রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন: সুশাসন থেকে ইউটার্ন
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দেশে দুর্নীতিবিরোধী অনেকগুলো আইনি পদক্ষেপ গৃহীত হয়, যা সুশীল সমাজসহ সব মহলে প্রশংসিত হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল যেমন তথ্য অধিকার আইন ২০০৯, হুইসল ব্লোয়ারস প্রটেকশন অ্যাক্ট (দুর্নীতির তথ্য ফাঁসকারী বা প্রদানকারীর সুরক্ষা আইন) ২০১১ ইত্যাদি। এ সময় সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজকেও অনেক বেশি স্বাধীন ও স্বকীয় ভূমিকা বজায় রাখতে দেখা যায়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ২০১২ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে খোলাখুলি দাবি করে যে অধিকাংশ (৯৭ শতাংশ) পার্লামেন্ট সদস্য অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। এরপর ২০১৩ সালে সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এক ভাষণে দলীয় সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয় এ মর্মে সতর্ক করে দিয়ে নিজ নিজ এলাকায় ইতিবাচক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করতে বলেন।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, ২০০৯-১৩ শাসন পর্বে রাজনৈতিক জবাবদিহিতার একটি অধিকতর ইতিবাচক পরিবেশ বিরাজ করছিল। কিন্তু ২০১৩-১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে একটি অনির্বাচিত দল নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিএনপি-জামায়াতের মরিয়া আন্দোলন এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের অনমনীয় অবস্থান গ্রহণের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধীরে ধীরে নতুন রূপান্তর সূচিত হতে থাকে। ১৯৯০ সালে এরশাদ স্বৈরাচার পতনের পর অষ্টম সংসদ পর্যন্ত একাদিক্রমে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের একটির পরিবর্তে অন্যটির ক্ষমতাসীন হওয়ায় অনেকের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধাঁচে বাংলাদেশ একটি দ্বিদলীয় গণতন্ত্রের মডেলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে যে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল। ২০১৩-১৪ সালের পর সেই আশাবাদ ক্রমাগত ক্ষীণ হতে শুরু করে। ২০১৪-১৮ বছরগুলোয় দশম সংসদের সময়কালে এ দেশের অন্যতম বৃহত্তম দল বিএনপি সংসদের বাইরেই রয়ে যায়। তবে সংসদের বাইরেও দলটি কোনো জনপ্রিয় সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। ২০১৩-১৪ সালের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন এবং হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি, যা তৎকালীন সরকার কঠোরভাবে দমন করতে পেরেছিলেন, সেটি সম্ভবত এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরোধী দলের ব্যর্থ আন্দোলনের একটি বড় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এর আগে ১৯৪৭ থেকে যদি আমরা অতীত ইতিহাস বিবেচনা করে দেখি, কোনো সময়ই বিরোধী দলের আন্দোলন এমনভাবে ব্যর্থ হতে দেখা যায়নি।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের সফল ইতিহাস তো এখন আমাদের জাতীয় জীবনে কিংবদন্তিতুল্য, এমনকি সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে নবগঠিত বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) পর্যন্ত শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তাদের প্রচণ্ড চাপে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার, যা গত প্রায় ১৪ বছরের অধিক সময় ক্ষমতাসীন রয়েছে, সে সময়ে অনিয়ম, দুর্নীতি ও বিশেষত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন লোকস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় বিরোধী দলগুলোর হাতের নাগালে থাকা সত্ত্বেও সরকারবিরোধী দলগুলো, বিশেষত বিএনপি, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠন এবং আন্দোলনকে ইতিবাচক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে—এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। প্রশ্ন হলো, কেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? যেখানে আমাদের ধারণা ছিল যে এ দুই রাজনৈতিক দলই (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) প্রায় সমান সমান শক্তিশালী, একে অন্যের বিকল্প হওয়ার যোগ্য, আর জনগণের পছন্দের দিক থেকে ভোটের মাধ্যমে এ দুটির একটিকে বেছে নেয়ার এবং অন্যটিকে লালকার্ড দেখানোর সুযোগ আছে (বিশেষত যারা দোদুল্যমান ভোটার এবং সচরাচর যারা ভোটের ফলাফল নির্ধারণে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে থাকেন তাদের জন্য)। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক শক্তির এ সমীকরণ আজ স্পষ্টতই পাল্টে গেছে। বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি কার্যকর ভূমিকা পালনে ক্রমাগত ব্যর্থ এবং এটিকে কোনো সাময়িক অবস্থা বলে মূল্যায়ন করার সুযোগ এখন আর নেই।
অনেকে বলেছেন, আওয়ামী লীগ টানা ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর ক্ষমতাসীন হওয়ার সুযোগ পায়, বিএনপির ক্ষেত্রে এটা এখন ১৭ বছরে পা দিয়েছে মাত্র। সুতরাং ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় ফিরে আসতেই পারে, অতীতে আওয়ামী লীগ যেভাবে এসেছিল। কিন্তু এর বিপরীতে আরেকটি মত হলো, ভবিষ্যতে বিএনপিবিরোধী শক্তি হিসেবে আরো অধিক অকার্যকর হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একটি রাজনৈতিক দলের দৃঢ় সাংগঠনিক শক্তি এবং ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে ও বিরোধী হিসেবে আন্দোলনের সময়গুলোয় প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক পদক্ষেপ—এ দুই ক্ষেত্রেই বিএনপি আওয়ামী লীগের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ফলে দেশের অভ্যন্তরে ও কূটনৈতিক দিক থেকে দেশের বাইরে আওয়ামী লীগ তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে এখনো অগ্রগামী বলা যায়।
অভ্যন্তরীণভাবে ২০০১-০৬ শাসন পর্বে আওয়ামী লীগের ওপর গ্রেনেড হামলার ঘটনা বিএনপির প্রতি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মধ্যে ব্যাপক অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার ইন্ধন জোগায়। আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচার ও ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে বিএনপি জোট সরকারের পরোক্ষ সহায়তা বিএনপির গ্রহণযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। এছাড়া বাংলাভাই, ৬৪ জেলায় একযোগে বোমাবাজি, বিচারক হত্যাসহ জঙ্গি উত্থানের ঘটনার সঙ্গে আমরা যদি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময় (২০০৯-১৩ পর্ব) জঙ্গিবিরোধী পদক্ষেপের কথা বিবেচনা করি তাহলে দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব এবং আঞ্চলিকভাবে ভারতের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বিএনপির তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। আবার বিরোধী দল হিসেবে ২০১৩ থেকে আজ অবধি বিশেষত সংসদ নির্বাচনগুলো কেন্দ্র করে যে আন্দোলন প্রয়াস বিএনপি নিয়েছে সেগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে শত্রু-মিত্র চিহ্নিতকরণ এবং সেই সাপেক্ষে নিজেদের সামগ্রিক শক্তিকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা যায়। ২০১৩ সালে নির্বাচন প্রতিহত করার চেষ্টা, ২০১৮ সালে নির্বাচনে ফিরে আসার মাধ্যমে লড়াই, আবার ২০২৩ সালে এসে নির্বাচন বর্জন করে একরোখাভাবে সরকার পতনের আন্দোলন, এগুলো অর্জনযোগ্য অভীষ্ট (achievable goal) কিনা বা অর্জন করার মতো পর্যাপ্ত শক্তি সমাবেশ করা সম্ভব কিনা দলটি এ বিষয়ে বাস্তবতার যথাযথ মূল্যায়ন করতে পেরেছে তা বলা যাবে না।