অর্জন বিশাল, চ্যালেঞ্জও আছে
আগামীকাল মহান বিজয় দিবস। এই তো সেদিনের ঘটনা। দেখতে দেখতে ৫২ বছর কেটে গেল। বাংলাদেশ এখন এক নতুন দেশ। ‘মঙ্গামুক্ত’ বাংলাদেশ। অতীতে এই মঙ্গায় হাজার হাজার মানুষের প্রাণ গেছে ভাতের অভাবে, ভিক্ষার অভাবে, এমনকি ভাতের ‘ফ্যানের’ অভাবে। আর আজ? যুবকরা কি ‘মঙ্গা’ শব্দের সঙ্গে পরিচিত? না। বিশাল পরিবর্তন। কৃষির পরিবর্তন। স্বাধীনতার আগে আমরা ছিলাম খাদ্য ঘাটতির দেশ, চালের ঘাটতির দেশ। তখন এ ভূখণ্ডে ১ কোটি টন চালও উৎপন্ন হতো না। এখন মোট খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় পৌনে ৫ কোটি টন। ভাবা যায়! মানুষের ভাতের অভাব নেই। গায়ে কাপড় আছে। পায়ে জুতা আছে। সারে ভর্তুকি; সেচের পানি, বিদ্যুৎ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি, কৃষিঋণ ইত্যাদিতে পর্যাপ্ত ভর্তুকি দেওয়ার ফলে আমাদের পরিশ্রমী কৃষকরা বাংলাদেশকে শস্যের দেশে পরিণত করেছেন। ১৯৭১-এর বাংলাদেশ আর ২০২৩ সালের বাংলাদেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন বাংলাদেশ। ধান উৎপাদনে আমরা বিশ্বে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনেও তৃতীয়, গোল আলু উৎপাদনে আমরা বিশ্বে সপ্তম, ইলিশ মাছ উৎপাদনে প্রথম, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, জামজাতীয় ফল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’ ছাগল উৎপাদনে আমরা চতুর্থ।
কৃষিতে এই যে সাফল্য-অগ্রগতি-যা আমরা দেখছি-তা গ্রামবাংলার চিত্রকে সমূলে পরিবর্তন করে দিয়েছে। পাকা বাড়ি, পাকা রাস্তা, বিশুদ্ধ পানীয় জল, পরিষ্কার পয়ঃব্যবস্থা, উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা, উন্নত আর্থিক অবকাঠামো-ব্যাংকিং সেবা, মোবাইল-কম্পিউটার সেবায় ভরপুর গ্রাম। প্রায় দেড় কোটি বাঙালি থাকে বিদেশে। মাসে মাসে পাঠায় প্রায় দুই বিলিয়ন (এক বিলিয়ন সমান শত কোটি) ডলার। কত টাকা, কত ক্যাশ! হাট-বাজারে ভর্তি গ্রামগঞ্জ। আগে ছিল নদীভিত্তিক বাজার-গঞ্জ-বন্দর। আর এখন সব আন্তঃজেলা সড়ককেন্দ্রিক। নতুন গঞ্জ, বাজার গড়ে উঠেছে। দোকানিদের শহরে যেতে হয় না। সাপ্লাই নেটওয়ার্ক চমৎকার। দোকানে দোকানে পণ্য পৌঁছে যায়। পেমেন্টের জন্য ব্যাংকে গিয়ে ‘ড্রাফট, পে-অর্ডার’ করতে হয় না। ‘ক্যাশ’ নিয়ে চলতে হয় না। ‘বিকাশ’, ‘নগদ’সহ আরও কত ব্যবস্থা। নিরাপদ রেমিট্যান্স ব্যবস্থা। সহজ ব্যবস্থা। ‘ট্রেড