
সংবাদপত্রে সাহিত্যচর্চা :একটি পর্যবেক্ষণ
.tdi_2_0ed.td-a-rec-img{text-align:left}.tdi_2_0ed.td-a-rec-img img{margin:0 auto 0 0} (adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});প্রচারমাধ্যম সাহিত্য-শিল্পের প্রকৃতি ও গতিপথ নির্ধারণে কতটা ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করে, বর্তমান সময় তার প্রমাণ। শিল্পসৃষ্টি নিঃসন্দেহে ব্যক্তির একান্ত অধ্যবসায় ও তপস্যার ফল। কিন্তু সেই নির্জন তপস্যার অর্জনকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায় কতটা শিল্পস্রষ্টার নিজের আর কতটা অন্যদের, তা বিতর্কসাপেক্ষ। অথচ এই নির্বস্তুক দায়বোধই সাহিত্যকে সমাজায়ত ও গণমুখী হতে ভূমিকা পালন করেছে। অতীতের সঙ্গে বর্তমানের মেলবন্ধন এবং গৃহবাসীর সৃষ্টির সঙ্গে বাইরের জগতের সংযোগের সেতু প্রতিষ্ঠায় সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্রের ভূমিকার দিকটিই সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে। বিগত দুই শতাব্দীব্যাপী সাহিত্যের বিচিত্রমুখী প্রচার ও প্রসারে, পাঠকসংখ্যার অভাবনীয় বিস্তারে সংবাদপত্রের ভূমিকাকে পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে। বিগত কয়েক দশক ধরে সাহিত্য রূপসমূহের ক্রমায়ত বৈচিত্র্যশীল হয়ে ওঠার মধ্যেই তার রচয়িতা এবং পাঠকসংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজসভা থেকে জনসভায়, কয়েক শ’ থেকে লাখ লাখ মুদ্রণসংখ্যায় একই রচনার প্রকাশ ও প্রচার সাহিত্যকে সাধারণ পাঠকের কৌতূহল ও পঠন-পাঠনের সীমানায় নিয়ে এসেছে। কয়েক শ’ বছরের নয়, হয়তোবা কয়েক সহস্রাব্দের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের এই অর্জন। সব ভাষার সাহিত্যের শেকড় যেমন তার মাটির গভীরে প্রোথিত, তেমনি এই ভূমিতল-উত্থিত সাহিত্য অনুধাবনের জন্য বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাস ও তার ধারাক্রম অনুসরণ করলেই এ বিষয়ে আমরা একটা ধারণায় পৌঁছতে পারি। পৃথিবীর অধিকাংশ সমাজের সাহিত্যের ধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, লোকায়ত ধারাটিই অনেক বেশি বেগবান ও প্রাণময়। কিন্তু কথকতা এবং মৌখিক ধ্বনি কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার ফলে পৃথিবীর অনেক লোকভাষার সাহিত্যই আজ অর্ধমৃত কিংবা মৃতপ্রায়। কিন্তু লিখিত সাহিত্যের টিকে যাওয়া উপাদানগুলো মানবসভ্যতায় যে বেগ ও চিন্তার আলোড়ন সূচিত করেছে, মানুষের ইতিহাসে তার কোনো তুলনা নেই। ওইসব লিখিত সাহিত্যের জীবাশ্ম অনুসন্ধান থেকে কোনো কোনো জাতির ইতিহাসে রেনেসাঁসের মতো মহাযুগান্তকারী ঘটনা ঘটে গেছে। একটি মাত্র ভাষাজ্ঞান থেকে সাহিত্যচর্চার এই বৈপ্লবিক রূপান্তর সম্ভব ছিল না। প্রাচীন এবং মধ্যযুগের সাহিত্যের মূল ধারাটি ছিল রাজসভানিভর্র। প্রত্যক্ষ রাজসভা কিংবা তার তত্ত্বাবধান। মধ্যযুগে ধমের্র প্রবল প্রতাপ, পৌরাণিক যুগের লোকায়ত বিশ্বাস ও সংস্কার আশ্রিত সাহিত্যকে অনেকটাই গ্রাস করে ফেলেছিল। কিন্তু রেনেসাঁসের বিশ্বজনীন চেতনার কালে, ভাষা সাম্রাজ্যবাদী রূপ পরিগ্রহণের আগেই বহুভাষিক কবি-শিল্পীরা পুরাণের ফসিল থেকে বের করে আনতে থাকেন একেকটি মহামূল্যবান সাহিত্যরত্ন। এলিজাবেথান যুগের ইংরেজি সাহিত্য এবং উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্য তার প্রমাণ। ষোড়শ, সপ্তদশ, অষ্টদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীব্যাপী দক্ষিণ ও মধ্য ইউরোপের