও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। বাজার নিয়ন্ত্রণে এখন অভ্যন্তরীণ উৎপাদনই ভরসা। সম্প্রতি পেঁয়াজের ক্ষেত্রে যেমনটা ঘটেছে; ভারতের রপ্তানি বন্ধের ঘোষণায় দাম দ্বিগুণ হয়ে গেলেও অভ্যন্তরীণ পেঁয়াজ বাজারে আসায় দাম দ্রুত কমে যায়।
সে জন্য খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া জরুরি। কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ না হয়েই যদি এর প্রচার করা হয়, তবে সংকটটা আড়ালে থেকে যেতে পারে এবং অগ্রাধিকারও ঘুরে যেতে পারে অন্যদিকে। এমন প্রচার হলেও হয়তো অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ত যে, আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পথে এবং এ লক্ষ্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে অভ্যন্তরীণ কৃষি উৎপাদন বেড়েছে, এটা যেমন সত্য; তেমনি অন্তত ১০ বছর আগেও যদি আমরা পরিকল্পিতভাবে সব ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার চেষ্টা করতাম, তবে পরিস্থিতির আরও উন্নতি ঘটত। যেমন গরু উৎপাদনে আমরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। গত বছরের মাঝামাঝিতে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, আগামী তিন বছরের মধ্যে ১০ লাখ টন ভোজ্যতেল দেশেই উৎপাদিত হবে, যা মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ সরকার তিন বছর মেয়াদি যে কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, তাও ২০২২ সালে। এ পরিকল্পনা কেন আগে নেওয়া হলো না? পেঁয়াজ উৎপাদনে পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা এলো ২০১৯ সালে, যখন ভারতের রপ্তানি বন্ধের পর বাজারে তুলকালাম কাণ্ড হয়। প্রশ্ন হলো, সংকট সৃষ্টি হওয়ার আগে কেন আমরা পদক্ষেপ নিতে পারছি না? কৃষি নিয়ে সরকারি-বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের যেমন কমতি নেই, তেমনি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার আয়োজনও বিস্তর। কিন্তু বাস্তবে সেগুলো কেন আমরা কাজে লাগাতে পারছি না?
- ট্যাগ:
- মতামত
- খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা