১৫ আগস্ট: বাঙালির আত্মজিজ্ঞাসার দিন
পনেরো আগস্ট। বিশ্বের যেখানেই বাঙালি বাস করছেন, বিশ্বাস করি, সারা দিনে একবার হলেও আজ এক অবিসংবাদী নেতার কথা মনে পড়েছে।
হয়তো এমন কিছু লেখায় চোখ বুলিয়েছেন বা শুনেছেন, যা অনেক স্মৃতি উসকে দিয়েছে। বিমোহিত চেতনায় ভেসে এসেছে সেই জাদুকরী শব্দের মিছিল।
‘জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা কিছু আছে, আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। ’ মুখের ভাষা, প্রাণের ভাষা সোজা গিয়ে বিঁধেছে লাখ জনতার মর্মস্থলে। নিমিষেই উত্তাল হয়ে উঠেছে জনসমুদ্র, শোনা গেছে দিগন্ত কাঁপানো গর্জন, যা কেবলই নিঃশর্ত সম্মতি ও আস্থার উদযাপন। উত্তেজনায় রক্তকণিকা অস্থির। শিরা-উপশিরা টানটান। নেতৃত্বকে প্রস্তুত করলেন রাজনীতির জাদুকর। স্বাধীনতার বার্তা ভাসিয়ে দিলেন বেতার তরঙ্গে। নিজেকে উৎসর্গ করলেন। মুখোমুখি হলেন পাকিস্তানি জল্লাদদের। ঋজুদেহে হেঁটে গেলেন শত্রুর কারাগারে। চারপাশে মৃত্যুর জমাট বাঁধা অন্ধকার।
অথচ তিনি নির্ভয়, অবিচল। দেশের মাটি-প্রকৃতির সঙ্গে এ মানুষটির নাড়ির বন্ধন। ধারণ করেন অসাধারণ রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি। সহসাই তিনি ভেবে নিলেন-তার প্রতীকী উপস্থিতি হবে লড়াইয়ের প্রেরণা, মৃত্যুও যদি হয়-হোক, তাও হবে মুক্তিসেনার অজেয় শক্তি, তার প্রতীক নিয়েই বাঙালি মরণপণ লড়বে, হয়ে উঠবে মৃত্যুঞ্জয়। তাই কোনো পিছুটান তার ছিল না।
১৬ ডিসেম্বর এক সাগর রক্ত পাড়ি দিয়ে মানচিত্রে ভেসে উঠেছিল লাল-সবুজ পতাকা। শুরু হয় নতুন এক গল্প। এলো ১০ জানুয়ারি। মনে পড়ে শীতের কুয়াশা সরিয়ে উঁকি দিয়েছে সোনাঝরা রোদ্দুর। আরও একটা মাতাল করা দিন। সমগ্র জাতি উদ্বেল, অজানা আকাঙ্ক্ষায় শিহরিত। বীরের বেশে ফিরছেন রূপকথার মহানায়ক। হাজার বছরের শেকল ভেঙে বেরিয়ে এসেছে নতুন দেশ, নতুন আইডেনটিটি। আবার সেই প্রতীক্ষার মুহূর্ত, পাগল করা শব্দতরঙ্গ। এবার কিন্তু সে কণ্ঠে দুর্বোধ্য আবেগ। ‘কবিগুরু, তুমি এসে দেখে যাও, তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে। ’ সত্যিই তো, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি তিনি। অবচেতনে নিজের জাতি নিয়ে তার শ্লাঘার কি অন্ত ছিল? কে জানত এখানেই নিহিত ছিল নিয়তির নির্মম রসিকতা! বাঙালির রক্তঋণ রক্ত দিয়েই পরিশোধ করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।
তবে কি সে রক্তপাত বরাদ্দ ছিল বাঙালিরই হাতে? সতর্কতার সব বিজ্ঞানকে তিনি হেলায় উড়িয়েছেন। হয়তো তার অভিমানী সত্তা এ শঙ্কাকে আমল দিতে চায়নি। নিজেকে রক্ষার কোনো চেষ্টাই তিনি করেননি। মনের ভেতরে আবেগ যন্ত্রণাকে বৃষ্টি ছাড়া কি প্রকাশ করা যায়? প্রকৃতিও তাই সেদিন অঝোরে কেঁদেছিল। এক বুক কান্না আর এক আকাশ বৃষ্টি সেদিন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। জগৎজুড়ে আজ একরাশ বিষণ্ণতা। তবু মনের কোণে ভিড় করছে অনেক প্রশ্ন। জাতি হিসাবে সেসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের খুঁজতেই হবে।