ফুটবল কেন পড়ে রইল মাঠের পাশে
ফুটবল জ্বরে কাঁপছে দেশ, কাঁপছে সারা বিশ্ব। ক্রিকেটের জ্বরে অবশ্য কয়েকটি দেশ ছাড়া কেউ আক্রান্ত হয় না। আবার এমন দেশও আছে যেখানে ক্রিকেট খেলা দেখাই যায় না। মাঠে তো নয়ই, মিডিয়াতেও নয়। কিন্তু পৃথিবীতে এমন দেশ খুব কম আছে যারা ফুটবল খেলা দেখে না। আমাদের দেশে আমরা ছোটবেলা থেকেই ফুটবলে আক্রান্ত। সেই সুদূর শৈশবে বুটবিহীন খালি পায়ে খেলোয়াড়দের খেলা দেখেছি। তারপর বুট পরাটা ছিল একটা বড় ঘটনা। গ্রামে-গঞ্জে চামড়ার ফুটবল ছাড়াও জাম্বুরা দিয়েও খেলা হতো। স্বয়ং ম্যারাডোনা তার বাল্যকালে চামড়ার ফুটবল দিয়ে খেলতে পারেননি। নিজেরা কাপড় দিয়ে বল তৈরি করে তাই দিয়ে খেলা শুরু করেছিলেন। ফুটবল এক উত্তেজনাকর ক্রীড়া এবং অল্প সময়েই তার সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। ছোটবেলায় এক গ্রামের সঙ্গে আরেক গ্রামের খেলা হতো। তার জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি, খেলার দিন সাজ সাজ রব, খেলায় মারামারি, কখনো রেফারির পলায়ন এবং খেলা শেষে ছোট্ট একটা শিল্ড বা কাপ নিয়ে এলাকায় প্রবল আনন্দ অভিযান। খেলোয়াড়দের মধ্যে কেউ কেউ হায়ারের সুযোগ পেয়ে যেতেন। দূর-দূরান্তে খেলাধুলা করে দু’পয়সা উপার্জনও করতেন তারা। খেলার দক্ষতা বাড়লে মহকুমা বা জেলা শহর থেকে ডাক আসত আর ঢাকায় সুযোগ পেলে তো কথাই নেই। ফুটবল খেলা ছিল স্কুলে আমাদের কাছে এক আনন্দ অভিযাত্রা। যেটা শুরু হতো ইন্টার স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট থেকে। আমরা হেঁটে হেঁটে থানা শহরে যেতাম। কখনো বিজয়ের আনন্দ নিয়ে ফিরে আসতাম আবার কখনো পরাজিত হয়ে বিমর্ষ চেহারা নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। স্কুলে যারা ফুটবল খেলায় দক্ষ ছিলেন তারা এক ধরনের তারকা হিসেবে গ্রামে বিবেচিত হতেন।
পাকিস্তান আমলেও ঢাকার স্টেডিয়ামে যখন আগাখান গোল্ডকাপ হতো তখন অনেক বিদেশি দলও এসে এখানে খেলে যেত। ঢাকা স্টেডিয়াম তখন উত্তেজনা ও উৎসবের কেন্দ্র। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রাচীন মোহামেডান এবং নতুন আবাহনী ফুটবলে একটা বড় ধরনের জোয়ারের জন্ম দেয়। আরও কিছু দল কাছাকাছি থাকলেও ফুটবল প্রেমিকদের কাছে এই দুটি দলই ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অনেক দিনই এই অবস্থা চলেছে। এর মধ্যেই এক ধরনের মন্দা দেখা দেয় বাংলাদেশের ফুটবলে। সেই মন্দার কাল এখনো চলছে। শুধু আমাদের এখানে নয়। কলকাতা স্টেডিয়ামেই ইস্ট বেঙ্গল এবং মোহনবাগানের খেলা নিয়ে কত ঘটনার জন্ম হয়েছে; উপন্যাস, নাটক, গান, সিনেমার জন্ম হয়েছে। শুধু তাই নয় প্রেম-ভালোবাসা এমনকি বৈবাহিক সম্পর্ককেও এই দুটি দল প্রভাবিত করেছে। আর তারকারা তো ভালো উপার্জনও করতেন। আমাদের দেশের খেলোয়াড়রদেরও একবার তারকা হলে তার অর্থ, বিত্ত, সামাজিক প্রভাব সবই বেড়ে যেত।
আমাদের জাতি সব সময়ই একরৈখিক। ক্রিকেট এলো, সমস্ত মনোযোগ ক্রিকেটে। সরকার তো বটেই পৃষ্ঠপোষকরাও মুখ ফিরিয়ে নিলেন ফুটবল থেকে। আর ভোগ্যপণ্যের বিজ্ঞাপনদাতারা দেখলেন এই খেলায় তো অনেক সময় পাওয়া যায় তাই দিনভর বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য এই খেলাটি যথার্থ। তাই পৃষ্ঠপোষকতা জুটল, টাকা এলো বানের পানির মতো। আর ফুটবল নিরীহ বালকের মতো মাঠের পাশে বসে রইল। ফুটবলে এগার জন খেলে মাঠে কিন্তু তার পেছনে থাকে একদল অত্যন্ত ফুটবলপ্রেমী উৎসর্গীকৃত সংগঠক। কারও কারও রাত-দিনের চিন্তায়, জীবনযাপনে, চেতনায় শুধুই ফুটবল। সেই সংগঠকরাও একসময় হাল ছেড়ে দিলেন। তাই আজ ফুটবলের দর্শকরা পৃথিবীর দুটি বড় দলের সমর্থক। সমর্থনটা এত তীব্র যে বাড়িতে বাড়িতে তাদের পতাকা উড়িয়েই শেষ নয়, মারামারি হাতাহাতি থেকে শুরু করে প্রেম-ভালোবাসাকেও তা প্রভাবিত করছে। এবার তো ব্যাপকভাবে কার পতাকা কত বড় হবে তাই নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। ইংরেজি শিক্ষার ফলে আমাদের বর্ণমালা যেমন দুঃখিনী হয়েছে তেমনি ক্রিকেট আসার ফলে ফুটবলও কি দুঃখিনী হয়ে থাকবে? ফুটবলরসিকরা বলেন ফুটবল একটা রাজনীতির শিকার হয়েছে। ফুটবল খেলার যারা জাতীয় পর্যায়ের সংগঠক তাদের মধ্যে এক ধরনের রাজনীতি আছে। যে রাজনীতি কোনো শিল্পকে এগুতে দেয় না। মতভেদ থাকে কিন্তু পরমতসহিষ্ণুতা থাকে না, ফলে সেখানে জন্ম নেয় স্বৈরাচার।