অনেক ভাষার সাহিত্যেই এই নবচেতনার স্ফুরণ লক্ষ করা যায়। আর বিশ শতকের প্রথম কয়েক দশকেই পূর্ব ইউরোপে সাহিত্য হয়ে ওঠে জনযুদ্ধ ও সমাজ-পরিবর্তনের শব্দাস্ত্র। ২. উনিশ শতকের বাংলাভাষী ভূখণ্ড ভারতবর্ষের যেকোনো ভূ-ভাগ থেকে স্বতন্ত্র ও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল জাতীয় চেতনার দ্বন্দ্ব ও গতির আবর্তে। এই ভূখণ্ডেই ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় আবার এ ভূখণ্ডেই স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের চেতনা সর্বাগ্রে অঙ্কুরিত ও বিকশিত হতে থাকে। রাজসভা থেকে সাহিত্যের গতিবিধি জনসভা তথা জনগণকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে শুরু করে। বাংলা ভাষার প্রথম ‘গণমাধ্যম’ ‘সমাচার দর্পণ’ (১৮১৮)-এর প্রকাশ শব্দশিল্পকে পৌঁছে দেয় সাধারণ শিক্ষিত মানুষের দোরগোড়ায়। ভাষার মুদ্রিত রূপ কেবল গ্রন্থাগার কিংবা পণ্ডিতের টেবিলে নয়্ততা পৌঁছে যেতে থাকে অল্পশিক্ষিত মানুষের হাতে হাতে। ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ (১৮৩১) প্রকাশের ফলে এই জনসভার সাহিত্যচর্চার গতি হয় আরো বেগবান, বৃহত্তর জনজীবনমুখী। সাহিত্যিকের হাত কিভাবে রাজসভা থেকে জনসভা, জনসভা থেকে বৃহত্তর লোকজীবনমুখী হয়ে ওঠে, ঈশ্বর গুপ্ত তার প্রমাণ। তিনি ছিলেন একাধারে সম্পাদক, কবি, কর্মী, সংগঠক, আবিষ্কারক। প্রথমে সাপ্তাহিক রূপে প্রকাশিত হলেও ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুন দৈনিক রূপে আত্মপ্রকাশ করে ‘সংবাদ প্রভাকর’। বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাবলির সমান্তরালে লুপ্তপ্রায় সাহিত্যকর্ম আবিষ্কার, লোকসাহিত্য আবিষ্কার ও প্রকাশ এবং নতুন লেখকদের রচনা প্রকাশ এই পত্রিকার অনন্য ঐতিহাসিক ভূমিকা প্রমাণ করেছে। বিভিন্ন সভাকবি এবং পাঁচালীকারদের রচনা সংগ্রহ ও প্রকাশ তার অতুলনীয় কীর্তি। সাহিত্যচর্চাকে বেগবান, বিতর্কমূলক ও গণমুখী করার লক্ষ্যে তিনি ‘সংবাদ রত্নাবলী’, ‘সংবাদ সাধুরঞ্জন’ ও ‘পৗষণ্ডপীড়ন’ নামে আরো তিনটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। অক্ষয় কুমার দত্তের সম্পদনায় ১৮৪২ সালে প্রকাশিত সাময়িকপত্র ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় কেবল তত্ত্ববিদ্যা, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, বিজ্ঞান ও ভূগোল বিষয়ক প্রবন্ধের সঙ্গে নারী শিক্ষা ও বিধবা বিবাহের সমর্থন এবং বাল্য বিবাহবিরোধী উচ্চমানের প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো। তিনি সংস্কৃত, ফরাসি ও জার্মান ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। একটি শক্তিশালী, সৃষ্টিশীল ও সুদূরপ্রসারী সাহিত্যগোষ্ঠী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ (১৮৭২) পত্রিকার প্রকাশ বাংলা সাময়িকপত্রের জগতে অনন্য সাধারণ ঘটনা। সৃষ্টিশীলতা ও মননচর্চাকে শিক্ষিত মধ্যবিত্তজীবনে সমপ্রসারিত করার ক্ষেত্রে ‘বঙ্গদর্শন’-এর ভূমিকা ঐতিহাসিক। এ প্রসঙ্গে আরো কয়েকটি পত্রিকার কথা আমাদের বিষয়ভাবনার সূত্রেই প্রাসঙ্গিক মনে করছি। বাংলা, ইংরেজি, ফারসিসহ কয়েকটি ভাষায় সুপণ্ডিত, বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক প্যারীচাঁদ মিত্র মহিলাদের ‘হিতকরী’ ‘মাসিক পত্রিকা’ (১৮৫৪) সম্পাদনা করে বাংলা সাময়িকীর জগতে নতুন ধারা সৃষ্টি করেন। ডিরোজিও-র অন্যতম শিষ্য, বাংলার নবজাগরণের মূল ধারার সাধক প্যারীচাঁদ মিত্র