৬ মাসেই চাঁদাবাজির রাজত্ব কায়েম করেন লিয়াকত

মানবজমিন বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদ, টেকনাফ প্রকাশিত: ১৩ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

শামলাপুর ফিশিং ঘাট। ওই ঘাটের মাছ ব্যবসায়ী নূরুল ইসলাম। দুই মাস আগে পুলিশকে ঘাটের নিয়মিত চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে নির্যাতনের শিকার হন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, শামলাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ লিয়াকত আলী নূরুল ইসলামকে ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে চল্লিশ হাজার টাকা আদায় করেন। বিষয়টি নিয়ে নূরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি ভয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। গত ২৫শে এপ্রিল মানব পাচারের অভিযোগ তুলে নোয়াখালীপাড়া গ্রামের আব্দুল হাকিমের ছেলে আব্দুস সালামকে তুলে আনেন লিয়াকত। পরে ওই পরিবারের কাছ থেকে সাড়ে ৮ লাখ টাকা আদায় করে নেন লিয়াকত। এতে সন্তুষ্ট হতে না পেরে ২৬শে এপ্রিল তিনি সালামকে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করেন বলে অভিযোগ করেছে পরিবার। এ ঘটনার পর এলাকার সবাই লিয়াকতের ভয়ে তটস্থ থাকতেন। এতে লিয়াকত এলাকায় প্রদীপের উত্তরসূরি বলে প্রচার বেড়ে যায়। যদিও এর আগে আরো কয়েকটি কথিত ক্রসফায়ার দেন তিনি। এলাকাবাসী বলছেন, লিয়াকত এখানে আসার পর বেশ কয়েকটি কথিত ক্রসফায়ার দিয়েছেন। সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা ঘটনার এক নম্বর আসামি ইন্সপেক্টর লিয়াকত এখন কারাগারে। তার পরও তার নির্যাতন ও চাঁদাবাজির শিকার ভুক্তভোগীরা ভয়ে কথা বলতে চাইছেন না। তারা বলছেন, পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হলে স্বরূপে ফিরে আসবে পুলিশ। পরে ওই সময়ের গণমাধ্যমের বক্তব্য দেখলে তাদের ওপর চড়াও হতে পারে। তাই এমন ভয়ে এখনো কেউ মুখ খুলছেন না।অভিযোগ রয়েছে, শামলাপুর পুলিশ ফাঁড়িতে যোগদানের ৬ মাসের মধ্যেই লিয়াকত আলী গড়ে তোলেন চাঁদাবাজির রাজত্ব। সরজমিনে ওই এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাদক ব্যবসায়ী ও মানব পাচারের অভিযোগ তুলে একের পর এক এলাকাবাসীকে তুলে এনে চাঁদা আদায় করতেন। আর চাঁদা না দিলে করতেন নির্যাতন, দিতেন ক্রসফায়ারের হুমকি। এদিকে এলাকার ১২টি ফিশারিজ ঘাট থেকেও নিয়মিত মাসোয়ারা আদায় করতেন প্রায় ৫০ লাখ টাকার মতো। এর মধ্যে মাছ ধরার প্রায় তিনশ’টি নৌকা থেকে প্রত্যেক দিন এক হাজার টাকা করে চাঁদা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। জেলেদের জিম্মি করে এসব চাঁদা আদায় করতেন তিনি। এসবে সহযোগিতা করতো জেলেদের মধ্যে সিরাজুল হক, মোহাম্মদ হানিফ, সাইফুল, বেলাল উদ্দিন, মো. সৈয়দুল হক। বাজারে মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির এক নেতা বলেন, যারা চাঁদা তুলে দিতো তাদের কোনো দোষ নেই। তারাও ভুক্তভোগী। তারা শুধু দিনের বেলায় সবার টাকাটা তুলে নিয়ে দিয়ে আসতো। তারা নিজেরাও চাঁদা দিতো লিয়াকতকে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এই ফাঁড়িতে যোগদান করেন লিয়াকত হোসেন। এরপর থেকেই পুরো এলাকাটি তিনি ঘুরে ঘুরে দেখেন। ওসি প্রদীপের প্রশ্রয়ে নিজেও এলাকায় গড়ে তোলেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। নিয়োগ দেয়া হয় ক্যাশিয়ার ও নিজস্ব সোর্স। স্থানীয় সংবাদকর্মীরা বলছেন, ওসি প্রদীপ তাকে এই ফাঁড়িতে নিয়ে আসেন। সরজমিন দেখা যায়, বাহারছড়া ইউনিয়নটি সাগরতীরে হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষ মাছ শিকার করে জীবন চালান। ফলে এখানে গড়ে প্রায় ১২টি ফিশারিজ ঘাট রয়েছে। ঘাটগুলোর মধ্যে শামলাপুরে দুটি, শিলখালী একটি, চৌদারপাড়া দুটি, বাইন্যাপাড়া একটি, জাহাজপুরা