চৈত্র সংক্রান্তির পুরনো আমেজ কোথায়
চৈত্র মাস শেষ হতে চললো। দুয়ারে কড়া নাড়ছে বাংলা নববর্ষ। শুরু হবে বৈশাখ। নতুন বছর বরণের প্রস্তুতি সর্বত্র। একসময় চৈত্র মাসের শেষ দিন উৎসব পালন করা হতো। চৈত্রসংক্রান্তির আয়োজনে অনেক ক্ষেত্রেই ভাটা পড়েছে। কালের বিবর্তনে বাংলার ঐতিহ্যটি চাপা পড়েছে বৈশাখের উদ্দীপনায়।
চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভাবা হয়ে থাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল চড়ক পূজা। এটি মূলত বাঙালি হিন্দুদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোক উৎসব। নববর্ষের প্রথম দুই-তিন দিন চড়ক পূজার উৎসব চলে। লিঙ্গপুরাণ, বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে চৈত্র মাসে শিবের আরাধনা এবং উৎসবের উল্লেখ থাকলেও চড়ক পূজার বিষয়টি পাওয়া যায় না। তবে পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকালে এই উৎসব প্রচলিত ছিল। ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশ সরকার আইন বানিয়ে বন্ধ করলেও গ্রামবাংলার যেসব অঞ্চল মূলত কৃষিপ্রধান, সেখানেই চড়ক পূজা উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
চৈত্র সংক্রান্তির গোধূলি লগ্নে বেসমা পূজা করতো উত্তরাঞ্চলের মানুষ। পূজার সময় ঘরের দরজায় বাগাচূড়া (চ্যাপ্টা পাতা ও কাঁটাযুক্ত বনজ লতা), বিষ ঢেঁকিয়া (ফার্ন), বিষ কুণ্ডলী (বিষকাঁটালী), রসুন, পেঁয়াজ একসঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। এগুলো অশুভ শক্তিনাশের প্রতীক বলে বিশ্বাস করে এই অঞ্চলের মানুষ।
চৈত্র সংক্রান্তিতে শাকান্ন উৎসবের প্রচলন ছিল। দিবসটিতে গ্রাম-বাংলার নারীরা ঝোপ-জঙ্গল থেকে প্রথা মেনে ১৪ রকমের শাক তুলে আনতেন। সেই শাক একসঙ্গে রান্না করে এই দিনে খাওয়া হয়। এখনও পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের অনেক স্থানে এভাবে ঝোপ-জঙ্গল থেকে শাক তুলে এনে খাওয়ার রীতি রয়েছে। প্রথাটি শাকান্ন উৎসব নামে পরিচিত। কোথাও কোথাও চৈত্র সংক্রান্তির দিনে নিরামিশ খাওয়ার প্রথা রয়েছে। দিনটিতে ঘরে আমিষ আনা নিষেধ।
পুরনো বিষাদের ছায়াকে বিদায় দিয়ে চৈত্র সংক্রান্তিতে তিতা খাবারের প্রচলন ছিল একসময়। এখনও দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে এর প্রচলন আছে। এছাড়া চৈত্র সংক্রান্তিকে অবলম্বন করেই হালখাতা উৎসবের জন্ম নিয়েছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। জমিদারির খাজনার হিসাব-নিকাশ হতো চৈত্র সংক্রান্তির দিনে। সারাবছর কে কত খাজনা জমা করেছে এবং কার কত খাজনা বাকি রয়েছে, সেসব চৈত্র সংক্রান্তির মধ্যে চূড়ান্ত হতো। এরপর পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষের দিনে নতুন খাতায় সেই হিসাব তোলা হতো। এটি হালখাতা নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে এই হালখাতার চল দোকানে-দোকানে ছড়িয়ে পড়ে। দোকান মালিকরাও ক্রেতাদের হিসাব-নিকাশ নতুন খাতায় তুলে রাখতে শুরু করেন নববর্ষের দিনে।