নরসিংদীর বেলাব উপজেলার পাটুলীতে লালন সংগীতের আখড়াবাড়ি পুলকিত আশ্রমের সাধুসঙ্গে হামলা এবং বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুরের ঘটনায় আমরা শঙ্কিত না হয়ে পারি না। হামলায় তিনজন বাউল শিল্পী আহত হয়েছেন। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর করা হয়েছে। চাইলেই এসব বাদ্যযন্ত্র সংস্কার করা যাবে না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার সময়ও দেখা গেছে, হামলাকারীরা খুঁজে খুঁজে হারমোনিয়াম ভাঙচুর করেছে। যেন তাদের সব আক্রোশ হারমোনিয়ামের ওপর। একতারা, দোতারা, হারমোনিয়াম আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। এগুলোর ওপর সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ও ধর্মান্ধদের ক্ষোভ থাকা অস্বাভাবিক নয়। পরিবার থেকে এমন শিক্ষা নিয়েই বেড়ে উঠেছে তারা।
আগে গ্রামেও বিভিন্ন পরিবারে গানের আসর বসত। কোনো কোনো বাড়িতে পেশাদার প্রশিক্ষক নিয়োগ দিয়ে সন্তানদের গান শেখানো হতো। প্রায় বাড়ির দরজায় মক্তব ছিল। এখানে ভোরবেলা শিশু-কিশোররা ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ করত। নামাজ শিক্ষার প্রাথমিক জ্ঞান শিশু-কিশোররা এসব মক্তব থেকেই পেত। ভোরবেলা মক্তবে কোরআন-হাদিস শিখে বিকেলে গান শিখত আমাদের শিশুরা। এখন আগের মতো মক্তব নেই। যা আছে তাতে আবার শিশুদের মধ্যে ভিন্ন চিন্তা জাগ্রত করার অপপ্রয়াস চলে। শহরের বাড়িতেই এখন আর গান শেখানোর আসর বসে না; গ্রামের কথা তো বাদ। শৈশব থেকে শিশুদের মধ্যে সাংস্কৃতিক চেতনাবোধ জাগ্রত না করে সাম্প্রদায়িক চিন্তা ঢুকিয়ে দিলে এর পরিণাম ভয়াবহ হবেই।
সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, সোমবার পুলকিত আশ্রমে সাধুসঙ্গের দিন ধার্য ছিল। সে উপলক্ষে সারাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সাধু-ফকির, বাউল শিল্পীরা আগে থেকেই আশ্রমে উপস্থিত ছিলেন। রোববার দুপুরে শেখ জাহাঙ্গীর ও শাহীনের নেতৃত্বে পাঁচ-ছয়জন সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্রসহ জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়াকে খুঁজতে আশ্রমে আসে। জাহাঙ্গীরকে না পেয়ে তারা আশ্রমে হামলা শুরু করলে তাদের বাধা দেন বাউল শিল্পীরা। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শিল্পীদের ওপর হামলা চালায় তারা। এ সময় কুষ্টিয়া থেকে আসা লালন সংগীতশিল্পী রিয়াদ ভূঁইয়া, মিন্টু ফকির ও রাকিব ফকির আহত হয়েছেন। এমনকি তাঁদের সঙ্গে থাকা তানপুরা, দোতারাসহ সব বাদ্যযন্ত্র ভেঙে দেওয়া হয়েছে। লালন সংগীতচর্চা বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই এ হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করছেন শিল্পীরা। লালন চর্চার সঙ্গে ইসলামের উদারপন্থি ধারা সুফিবাদের একটা সম্পর্ক আছে। আর ইসলামের চরমপন্থি ধারা ওয়াহাবিবাদের অনুসারীরা কখনোই সুফিবাদের ধারণাকে সমর্থন করে না। ফলে তারা বিভিন্ন সময় সুফিবাদীদের ওপর হামলা চালায়। আমাদের এখানে ইসলামের বিস্তার ঘটেছে সুফিবাদীদের হাত ধরে। চরমপন্থিদের মাধ্যমে ইসলাম এতটা গভীরে পৌছতে পারত না। যদি বলা হয়, এ ধরনের হামলার মধ্য দিয়ে ইসলামের মাহাত্ম্যকে ছোট করা হচ্ছে; তাহলেও ভুল হবে না।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বাদ্যযন্ত্র
- ভাঙচুর
- হামলা
- সাধুসঙ্গ