৭ মার্চের ভাষণের পরে বঙ্গবন্ধুর ৩৫ নির্দেশনা
১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ। সেদিন সকালে ধানমন্ডির বাসভবনে ন্যাপ নেতা আবদুল ওয়ালী খানের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অন্য আওয়ামী লীগ নেতাও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের সংগ্রাম স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। জনগণের সার্বিক স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম চলবে।’ এরপর রাতে এক বিবৃতিতে তিনি সবাইকে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে ৩৫ দফা নির্দেশনা জারি করেন। পরের দিনের সব পত্রিকায় এই সংবাদ প্রকাশ করা হয়।
এদিন সকাল সাড়ে ৯টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে ওয়ালী খানের সঙ্গে প্রায় দেড়ঘণ্টার বৈঠকের পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আমাদের সংগ্রাম স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। জনগণের সার্বিক স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। বাংলায় জনগণ আজ ঐক্যবদ্ধ। এই ঐক্যবদ্ধ মুক্তিপিপাসু গণমানুষকে পৃথিবীর কোনও শক্তি দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ এই বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম কামরুজ্জামান।
এদিকে বাংলাদেশ যখন শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলছে, তখন নতুন নতুন ফর্মুলা হাজির করছিল ইয়াহিয়া সরকার। ১৪ মার্চ করাচিতে জুলফিকার আলী ভুট্টো এক সমাবেশে এক পাকিস্তান ও দুই অঞ্চলে দুই দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে একটি ‘ফর্মুলা উদ্ভাবনের’ প্রস্তাব দেন। জাতীয় লীগ নেতা আতাউর রহমান খান অস্থায়ী সরকার গঠনের জন্যে শেখ মুজিবুর রহমানকে আহ্বান জানান।
দ্বিতীয় পর্যায়ের অসহযোগ আন্দোলনের সপ্তম দিন ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ঘোষণা বা বঙ্গবন্ধু কার্যত স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এদিন বঙ্গবন্ধু জাতিকে ৩৫টি নির্দেশ দেন।
বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ সরকারি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এই ৩৫টি নির্দেশনা প্রকাশ করেন। এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত বাংলা পিডিয়ায় এ বিষয়ে উল্লেখ আছে যে শেখ মুজিবুর রহমানের এই নির্দেশনার পর পূর্ব পাকিস্তানের ওপর থেকে কার্যত পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যায়।
এদিন অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে তিনি বলেন, ‘আজ ঐক্যবদ্ধ জনগণ সামরিক আইনের কাছে নতিস্বীকার না করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যাদের প্রতি সামরিক আইনে সর্বশেষ আদেশ দেওয়া হয়েছে, তাদের প্রতি আমার অনুরোধ, তারা যেন কোনও প্রকার হুমকির মুখে মাথা নত করেন।’
নাট্য ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার রচিত ‘বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’ বইতে লিখেছেন, ‘১৪ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩৫টি নির্দেশের মাধ্যমে বলতে গেলে বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। প্রদত্ত নির্দেশে বলা হয়— বাংলাদেশের সর্বত্র কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের সেক্রেটারিয়েট ও দফতরগুলো, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, হাইকোর্ট ও অন্যান্য আদালতে হরতাল বর্ণিত নির্দেশনা অনুসারে পালিত হবে। বাংলাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। ডিসি ও মহকুমা প্রশাসকরা অফিস বন্ধ রেখে স্ব-স্ব এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকল্পে কাজ করবে। প্রয়োজন হলে উন্নয়নমূলক কাজসহ অন্যান্য কার্য করবে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে সহযোগিতা করবে। পুলিশ বিভাগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে।
- ট্যাগ:
- বাংলাদেশ
- ৭ মার্চের ভাষণ
- আওয়ামী লীগ