একটি, হাজমপাড়া একটি, নোয়াখালীপাড়াতে একটি ও কচ্ছপিয়ায় একটি। প্রতি ঘাটে গড়ে ১শ’ করে নৌকা রয়েছে। এসব নৌকা সমুদ্রে নামার আগেই দৈনিক এক হাজার টাকা দিতো লিয়াকতের ক্যাশিয়ার আব্দুল্লাহ আল মামুনকে। টাকা না দিলেই মানব পাচারের অভিযোগ তুলে ধরে আনা হতো পুলিশ ফাঁড়িতে। এছাড়া মৎস্য ব্যবসায়ীদের সংগঠন থেকেও প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা চাঁদা নিতো। এই এলাকায় এরকম প্রায় ১২টি সংগঠন রয়েছে। বাহারছড়া উপকূলে মৎস্য সমবায় সমিতি ও মাছ ব্যবসায়ী সমিতির দু’জন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ১০ হাজার টাকার বাইরেও যেসব সংগঠন নিয়ন্ত্রণে ভালো ব্যবসা হয় সেগুলো দিতো তিন-চার লাখ টাকা করে। শামলাপুর দক্ষিণ ঘাটের সভাপতি বেলাল উদ্দিন বলেন, আমরা প্রতি ঘাট থেকে পুলিশের মেসের জন্য খরচ দিতাম। আর টাকা কম দিলে বাবা মাকে নিয়ে গালি দিতো। ধরে নিয়ে নির্যাতন করতো। আবার এসব টাকা না দিলে মাছ ধরা ও ব্যবসা বন্ধ করে দিতো পুলিশ। পাশাপাশি মাদক দিয়ে চালান করে দেয়ার হুমকি দিত। ক্রসফায়ারের হুমকি তো আছেই। এই এলাকার ফিশারিজ ঘাটের নৌকার মালিক রাশেদুল জানান, তাদের খাবারের জন্য মাছ দিয়ে আসতে হতো। আসলে এত মাছ তাদের প্রয়োজন হতো না। মাছ জমা করে ক্যাশিয়ার মামুন এক দালাল ধরে বিক্রি করে ফেলত। শামলাপুর বাজারে ৩০টির মতো মাছের আড়ত রয়েছে। এসব আড়তে প্রতিদিন অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী মাছ কিনতে আসেন। এসব ছোট মাছ ব্যবসায়ী থেকে গড়ে ৫০০ টাকা চাঁদা নিতো লিয়াকতের লোকজন। গতকাল সরজমিন মাছ বাজারে গিয়ে কথা হয় কয়েকজন মাছ ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তারা বলেন, এখন একটু শান্তিতে আছি। কতদিন এই শান্তি থাকে কে জানে! তারা অভিযোগ করে বলেন, চাঁদা না দিলে মাছের ভেতর ইয়াবা রয়েছে বলে মাছ রাস্তায় ফেলে দেয়া হতো। সেই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের ফাঁড়িতে উঠিয়ে নিয়ে হাজার হাজার টাকা চাঁদা আদায় করা হতো। স্থানীয় আড়তদার হেলাল উদ্দিন জানান, ত্রিশ আড়তে প্রতিদিন শত শত মাছ ব্যবসায়ী মাছ কিনতে আসেন। প্রতি মাছ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকা আদায় করতো ক্যাশিয়ার মামুন। সে নিজে এসেই টাকা নিয়ে যেতো। চাঁদাবাজির এখানেই শেষ নয় তার। টমটম ও যানবাহন থেকে করতো নিয়মিত চাঁদাবাজি। তেমনি একজন ভুক্তভোগী সরোয়ার কামাল (৪৫)। পেশায় টমটম চালক। ধারকর্জ করে একটি টমটম কিনেছিলেন তিনি। চলতি বছরে লকডাউন ঘোষণার সময় তার কাছে মাসিক চাঁদা দাবি করেন। পাঁচশ’ টাকা চাঁদা না দিতে পারায় তাকে সারাদিন আটকে রেখে পাঁচশ টাকা দেয়ার পর তাকে ছেড়ে দেয়। টমটম চালক সরওয়ার কামাল বলেন, করোনায় লকডাউন ঘোষণাকালে ৫শ’ টাকার জন্য সামনের গ্লাসটি ভেঙে ফেলে লিয়াকত। এরপর টাকা নিয়েই তিনি গাড়িটি ছেড়েছেন। এখানে প্রায় হাজারখানেক ছোট-বড় টমটম রয়েছে। এগুলো থেকে প্রতিদিন দুইশ’ এবং মাসে পাঁচশ’ করে চাঁদা নিতো লিয়াকত। বড় টমটম থেকে মাসে এক হাজার ও দিনে তিনশ’ টাকা নেয়া হতো। তবে মিনি টমটম সমিতি ও বড় টমটম সমিতি থেকে মাসে ৫০ হাজার টাকা করে চাঁদা নিতো। বড় টমটম চালক রিয়াদ মুনির অভিযোগ করে বলেন, লিয়াকতের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ছিলাম। এখন একটু শান্তিতে আছি।এদিকে গ্রাম্য সালিশ থেকেও হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিতেন লিয়াকত ও তার সহযোগীরা এমন অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী দুই পক্ষের মধ্যস্থতার কথা বলে এসব টাকা নিতেন তিনি। সরজমিন গিয়ে এমন অভিযোগের সত্যতা মেলে। তবে টেকনাফ থানায় যোগদানকারী নতুন ওসি আবুল ফয়সাল জানান, ঘটনা অনেক ঘটেছে। সবগুলো তদন্ত করে বের করা হবে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত

আরও