নারী-শিক্ষা, নারী-অধিকার এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের বহুবিধ অসঙ্গতি দূর করার লক্ষ্যে সাহিত্যসৃষ্টি ও পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। উল্লেখ্য, উনিশ শতকে সাময়িকপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অধিকাংশই ছিলেন লেখক, কবি, অনুবাদক, কথাশিল্পী কিংবা প্রাবন্ধিক। উনিশ শতকে কেবল কলকাতাকেন্দ্রিক জীবনেই নয়, বর্তমান বাংলাদেশ থেকেও বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। তত্কালীন সমাজের দলিল হিসেবে ওইসব পত্রিকার মূল্য অপরিসীম। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের ‘উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গের সমাজ’ (২০০৬) গ্রন্থসূত্রে আমরা জানতে পারি ১৮৫৭ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ থেকে ২৪১টি সাময়িকপত্র-সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। তার মতে, ‘‘…পূর্ববঙ্গে প্রকাশিত ২৪১টি সংবাদ সাময়িকপত্রের অনেকগুলোই ছিল সাপ্তাহিক এবং নিয়মিত। যেমন ‘ঢাকা প্রকাশ’-এর আয়ু তো ছিল প্রায় এক শ’ বছর। কালীপ্রসন্ন ঘোষ সম্পাদিত সাহিত্য মাসিক ‘বান্ধব’কে অনেকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘দ্বিতীয় বঙ্গদর্শন’ বলে।’’ উনিশ শতকের বাংলার সাময়িকপত্র-সংবাদপত্রের ইতিহাস বাংলার নবজাগরণেরই শিল্পফসল। ‘সংবাদ প্রভাকর’ প্রকাশের পর থেকে সাহিত্যচর্চার সমান্তরালে সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে সংঘটিত ঘটনা প্রবাহের বিশ্লেষণ, নতুন লেখক সৃষ্টি যেমন বৃদ্ধি পেতে থাকে, তেমনি শিক্ষার প্রতিও বৃদ্ধি পেতে থাকে মানুষের আগ্রহ। উনিশ শতকের এই নব্যশিক্ষত বাঙালি তরুণরাই বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বমানে উন্নীত করেন। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব-এর সময় থেকেই বাঙালির সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও ঘটে যুগান্তকারী পরিবর্তন। ভারতের এই সর্বব্যাপ্ত গণজাগরণে ইংরেজের সুবিধাভোগী ও অনুগত কতিপয় দ্বিধান্বিত মধ্যবিত্ত ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। স্বাধীনতা নামক বোধটি ভাব থেকে বস্তুগত অভিজ্ঞানে পরিণত হয়। লেখকদের মধ্যে রাজনীতি-সচেতনতা বৃদ্ধি পায় বহুগুণে। সংবাদপত্রগুলোও এ বিষয়ে অনেক বেশি ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। সিপাহি বিপ্লব কালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সোমপ্রকাশ’ (১৫ নভেম্বর, ১৮৫৮) পত্রিকার ভূমিকা ছিল তাত্পর্যপূর্ণ। পরবর্তীকালের অনেক পত্রিকার মধ্যেই ‘সোমপ্রকাশ’-এর প্রভাব লক্ষ করা যায়। পূর্ববঙ্গের প্রথম সংবাদপত্র ‘রঙ্গপুর বার্তাবহ’ আত্মপ্রকাশ করে ১৮৪৭ সালে। ১৮৬০ সালে রংপুর থেকে আরো একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল ‘রঙ্গপুর দিকপ্রকাশ’ নামে। ঢাকার প্রথম সংবাদপত্র ‘ঢাকা প্রকাশ’ কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় ১৮৬১ সালে যাত্রা শুরু করে। অনেকটা কলকাতার ‘সোমপ্রকাশ’-এর আদলে পরিকল্পিত এ পত্রিকার প্রভাব জনজীবনে কার্যকর ভূমিকা পালনে সমর্থ হয়েছিল। কুমারখালীর বাংলা পাঠশালার শিক্ষক কাঙ্গাল হরিনাথ ১৮৬৩ সালে মাসিক ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ প্রকাশ করেন। সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে রচনা ও সংবাদ থাকলেও প্রধানত নীলকর ও জমিদারদের