ক্রেডিট’ অফুরন্ত। লাখ লাখ দোকান। উপজেলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন ছোট ছোট ঢাকা। ঢাকার বাজারে যা পাওয়া যায়, উপজেলার বাজারেও তা পাওয়া যায়। ঝলমলে সব দোকান। হ্যাজাক দ্বারা দোকান আলোকিত নয়, নয় হারিকেন দ্বারাও। দোকানে দোকানে বিদ্যুৎ। রাতের বাজার ছিল সীমিত। সপ্তাহে একদিন ছিল রাতের বাজার। এখন দিনরাত বাজার। আলোর কোনো অভাব নেই। চলাচলের কোনো সমস্যা নেই। বাস, থ্রি হুইলার, ব্যাটারিচালিত গাড়ি-সস্তা, সাশ্রয়ী, সুলভ। বিয়ে বাড়ির নেমন্তন্ন খেয়ে এখন ১৫-২০ কিলোমিটার দূর থেকে রাতের বেলা বাড়ি ফেরা যায় পরিবারসহ।
লাখ লাখ দোকানি, যাদের বলা যায় নতুন উদ্যোক্তা, ‘স্মল এন্টারপ্রাইজ’। রেমিট্যান্সের টাকায় গ্রামে গ্রামে, বাজারে বাজারে গড়ে উঠছে ছোট কারিগরি শপ। গ্যারেজ, মেরামত কারখানা, উৎপাদন কারখানা-সবই এখন গ্রামে। কৃষি ধীরে ধীরে হয়ে গেছে ‘মেকানাইজ্ড’। শ্রমিকের অভাব মিটেছে। ‘অ্যাবসেন্টি ল্যান্ডলর্ড’ সমস্যার সমাধান হয়েছে। শ্রমিকের জমি এখন ‘লিজে’ নিয়ে নিচ্ছে নগদ টাকায়। জমি পতিত নেই। ফসল লাগানো, নিড়ানি, কীটনাশক ছিটানো, ফসল কাটা, ঘরে তোলা, ধান শুকানো, ধান ভাঙানো ইত্যাদি কাজ এখন হাতে হয় না। সব মেশিনে। গ্রামের বিপুলসংখ্যক নারী এখন শ্রম থেকে মুক্ত। কর্ম থেকে ব্যবস্থাপনায় তারা ব্যস্ত। সুদের ব্যবসা, ধানের ব্যবসা, অর্থের ব্যবসার পরিসর বৃদ্ধি পেয়েছে। এনজিওর ছড়াছড়ি। হাত বাড়ালেই সুলভে ঋণ পাওয়া যায়। সোনার দোকান ছিল না আগে। এখন উপজেলা শহরে ডজন ডজন ‘এয়ারকন্ডিশন্ড’ সোনার দোকান। রাতদিন খোলা। পর্দানশীন মহিলারা অবাধে ঘুরে ঘুরে বাজার করেন, স্বর্ণালঙ্কার ক্রয় করেন। জমির চেয়ে সোনার কদর বেশি। যেহেতু উপজেলা এখন জবরদস্ত প্রশাসনকেন্দ্র, তাই সেখানে সরকারি অফিসই আছে ডজন ডজন। শত শত অফিসার-কর্মী, তাদের পরিবার বসবাস করে সেখানে। ভালো ভালো স্কুল হয়েছে, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলও আছে। টিউশনি করে চলছে অনেক যুবক। স্বাধীনতার আগে একটা থানায় কেন, পাঁচটা থানা মিলেও একটা কলেজ ছিল না। এখন উপজেলায় কলেজ একাধিক, মহিলা কলেজও আছে। মেয়েরা, পর্দানশীন মেয়েরা কাজ করছে। দোকান চালাচ্ছে। নানা কুটিরশিল্পে ব্যস্ত আছে। ঢাকাসহ বড় বড় শহরে সাপ্লাই দেওয়ার জন্য তৈরি করছে মালামাল। টুপি, কম্বল, নকশিকাঁথা, শীতল পাটি তৈরির কাজ চলছে গ্রাম-গ্রামান্তরে।