দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন : বিপদের মুখে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিস্ময়
তিন দিকে ভারত ও চতুর্থ দিকে বঙ্গোপসাগর দিয়ে ঘেরা দেশটির নাম বাংলাদেশ। এটি বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ। উন্নয়নের ‘মডেল’ ও আঞ্চলিক অর্থনীতি- দুই দিক থেকেই বহুল প্রশংসিত দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশ। ১৯৭১ সালে নৃশংস যুদ্ধের মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই সামাজিক ও অর্থনৈতিকসহ নানা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে।
একসময় এশিয়ার বৃহত্তম একাধিক নদীবিধৌত ‘বিলিয়ার্ড টেবিলের’ মতো দেখতে সমভূমির এই দেশ দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশটিতে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা এখন ইতিহাস। এর কারণ অসংখ্য আশ্রয়কেন্দ্র ও জোরদার সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। শুধু তাই নয়, ব্যাপক খাদ্যঘাটতিও অতীতের ঘটনা। শিশুমৃত্যু রোধে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এখানে শিশুমৃত্যু বৈশ্বিক গড় হারের চেয়ে কিছুটা কম এবং পাকিস্তানের অর্ধেক। এই দেশে নারী সাক্ষরতার হার ৭৩ শতাংশ। স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশের চাকরিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। সেটি বেড়ে এখন ৩৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। আর এসব অর্জনের পেছনে সবচেয়ে বেশি প্রশংসার দাবিদার তৈরি পোশাকশিল্প।
অভূতপূর্ব মহামারী কোভিড-১৯ আঘাত হানার আগের পাঁচ বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির গড় বার্ষিক হার চীনকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তখন অর্থনীতির আকার বেড়েছিল ৭ দশমিক ১ শতাংশ হারে। বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) ২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার, যা প্রতিবেশী ভারতের চেয়ে বেশি। ২০২৬ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায়ে (এলডিসি) উন্নীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে।
কিন্তু বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার পথে বহু কষ্টার্জিত এসব আশাবাদ এখন পরীক্ষার মুখে পড়েছে। করোনা মহামারী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় হোঁচট খেয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে নাভিশ্বাস উঠেছে মানুষের। গেল শীতে জরাজীর্ণ চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমানো মানুষে সয়লাব ছিল রাজধানী ঢাকার ফুটপাত। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিস্থিতি তথৈবচ। আগামী বছরের শুরুতে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু, ফলাফল কি হবে তা নিয়ে মারাত্মক কোনো সংশয় নেই। ক্রমশ একনায়কতান্ত্রিক হতে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে দমনের সম্ভাব্য কোনো চেষ্টা বাকি রেখেছেন বলে মনে হয় না। তারপরও রাজনীতির প্রতি তাঁর যে মনোভাব তা ‘কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ’- এই বাংলা প্রবাদের সমার্থক। আর তাই, স্বভাবতই ভোট সামনে রেখে রাজনৈতিক উত্তেজনা সহিংসতায় রূপ নেওয়ার শঙ্কা ঘনিয়ে আসছে। বিরোধী দল বিএনপি এর মধ্যেই নানা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে রয়েছে। দেশে দুর্নীতির দূষণ ঢাকার দূষিত বাতাসের মতোই তীব্র। সব মিলে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথে পদক্ষেপ দূরের বিষয়, গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র বিবেচনায় বাংলাদেশ দিশা হারিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।