এ মালা জাতির গলায়, এ হত্যা পিতৃহত্যা
বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, লিখতে বসে আজ আমার কলাম চলছে না। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। বাষ্পাকুল নয়নের সম্মুখে যেন একটি মানুষের ছবি ভেসে উঠছে বারবার, যাকে কোনো দিন দেখিনি, যার নামও শুনিনি দুই সপ্তাহ আগেও। ভদ্রলোকের নাম স্বপন কুমার বিশ্বাস।
নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তিনি। এই কদিন আগেও আমি-আপনি-আমরা কেউই তাঁর নাম শুনিনি। তাঁর একমাত্র পরিচয় তিনি একজন শিক্ষক। বাংলাদেশের লাখ লাখ শিক্ষকের মতো তিনি একজন শিক্ষক। দেশ গড়ার কারিগর। এইটুকুই তাঁর পরিচয়। কিন্তু না, গত ১৮ জুনের একটি ঘটনা তাঁকে হঠাত্ করে ‘বিখ্যাত’ করে ফেলেছে। কী সে ঘটনা? না, তাঁকে জুতার মালা...। বিশ্বাস করুন, আর আমার কলম চলছে না। কেবলই মনে হচ্ছে, এটাও শুনতে হলো, খবরের কাগজে এভাবে শিরোনাম হলেন একজন শিক্ষক?
আজ থেকে ছয় দশক আগে ১৯৬২ সালে আমিও তো কর্মজীবন শুরু করেছিলাম প্রথমে মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ এবং কয়েক মাস পর সিলেট সরকারি এমসি কলেজের একজন শিক্ষক হিসেবে। সেদিন সেই ১৯৬২-৬৩ সালে একুশ বছরের নবীন যুবাকে মুন্সীগঞ্জের দেশসেরা সাঁতারু, বডি বিল্ডার, টগবগে তরুণ মহিউদ্দিন, যাকে দল-মত-নির্বিশেষে শহরের সব ছেলে-ছোকরা সমীহ করে চলত, পিতৃজ্ঞানে যে আমাকে সম্মান করত, সেই মহিউদ্দিন বিদায়ক্ষণে তার স্যারের বাক্স-বিছানা কোনো কুলির কাঁধে দিতে দেয়নি, নিজে কাঁধে করে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিল। সেই শ্রদ্ধা, সেই ভালোবাসার বন্ধন ছিল ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে। আর আজ ছয় দশক পর ওই পেশার একজন উত্তরসূরি শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসকে গলায় ‘জু-’র মালা পরাল হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করে তাঁরই কলেজ প্রাঙ্গণে কতিপয় দুর্বৃত্ত। এরা এই সাহস পেল কোথায়? আরো মর্মাহত হলাম যখন কাগজে পড়লাম জেলার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ডিসি ও এসপি নাকি অকুস্থলেই উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা অবশ্য বলছেন, তাঁরা প্রধান ফটকের বাইরে উত্তেজিত জনতাকে সামলাচ্ছিলেন এবং সেই ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটেছে তাঁদের দৃষ্টিসীমার বাইরে। এই সাফাই বক্তব্য কতটুকু গ্রহণযোগ্য তা তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের তদন্তে হয়তো বোঝা যাবে। তবে আমি আমার চাকরিজীবনে বহুবার এরূপ ঘটনার মোকাবেলা করেছি। আমার কাছে ডিসি-এসপির বক্তব্য কেন জানি দুর্বল মনে হচ্ছে। গেটের কাছে জনতার মুখোমুখি তাঁরা হবেন কেন, তাঁরা তো রণক্ষেত্রের ‘জেনারেল’, তাঁরা থাকবেন পেছনে, কলেজের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অর্থাত্ অধ্যক্ষ ও গভনির্ং বডির কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে। গেট সামলাবেন তো এলাকার ওসি এবং তাঁর ফোর্স। আর হ্যান্ড মাইকের ঘোষণা কি তাঁদের কর্ণগোচর হয়নি? ...যাকগে। এসব বিষয়ে সত্যাসত্য আশা করি সঠিক তদন্তে প্রকাশ পাবে। তবে যেহেতু ডিসি-এসপি ঘটনাচক্রে বিষয়টিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন, অতএব তদন্তটি হওয়া উচিত তাঁদের সিনিয়র কারো দ্বারা। সেটাই নিয়ম।