সুষম সার বিষয়ে কতটা সচেতন কৃষক
গত শুক্রবারের কথা; ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় আয়োজন করেছিলাম এবারকার ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ অনুষ্ঠানের একটি পর্ব। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা আড়াই থেকে তিন হাজার কৃষক। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটা প্রত্যক্ষ জরিপ আমরা করি। আমি উপস্থিত কৃষকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, কারা কারা মাটি পরীক্ষা করে কৃষিকাজ করেন? উপস্থিত কৃষকদের দুজন হাত তুলেছেন। কিন্তু কৃষিকাজের জন্য মাটি পরীক্ষা করে সার প্রয়োগের বিষয়টি এখনো তাঁরা জানেন না। কারণ, আমি যখন প্রশ্ন করলাম, সুষম সার প্রয়োগ করেন কে কে? তখন একজনও পাওয়া গেল না।
কয়েক বছর ধরেই ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর অনুষ্ঠানগুলোতে আমি কৃষকের কাছে জানতে চেয়েছি তাঁরা মাটি পরীক্ষা করেন কি না। ১ শতাংশের কম কৃষক বলেছেন, তাঁরা মাটি পরীক্ষা করেন। অথচ এই মানুষগুলোরই জানা দরকার ছিল জৈব পদার্থই হলো মাটির প্রাণ। শস্য উৎপাদন এবং উৎপাদনশীলতা রক্ষার্থে প্রয়োজন মাটিতে শতকরা ৫ ভাগ জৈব সার থাকা। এই না জানার ফলে তাঁরা বছরের পর বছর ধরে অতিরিক্ত সার আর কীটনাশক ব্যবহার করেছেন। এতে অধিকাংশ এলাকার মাটির জৈব পদার্থ নেমে এসেছে শতকরা ১ ভাগের নিচে, যা ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক বিরাট হুমকিস্বরূপ। অধিক ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে মাটির ওপর আমরা মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচার করে এসেছি। জমিতে প্রয়োগ করতে হচ্ছে রাসায়নিক সার। অধিক কর্ষণে মাটি হারাচ্ছে তার উর্বরতা, নষ্ট হচ্ছে জৈবগুণ। আবার সময়ের সঙ্গে বেড়েছে আমাদের ফসল বৈচিত্র্যও। কিন্তু কোন জমিতে কোন ফসল চাষ করলে কী পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে, সে সম্পর্কে কৃষক তেমন ধারণা রাখেন না। কৃষক মনে করেন যত বেশি রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হবে, ফলন তত বাড়বে।
মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ফসলের বেশি ফলনের প্রশ্নে সার প্রয়োগের আধুনিক অনুশীলনগুলো নিয়ে কথা বলেছিলাম বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সোহেলা আখতারের সঙ্গে। তিনি বলেন, একটি গাছ বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে ফল দেওয়া পর্যন্ত জীবনচক্রে মাটি থেকে ১৭টি উপাদান গ্রহণ করে। এর কোনো উপাদান কম হলেই স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। আবার কোনো উপাদান বেশি হলেও উদ্ভিদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা জরুরি।
কৃষক মাটি পরীক্ষা করে চাষাবাদের বিষয়টিতে সচেতন নন। আবার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমার কথা শুনে যাঁরা মাটি পরীক্ষা করাতে চান, তাঁরাও সহজে তা করাতে পারছেন না। অনেকের অভিযোগ, মাটি পরীক্ষার ফল হাতে পেতে পেতে ফসলের মৌসুম চলে যায়। এ ব্যাপারে সরকারের কার্যকরী উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি।
দুই বছর করোনা-তাণ্ডবে বিশ্ব অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত, তখন দ্রব্যমূল্যের আগুনে ঘি ঢেলেছে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ। ৬০টির বেশি দেশে সার রপ্তানি করে বিশ্বের অন্যতম বড় সার উৎপাদনকারী কোম্পানি ইয়ারা ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট ও সিইও ভেইন টরে হোলসেথার মন্তব্য করেছিলেন, মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত কারণে বিপর্যস্ত পৃথিবীতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। ফলে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলোর খাদ্যনিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।
সারা পৃথিবীতেই চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে জিনিসপত্রের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে সারের মূল্য। তার প্রভাব পড়েছে আমাদের কৃষি খাতেও। জ্বালানির দাম বেড়েছে, বেড়েছে ইউরিয়া সারের দাম, বেড়েছে লোডশেডিং। ফলে স্বাভাবিক সময় থেকে একটা বাজে সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে আমাদের। দুর্মূল্যের বাজারে হিসাবি হতে হয়। কমাতে হয় অপচয়। সারের ক্ষেত্রেও আমাদের অপচয় কমাতে হবে।
প্রতিবেশী ভারত সার ব্যবহারের দিক থেকে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। সার উৎপাদনে তৃতীয় এবং সার আমদানিতে বিশ্বে প্রথম। ‘দ্য ইন্ডিয়া ফোরাম’-এ একটি আর্টিকেল পড়েছিলাম বর্তমান সারসংকটে ভারতের কার্যক্রম নিয়ে। তারা সারসংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য পলিসি পরিবর্তন করতে উদ্যোগী হয়েছে। সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংযমী হচ্ছে।