কোথায় নতুন প্রজন্মের নেতা?
এ দেশের মানুষের অধিকাংশই কয়েক দশক ধরে বিপুল স্বপ্নভঙ্গের হতাশায় ভুগছে। প্রতি পাঁচ বছর পর পর তারা সরকার বদলানোর স্বপ্ন দেখে। আশা করেন আগের সরকারের আমলে যে নানা সমস্যায় জেরবার হচ্ছিলেন, সরকার পাল্টানোর পর সেগুলো থেকে রেহাই পাবেন। শিক্ষা, চিকিৎসা, আইনশৃঙ্খলার অব্যবস্থা, দলতন্ত্র, সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি-সন্ত্রাস-দাপট, সরকারি দুর্নীতি ইত্যাদি থেকে তাঁরা পরিত্রাণ পাবেন। বাস্তবে তা ঘটে না। ইদানীং সরকার বদল তো দূরের কথা, সুষ্ঠু নির্বাচনও হয় না!
এ জন্য অবশ্য শুধু রাজনীতিবিদদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদের মধ্যেও আছে প্রচণ্ড সুবিধাবাদিতা। এক দলের কুশাসন দেখে আমরা মুখ ফিরিয়ে আরেক দলের মুখাপেক্ষী হই। হতাশ, ব্যর্থ, প্রচলিত স্রোতে গা ভাসানোর বিদ্যায় অভ্যস্ত আমরা প্রতিবাদ করি না। তা সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা যত দমচাপাই হয়ে উঠুক। অন্য কেউ কখনো প্রতিবাদ করে লাঞ্ছিত-অপমানিত হলে প্রকাশ্যে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াই না; বরং নিজ নিজ ‘নিরাপত্তা’ রক্ষা করার চেষ্টায় দূরে সরে যাই। ‘চোখ বুজে কোনো কোকিলের দিকে’ কান ফিরিয়ে রাখি।
আমাদের মধ্যে আবেগ মাঝে মাঝে ভর করে বটে, তবে তা দ্রুতই মিলিয়ে যায়। আবেগ অবশ্যই মানুষের স্বাভাবিক বেঁচে থাকার জন্য একেবারে প্রাথমিক প্রয়োজন। কিন্তু তার সঙ্গে যদি সচেতন কোনো চিন্তা যুক্ত না থাকে, তবে সেই আবেগ আমাদের বেশি দূর নিয়ে যেতে পারে না। সচেতন চিন্তা ছাড়া আবেগেরও দৃঢ়তা থাকে না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সময়েও অন্যায়ের মূল কারণটি বোঝার চেষ্টার বদলে, অন্যায়ের কাঠামোটিকে চিহ্নিত করার বদলে আমরা কেবল ভাবি, ওকে সরিয়ে দিলেই বুঝি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কার্যত তা কখনো হয় না। হওয়ার কথাও নয়।
প্রায় ৪০ বছর ধরে উন্নতি ও সাফল্যের যে সমাজ-বিচ্ছিন্ন ধারণা আমাদের সংস্কৃতিতে শিকড় গেড়েছে, তার বিপরীত চিন্তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে আমরা অনেকেই ভেবেছিলাম এই সমাজ, দেশ, বিশ্বের কোনো কিছু নিয়ে মাথা না ঘামিয়েও কোনোরকমে নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করে ফেলা যাবে। বাস্তবে দেখা গেল এই ভাবনার যা ফল হওয়ার ঠিক তা-ই হয়েছে। উত্তরপ্রজন্মও নিজের নিজের সাফল্যকে দেখেছে, ঠিক যেভাবে দেখা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে, উজ্জ্বল সফল কিছু ছেলেমেয়ে বাড়ি থেকে বহুদূরে বসে প্রচুর অর্থ উপার্জন করছে। তারা ধীরে ধীরে এ দেশের, এই সমাজেরই মধ্যে হয়ে গেছে এক ভিন্ন পৃথিবীর বাসিন্দা। একটি বড় অংশ সরকারি দলের কর্মী হিসেবে চাকরি করে। দলের আদর্শ বিষয়ে তারা কিছু জানে না, জানানোর কোনো চেষ্টাও হয় না। তারা কেবল নিজের দলের নেতা-নেত্রীদের তেল মারা আর দলের পক্ষে স্লোগান দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বদলে কিছু অর্থ ক্ষমতাশালী নেতা-নেত্রীরা তাদের দেয়, বাকিটা তারা আদায় করে নেয়। তাদের এই আদায় করে নেওয়ায় কেউ বাধা দেয় না। ব্যবস্থাটা অনেকটা ‘মধ্যযুগের’ মতো যখন রাজা-জমিদারেরা লাঠিয়াল-সিপাইদের নিজেদের যুদ্ধবিগ্রহের কাজে লাগাতেন, বাকি সময় তাদের ‘চরে খাওয়ার’ অধিকার থাকত। তাতে তারা প্রজার ঘরে আগুন লাগাক কি তার গোয়ালের গরু-বাছুর নিয়ে আসুক!
- ট্যাগ:
- মতামত
- বাংলাদেশের রাজনীতি
- নতুন প্রজন্ম