চল্লিশোর্ধ্ব প্রশিক্ষকের সঙ্গে ১৩ বছরে বিয়ে, ঘুঙুরের শব্দে ঢেকেছিলেন জীবনের ক্ষত
কিষণচন্দ সাধু সিংহ এবং ননী সাধু সিংহের মেয়ে নির্মলার দেহের ওজন ছোটবেলা থেকেই বয়সের তুলনায় বেশি। ডাকনাম হয়ে গিয়েছিল ‘মোটি বচ্চি’। দেশভাগের পরে তাঁর বাবা মা এসেছিলেন ভারতে। মুম্বইয়ে ১৯৪৮ সালের ২২ নভেম্বর জন্ম হয় নির্মলার। কয়েক দশকের কঠোর পরিশ্রম পেরিয়ে নির্মলা শাসন করলেন বলিউডের নাচের মঞ্চ। হয়ে উঠলেন বহু তারকার নেপথ্য কারিগর। তবে টিনসেল টাউন তাঁকে চিনেছিল সরোজ খান নামে। খবর আনন্দবাজারের। সম্পর্কিত খবর চলে গেলেন বিখ্যাত কোরিওগ্রাফার সরোজ খান নির্মলার কেরিয়ার শুরু হয়েছিল অভিনয় দিয়ে।
তিন বছর বয়সি নির্মলাকে পর্দায় প্রথম দেখা গিয়েছিল ‘নজরানা’ ছবিতে। ছবির নায়িকা শ্যামার শৈশবের ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল তাঁকে। পঞ্চাশের দশকে আবার সিনেমার দুনিয়ায় ফিরে এলেন তিনি। এ বার নেপথ্য নৃত্যশিল্পীর ভূমিকায়। সে সময় বলিউডের নামী ডান্স কোরিয়োগ্রাফার ছিলেন বি সোহনলাল। প্রখ্যাত এই কত্থক শিল্পীর কাছে প্রশিক্ষণ নিতেন নির্মলা। এক দিন সোহনলাল জড়িয়ে গেলেন তাঁর জীবনের সঙ্গে। ১৩ বছরের নির্মলাকে বিয়ে করলেন চল্লিশ পার হওয়া সোহনলাল। বিয়ের আগে নির্মলা ধর্মান্তরিত হলেন। নতুন নাম হল সরোজ খান। পরে একাধিক সাক্ষাৎকারে সরোজ জানিয়েছেন, তিনি স্বেচ্ছায় নতুন ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর উপর কোনও চাপ ছিল না। তিনি ইসলামে মানসিক শান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন।
তবে ত্রয়োদশী নির্মলা তখন জানতেনও না তাঁর স্বামীর এটা দ্বিতীয় বিয়ে। প্রথম পক্ষের বিয়েতে পাঁচ সন্তানের বাবা ছিলেন তিনি। সরোজের অভিযোগ ছিল, সে সব কথা গোপন করে তাঁকে বিয়ে করেছিলেন সোহনলাল। সোহনলাল-সরোজ খানের প্রথম সন্তানের জন্ম হয় ১৯৬৩ সালে। নাম রাখা হয় হামিদ। তবে তিনি বেশি পরিচিত রাজু খান নামে। দু’বছর পরে জন্ম হয় দ্বিতীয় সন্তানের। তবে মাত্র আট মাস বয়সেই মৃত্যু হয় তার। তাঁদের তৃতীয় সন্তানের নাম হিনা খান। সন্তানদের জন্মের পরে ক্রমশ ফাটল ধরে তাঁদের দাম্পত্যে। সরোজের সন্তানদের নিজের পরিচয় দিতে রাজি ছিলেন না সোহনলাল। বিচ্ছেদ হয়ে যায় তাঁদের। আবার সম্পর্ক জোড়া লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়নি। তিন সন্তানকে একাই বড় করেন কিশোরী সরোজ।
তাঁর পরিচয় এবং ধর্মবিশ্বাসই গ্রহণ করেছিলেন তিন সন্তান। পরে ব্যবসায়ী সর্দার রোশন খানকে বিয়ে করেন সরোজ। তাঁদের একমাত্র মেয়ে সুকাইনা খান এখন দুবাইয়ে নৃত্য প্রশিক্ষক। প্রথমে সহকারী নৃত্য পরিচালক হিসেবে কেরিয়ার শুরু করেছিলেন সরোজ খান। একক নৃত্য পরিচালক হিসেবে তাঁকে বলিউড প্রথম পায় ১৯৭৪ সালে, ‘গীতা মেরা নাম’ ছবিতে। তবে স্বীকৃতি পেতে সময় লেগেছে প্রায় এক দশক। ১৯৮৭ সালে মুক্তি পায় ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’। ছবিতে শ্রীদেবী-র ‘হাওয়া হাওয়াই’ নাচের সঙ্গে তামাম ভারতে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন কোরিয়োগ্রাফার সরোজ খান। এর পর ‘নাগিনা’, ‘চাঁদনি’ ছবির সঙ্গে সঙ্গে শ্রীদেবী আর সরোজ খানের পারফরম্যান্স কার্যত সমার্থক হয়ে ওঠে। শ্রীদেবীর পরে বলিউডের রাজপাট যায় মাধুরীর হাতে।
তাঁরও নেপথ্য কারিগর ছিলেন সরোজ-ই। ‘তেজাব’-এর এক দো তিন, ‘থানেদার’ ছবির ‘তাম্মা তাম্মা লোগে’, ‘বেটা’-র ধক ধক করনে লগা— সরোজের পরিচালনায় মাধুরীর একের পর এক পারফরম্যান্স হয়ে ওঠে বলিউডের আইকনিক। ‘ডর’, ‘বাজিগর’, ‘ইয়ারানা’, ‘মোহরা’, ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে’, ‘খামোশি দ্য মিউজিক্যাল’, ‘পরদেশ’, ‘সোলজার’, ‘লগান’, ‘স্বদেশ’, ‘বীর জারা’, ‘মঙ্গল পাণ্ডে’, ‘ফানা’, ‘ডন’, ‘সাওয়ারিয়া’, ‘যব উই মেট’, ‘দিল্লি সিক্স’, ‘লভ আজ কাল’, ‘এজেন্ট বিনোদ’ , ‘রাউডি রাঠৌর’, ‘গুলাব গ্যাং’, ‘তনু ওয়েডস মনু রিটার্নস’, ‘হম দিল দে চুকে সনম’, ‘দেবদাস’, ‘গুরু’, ‘চালবাজ’, ‘মণিকর্ণিকা’-র মতো অসংখ্য বক্স অফিস সফল ছবিতে ছড়িয়ে আছে সরোজের মণিমুক্তো। ২০১৯-এ মুক্তি পাওয়া ‘কলঙ্ক’-এ শেষ বারের মতো কোরিয়োগ্রাফি করেন সরোজ। বড় পর্দার পাশাপাশি উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল দূরদর্শনেও। ‘নাচ বালিয়ে’, ‘নাচ লে ভি উইথ সরোজ খান’, ‘বুগি উগি’, ‘ঝলক দিখলা যা’-র মতো শো বর্ণহীন হয়ে পড়ত সরোজকে ছাড়া।