জনশুমারি ও বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠী
১৯৪৭ সালের পর থেকেই আমাদের দেশে হিন্দু জনসংখ্যা একটু একটু করে কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনেও সেই চিত্র দেখা গেল। দেশে এখন হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারিতে হিন্দু ছিল ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারির চেয়ে এবারের জনশুমারিতে হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে দশমিক ৫৯ শতাংশ। পক্ষান্তরে মুসলিম জনসংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯১ শতাংশ। ২০১১ সালে যা ছিল ৯০.৪ ভাগ।
স্বাধীন দেশে প্রথম আদমশুমারি হয় ১৯৭৪ সালে। তখন হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর আরও চারটি আদমশুমারি হয়েছে। সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারিতে দেখা গেছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৫ শতাংশ হিন্দু। এবার আরও কমল। তার মানে কি এদেশে হিন্দুর সংখ্যা ধারাবহিকভাবে কমতেই থাকবে? এক সময় নিঃশেষ হয়ে যাবে?
এ প্রশ্নের উত্তরটা মোটেও প্রীতিকর নয়। আসলে এদেশে এখন এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যেখানে হিন্দুরা নিজেদের সম্মান, মর্যাদা নিয়ে থাকতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের নাগরিক অধিকার নেই। নিরাপত্তা নেই। সামাজিক-প্রশাসনিক সুরক্ষা নেই। মাইকে ঘোষণা দিয়ে হিন্দুদের বাড়িঘরে আক্রমণ করলেও, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিলেও তা ঠেকানোর কেউ নেই। গত তিন দশক ধরে একই ধরনের ঘটনা বার বার ঘটলেও এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না।
অথচ ক্ষমতাসীনরা মুখে কত ভালো ভালো কথা বলেন। তাই যদি হবে তাহলে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার একটি ঘটনারও বিচার হচ্ছে না কেন? আসলে বাংলাদেশ আর আগের জায়গায় নেই। আগের জায়গায় নেই আওয়ামী লীগও।
বাংলাদেশ কেবল মুসলিমদের রাষ্ট্রে পরিণত করার ক্ষেত্রে কমবেশি সব দলেরই অবদান আছে। সংক্ষেপে সেই ইতিহাসটা একটু তুলে ধরা দরকার। ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং ন্যায় ও সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সেই লক্ষ্য ধারণ করেই ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। সেই সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চারটি মূলনীতির উল্লেখ ছিল- ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে সংবিধানের চার মূলনীতিকে হত্যা করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা যায় নির্বাসনে। আসে ‘পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় বাংলাদেশের উল্টোযাত্রার সেই শুরু।
জিয়া-এরশাদের সামরিক সরকার এবং তাদের তাবেদার অসামরিক সরকারগুলো এই উল্টোযাত্রাকেই এগিয়ে নিয়েছে। জিয়াউর রহমান ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পথ উন্মুক্ত করে জামায়াতে ইসলামীসহ সাম্প্রদায়িক ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নতুন করে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিলেন। আর স্বৈরশাসক এরশাদ এসে ইসলামকে করলেন ‘রাষ্ট্রধর্ম’। রাতারাতি অন্য ধর্মাবলম্বীদের বানিয়ে দিলেন ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’।
জিয়া-এরশাদের সামরিক জমানার অবসানের পর এলো খালেদা জিয়ার গণতান্ত্রিক শাসনামল। কিন্তু বেগম জিয়ার বিএনপি তো কার্যত জিয়াউর রহমানেরই আদর্শিক উত্তরসূরী। ফলে সেখানে পরিবর্তন কাম্য ছিল না। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন হলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। কিন্তু সংবিধান সংশোধনে তার প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় সেবারও কোনো পরিবর্তন সম্ভব হলো না। আবার ক্ষমতায় বসলেন খালেদা জিয়া। দোসর হিসেবে ক্ষমতার ভাগীদার হলো জামায়াত। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সাম্প্রদায়িক দুই ব্যক্তি মন্ত্রী হলেন। উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদের উত্থান ও বিকাশ হলো রাষ্ট্রীয় ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। এরপর সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিনের সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থাকল। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরল শেখ হাসিনার সরকার। চলছে একটানা তিন মেয়াদ।
প্রথম মেয়াদেই সংবিধান পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো। এরই মাঝে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে জিয়া-সাত্তার-সায়েম এবং এরশাদের শাসন ‘অবৈধ’ ঘোষণা হলো। ফলে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিতে যে পরিবর্তন আনা হয়েছিল জিয়াউর রহমানের আমলে, তা অবৈধ বিবেচিত হলো। একই সূত্রে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অধিকারও অবৈধ। কিন্তু ১৯৮৮ সালে প্রবর্তিত রাষ্ট্রধর্ম সংক্রান্ত ৮ম সংশোধনী বহাল রয়ে গেল। বাংলাদেশের জন্মপরিচয় আর রাষ্ট্রীয় মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ওই ৮ম সংশোধনী অবৈধ ছিল না? এই প্রশ্নে ‘কবি নীরব’ হয়ে গেল!
- ট্যাগ:
- মতামত
- হিন্দু সম্প্রদায়
- জনশুমারি