নদীগর্ভে হারাবে না জমিজিরাত
যেকোনো দেশের রাজনীতিকদের অন্যতম দায়িত্ব জনচিত্তের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করা এবং তাঁদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের বড় স্বপ্ন দেখায় অভ্যস্ত করে তোলা। বড় স্বপ্ন দেখা, বিশেষ করে স্বদেশ ও স্বজাতি নিয়ে এবং তা প্রায় নিজের জীবন দিয়ে বাস্তবায়ন করেছেন একমাত্র বঙ্গবন্ধু। কিন্তু তাঁর ট্র্যাজিক মৃত্যুর পর বাঙালি খুব বড় স্বপ্ন দেখেছে, তা মনে হয়নি। তবে কেউ কেউ হয়তো ব্যক্তিগত বিষয়ে দেখেছেন, কিন্তু জাতীয়ভাবে বড় স্বপ্ন অবশ্যই পদ্মা সেতু। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আমাদের কোনো স্বপ্ন বাস্তবায়নে এত বিশাল প্রতিবন্ধকতা আগে আসেনি, সেসব প্রতিবন্ধকতা আর্থিক জোগান দেওয়া থেকে বিভিন্ন ধরনের; যা বর্তমান সরকারের জন্য সত্যিকার চ্যালেঞ্জ ছিল। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা আমাদের অভিজ্ঞতায় যেসব সরকার আগে এসেছে, তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব হতো কি না, সে বিষয়ে আমার ঘোর সংশয় রয়েছে।
এই চ্যালেঞ্জ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কেমন করে নিলেন এবং এতটা দুঃসাহসী তাঁর হওয়ার রাজনৈতিক ও নৈতিক কারণ বিষয়ে হয়তো একসময় সমাজবিজ্ঞানীরা অন্বেষণ করবেন। কিন্তু এই সেতু নির্মাণের ফলে অর্থনৈতিক বা সামাজিক বিবর্তন যা ঘটবে, সেসব নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক আলোচনা হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু একটি বিষয় সেসব লেখায় আমি একেবারেই দেখিনি। হয়তো কেউ কেউ লিখেছেন, কিন্তু আমার চোখে পড়েনি। সে বিষয়টি আমি উল্লেখ করতে চাই, এটি হলো জাজিরা, ভেদরগঞ্জ, নড়িয়া, সুরেশ্বর, বিক্রমপুরসহ পদ্মার দুই পাড়ের কয়েক লাখ মানুষের গত ৫০ বছর বা ততোধিক সময় অমানবিক দুর্দশার ইতিহাস।
গত শতাব্দীর মধ্য ৫০ থেকে বর্তমান জাজিরা, শরীয়তপুরের বিপুল অংশ এবং পদ্মার উত্তর পার, মানে লৌহজং বা বিক্রমপুরের একটি অংশের অগণিত মানুষ তাঁদের সর্বস্ব হারাতেন পদ্মার ভাঙনে। এই সেতু নির্মাণের প্রাথমিক কাজ হিসেবে সরকারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে বিপুল টাকা ব্যয় করতে হয়েছে, সেটি হলো নদীশাসন। পদ্মার মতো একটি ভয়াল এবং বৈরী নদীকে শাসন করা সত্যিই দুরূহ কাজ, সেটি সেতুর সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীরা জানতেন। সেই অনুযায়ী তাঁরা দীর্ঘ সময়ের জন্য যাতে পদ্মা নিরীহ, ভয়ালতাবিবর্জিত থাকে, তার জন্য দুই পাড়ে সুদীর্ঘ এলাকাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে বিপন্মুক্ত হিসেবে নিশ্চিত করেছেন। এর ফলে বেশ কয়েকটি জেলার মানুষ প্রতিবছর শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে ঘরবাড়ি এবং ফসলের জমি হারানোর ভয় থেকে মুক্ত হয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবেন।
পদ্মার ভাঙনের ইতিহাস ভুক্তভোগী মানুষ ছাড়া কারও পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। কীভাবে মাঝারি থেকে বড় জমির মালিকেরা এক রাতের মধ্যে বাড়িঘর, জমাজমি হারিয়ে পথের নিঃস্ব ভিখারিতে পরিণত হতে পারেন, তা ওই এলাকার মানুষ খুব ভালো জানেন। আমি আমার ছেলেবেলার, বলা যায় শিশুবেলার কিছু স্মৃতি এ লেখায় উল্লেখ করব।
পদ্মা সেতু অত্র এলাকার, বিশেষ করে দক্ষিণ বাংলার ১৭টি জেলার মানুষের জীবনে কী ভূমিকা রাখবে বা অন্য কী ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা জেগে উঠবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে, সে বিষয়ে ইতিমধ্যেই অনেক লেখা হয়েছে। কিন্তু মানুষের মনের তুষ্টির দিকটি সম্ভবত কোনো অঙ্ক দিয়েই বোঝানো সম্ভব নয়। সেটি শুধু জমা থাকবে অত্র এলাকার মানুষের হৃদয়ে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জন্য!