কৃষকদের ওপর শোষণ-নিপীড়নের তথ্যনির্ভর রচনা প্রকাশের জন্য পত্রিকাটি খ্যাতি লাভ করে। এভাবে, বাঙালির সাহিত্যচর্চা উনিশ শতক থেকেই রাজসভা থেকে জনসভায়্তজনসভা থেকে বৃহত্তর জনজীবনের ভূমিতল স্পর্শ করে। সমাজ সংস্কার আন্দোলন, নারী শিক্ষা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা, পাশ্চাত্য সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে জনজীবনে সচেতনতা সৃষ্টি প্রকাশিত সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্রের মূল লক্ষ্য ছিল। রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি লালনকারী পত্রিকা যে ছিল না তা বলা যাবে না। কিন্তু সমাজগতির চারিত্র্যই ছিল প্রগতি ও আলোকমুখী্ত মনুষ্যত্বের অপার সম্ভাবনার শত উত্সমুখ খুলে দেওয়ার প্রতি। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ এই মহাকালের একেকটি শিল্পস্তম্ভ। এঁরা প্রায় সকলেই গৃহকোণ থেকে নিজেদের সৃষ্টিকে সাময়িকপত্রের পাতায় তুলে ধরেন। এবং সম্পাদনা করেন একাধিক পত্রিকা। ৩. ঐতিহাসিক কারণেই উনিশ শতকের নবজাগরণে বাঙালি মুসলমানের অংশগ্রহণ বিলম্বিত ও বিঘ্িনত হয়। জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশের সংশ্লিষ্টতা না-থাকায় ওই নবজাগরণকে খণ্ডিত বললেও অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু বাঙালি মুসলমান বিশ শতকের প্রথম তিন দশকে অতি দ্রুত তাদের এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং রুশ বিপ্লবের রক্তিম অভিজ্ঞতার ছোঁয়া তাদের নবজাগরণের তারুণ্যদীপ্ত উদ্দীপনার সঙ্গে সাম্যবাদী রাজনীতির গণমুখী চেতনাকে যুক্ত করে দেয়। উনিশ শতকেও বাঙালি মুসলমানের সম্পাদনায় পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। তবে অধিকাংশই রক্ষণশীলতা এবং পশ্চাত্পদ দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেছে। সাহিত্যচর্চার মাধ্যম হিসেবে এককভাবে বাংলা গ্রহণের দ্বিধা তাদের সৃষ্টিশীলতা ও মননচর্চাকে গতিশীল করতেও ব্যর্থ হয়েছে। যেমন, ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে শেখ আলিমুল্লাহর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সমাচার সভারাজেন্দ্র’ বাংলা ও ফারসি ভাষায় প্রকাশিত হয়। ১৮৪৬ সালে মৌলভী ফরিদুদ্দীন খাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘জগদুদ্দীপক ভাস্কর’ নামক সাপ্তাহিক সংবাদপত্রটি ছিল পঞ্চভাষিক। উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমানদের সম্পাদনায় প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য পত্রিকাগুলো হলো মীর মশাররফ হোসেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক পত্র ‘আজীবন নেহার’ (১৮৭৪), শেখ আবদুর রহিম সম্পাদিত সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘সুধাকর’ (১৮৮৯), মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত পাক্ষিক পত্র ‘হিতকরী’ (১৮৯০) প্রভৃতি অসামপ্রদায়িক, হিন্দু মুসলমানের মিলনকামী এবং বাংলা ভাষায় সামবায়িক ও জীবনমুখী সাহিত্যচর্চার ধারা সৃষ্টি করে। এ ছাড়া শেখ আবদুর রহিম সম্পাদিত ‘মিহির’ (১৮৯২), ‘মিহির ও সুধাকর’ (১৮৯৫), ‘কোহিনুর’ (১৮৯৮) সম্পাদক : এস কে এম মহম্মদ রওশন আলী, মোজাম্মেল হক সম্পাদিত ‘লহরী’ (১৯০০), সৈয়দ এমদাদ আলী সম্পাদিত মাসিক সাহিত্যপত্র ‘নবনূর’ (১৯০৩), মুহম্মদ শহীদল্লাহ্ ও মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক সম্পাদিত ‘বঙ্গীয়-মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকা’ (১৯১৮) প্রভৃতি বাঙালি মুসলমানকে অসামপ্রদায়িক রাজনীতিসচেতন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যমনস্ক এবং মননমুখী হতে সহায়তা করে। ‘সমাচার দর্পণ’ (১৮১৮) প্রকাশের এক শ’ বছর পরে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মাসিক সাহিত্যপত্র ‘সওগাত’। উদার ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি, মুক্তবুদ্ধির চর্চায় বিশ্বাসী, মুসলমান সমাজে নারীমুক্তি আন্দোলনের সমর্থক এবং মুসলমান তরুণদের মধ্যে নতুন নতুন লেখক সৃষ্টি ও তাদের কার্যকর সহায়তা ‘সওগাত’ পত্রিকার অনন্যতার পরিচয় বহন করে। ইতিহাসের মানদণ্ডে বিচার করলে এই দীর্ঘজীবী পত্রিকা (১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের পর পত্রিকার অফিস কলকাতা থেকে ঢাকা চলে আসে এবং নবপর্যায়ে প্রকাশিত হতে থাকে) বাঙালি মুসলমানের জীবনচেতনার আধুনিকায়নে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে। প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ (১৯১৪) বিশিষ্ট হয়ে ওঠে চলিত গদ্যরীতির প্রয়োগ ও সংযতবাক, বুদ্ধিদীপ্ত শিল্পসাধনার বিপ্লবী উদ্যোগের কারণে। ‘বঙ্গদর্শন’ থেকে ‘সবুজপত্র’ (১৯১৪) বাঙালির সৃষ্টিশীল সাধনা ও মননচর্চার ক্ষেত্রে যে গতি, বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধির ধারা সৃষ্টি করেছিল, ‘সওগাত’ থেকে ‘শিখা’ (১৯২৬) পর্যন্ত সেই ধারার সঙ্গে যুক্ত হলো বিশ্বজনীন জ্ঞানসাধনা, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন গণমানুষের মুক্তির সংগ্রাম এবং মুসলিম সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ। ‘শিখা’ ছিল ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর মুখপত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিমণ্ডলে গঠিত এই সংগঠনের কার্যক্রম ঢাকার নবাববাড়ির রক্ষণশীল রক্তচক্ষু ও গোঁড়া মুসলমানদের দ্বারা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু যাঁদের মটো ছিল্ত‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট; মুক্তি সেখানে অসম্ভব’্ততাঁদের মুক্তচিন্তার লেখনি থামানো যায়নি। ১৯১৮-২৬ এই সময়সীমায় বাংলা সাময়িকপত্রের জগতে এক নবধারার সৃষ্টি হয়। প্রকাশিত হয় কয়েকটি ভিন্নধারার সাময়িকপত্র। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম থেকে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও আবদুর রশীদ সিদ্দিকীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মাসিক সাহিত্যপত্র ‘সাধনা’। মোজাম্মেল হকের সম্পাদনায় ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয় ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকা। এই মাসিক সাহিত্য পত্রিকা নানা কারণে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ পত্রিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলো এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখাও পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হয়েছে। “মোসলেম ভারত’-এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সাহিত্যের মাধ্যমে ‘উত্থান প্রয়াসী’ ও ‘পতিত’ মুসলমান সমাজের কল্যাণসাধন এবং তত্সহ হিন্দু-মুসলমান মিলন দৃঢ়তর করা। কাজী নজরুল ইসলাম ও কমরেড মোজাফ্ফর আহমদের সম্পাদনায় ১৯২০ সালে ‘নবযুগ’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ব্রিটিশ সরকার বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সমর্থক এই দৈনিক পত্রিকার আর্থিক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা করেছিলেন একে ফজলুল হক। রাজরোষে পড়ে ‘নবযুগ’ পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে অর্ধসাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। যাত্রালগ্ন থকেই ‘ধূমকেতু’ ধর্মনিরপেক্ষতা ও হিন্দু-মুসলমান সমপ্রদায়ের মিলনের সমার্থক হয়ে ওঠে। এ পত্রিকাই প্রথম রাজনীতিতে স্বরাজের পরিবর্তে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করে : ‘ভারতবষের্র এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীনে থাকবে না। ভারতবষের্র সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের ওপর।’ পত্রিকায় সরকারবিরোধী রচনার জন্য কাজী নজরুল ইসলাম কারারুদ্ধ হন। সাপ্তাহিক ‘লাঙল’ (১৯২৫) পত্রিকা ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ সমপ্রদায়ের মুখপত্র’ রূপে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদধন্য এই পত্রিকা সম্ভবত এদেশে কমিউনিস্ট ভাবধারা প্রচারণার কাজে প্রথম বাংলা সাময়িকপত্র। প্রধান পরিচালক : কাজী নজরুল ইসলাম; সম্পাদক : মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়। পরবর্তী সময়ে এ পত্রিকা কমরেড মোজফ্ফর আহমদ সম্পাদিত ‘গণবাণী’ (১৯২৬) পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়। ‘লাঙল’-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে ‘গণবাণী’ ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলের মুখপত্রে রূপ লাভ করে। সম্পাদক তাঁর বক্তব্যে বলেন : ‘আমরা চাই ভারতবর্ষ পরশাসন-কবল হতে পূর্ণ বিমুক্ত হোক। কিন্তু সে বিমুক্তির ভিত্তি ভারতের জনসাধারণের মতের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত হবে বিশিষ্ট শ্রেণীসমূহের মতের উপরে নয়। জয় গণ-ভারতের জয়।’ ‘গণবাণী’ পত্রিকায় কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর বঙ্গানুবাদ এবং কাজী নজরুল ইসলামের ‘লাল পতাকার গান’ প্রকাশিত হয়। সাহিত্য ও রাজনীতির এই যৌথায়নের ফল যে সুদূরপ্রসারী হয়েছিল, ইতিহাস তার প্রমাণ। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সাল থেকে সূচিত ভাষা আন্দোলন, ১৯৫২’র জাতিসত্তার রক্তিম উজ্জীবন এবং পরবর্তী সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ এ ভূখণ্ডের সাহিত্য সাময়িকী ও দৈনিক পত্রিকার জগতে নবধারার সূত্রপাত করে। ফলে এ ভূখণ্ডের সাহিত্য-শিল্প পাকিস্তানের নয়া-ঔপনিবেশিক, স্বৈরতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে স্বতন্ত্র হয়ে যায়। দৈনিক পত্রিকার ‘রবিবাসরীয়’ সংখ্যার মাধ্যমে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মাঝে নব্য বিকাশমান স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতিসত্তার অঙ্কুরিত আকাঙ্ক্ষা পৌঁছে দেওয়া হয়। প্রতিদিনের রাজনীতি সাহিত্যের বিশুদ্ধ শিল্পলোককে হয়তো বা কিছুটা রক্তাক্ত করেছে; কিন্তু বাংলাদেশের সাহিত্য সমাজায়ত চেতনার রূপায়ণে একটা জাতিগত স্বতন্ত্র চরিত্র অর্জন করে। ১৯৪৭-৭০ সময়কালে এ দেশে প্রকাশিত সাময়িকপত্রের সংখ্যা ৫০০ (সূত্র : শামসুল হক : বাংলা সাময়িকপত্র (১৯৪৭-৭০)। এসব সাময়িকপত্রের মধ্যে প্রগতিবাদী, আধুনিক চিন্তাধারার সাময়িকপত্রের পাশাপাশি পাকিস্তানবাদী সাহিত্যিক আবর্জনাও কম ছিল না। তবে সেসব পত্রিকা ষাটের দশকের শেষান্তে এসেই অন্তর্হিত হতে শুরু করে। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্রোত বাংলাদেশের সাহিত্যলোককেও নতুন সম্ভাবনার পথে ধাবিত করে। ৪. স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে সাময়িকী এবং দৈনিক পত্রিকা প্রকাশনার প্রাচুর্য অবিশ্বাস্য। ১৯৭২ সালেই বাংলাদেশে ২৮১টি পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকী আত্মপ্রকাশ করে [সূত্র : শামসুল হক : বাংলা সাময়িকপত্র (১৯৭২-৮২)। একটি তথ্য (দৈনিক জনপদ, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫) থেকে জানা গেছে, ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত দেশে মোট ১০৬টি মাসিক পত্রিকা, ৩৭টি দৈনিক, ১৭৪টি সাপ্তাহিক, ১৫টি মাসিক ও ৮টি ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। স্বাধীনতা-উত্তর বিগত ৪০ বছরে সাময়িক পত্রিকা ও দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে। এর পেছনে শিক্ষার প্রসার, লেখকসংখ্যার বৃদ্ধি, গণমাধ্যমে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যাপক প্রচারণা এ ক্ষেত্রে যোগ করছে নিত্য-নতুন মাত্রা। বিশ্বজ্ঞানের সংস্পর্শ আমাদের লেখকদের সাহিত্যচর্চার পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছে বিচিত্রধারায়। পাঠকের পঠন-পাঠনের আগ্রহ সংখ্যায় এবং প্রাচুর্যে অতীতের যেকোনো সময়কে অতিক্রম করে গেছে। বিশ শতকের ষাট-সত্তরের দশকের মতো ছোট কাগজের সেই শিল্পিত উজ্জ্বল লাবণ্য এখন বেশি চোখে পড়ে না। কখনো কখনো মনে হয় বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো সাহিত্য প্রচারের দায়ভার গ্রহণ করেছে। দৈনিক পত্রিকার রচনাগুলো প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে সুদৃশ্য গ্রন্থাকারে প্রকাশনা সংস্থার টেবিলে শোভা পাচ্ছে। আমরা এখন সাময়িক পত্রিকা, ছোট কাগজ, মননশীল সাহিত্য পত্রিকার জগত্ থেকে পৌঁছে গেছি দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যের পাতায়। প্রতি সপ্তাহে লাখ লাখ পাঠকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে লেখকদের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ধারাবাহিক রচনা, প্রবন্ধ, চিন্তামূলক রচনা, ভ্রমণকাহিনি প্রভৃতি। সাময়িকপত্রের সম্পাদকেরা ছিলেন সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ, সমাজসংস্কারক এবং নির্দিষ্ট আদর্শ ও লক্ষ্যের প্রতি নিষ্ঠাবান। এখনকার সম্পাদকরা মূলত ব্যবসায়ী। নির্দিষ্ট আদর্শ ও দর্শন লালন ও প্রচার তাঁদের উদ্দেশ্য নয়। সকল মত ও পথের পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠাই তাঁদের কাম্য বলে মনে হয়। যে-কারণে পত্রিকার কলাম ও চিন্তাশীল রচনার তাৎপর্যগত ভিন্নতা সাধারণ পাঠকের কাছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধরা পড়ে না। জ্ঞান ও শিল্প কতটা ভাসমান এবং দৈনিক-তার মূল্যায়ন দুরূহ। প্রতিদিনের অতীত হয়ে যাওয়া দৈনিকের সাহিত্যের পরিণতির বিচারের ভার সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়াই নিরাপদ এবং যুক্তিযুক্ত। লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়.tdi_3_f55.td-a-rec-img{text-align:left}.tdi_3_f55.td-a-rec-img img{margin:0 auto 0 0} (adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
- ট্যাগ:
- অন্যান্য সংবাদ
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়