নতুন সম্ভাবনাকে মেলে ধরে থার্ড সিনেমা
আর্জেন্টিনার চলচ্চিত্রকার ফার্নান্দো সোলানাস ও অক্টাভিও গেতিনো তৃতীয় বিশ্বের চলচ্চিত্রকে ১৯৬৯ সালে থার্ড সিনেমা নাম দেন। হলিউডের মুনাফামুখী ইন্ডাস্ট্রি যা কিনা আর্থিক সাফল্যের মানদন্ডে বিবেচিত হয়, তা প্রথম সিনেমা। এর বিপরীতে রয়েছে ইউরোপীয় অথর নির্ভর অভিজাত বুদ্ধিবৃত্তিক ও উঁচু শিল্পমানসর্বস্ব আভাঁ গার্দ সিনেমা যা দ্বিতীয় সিনেমার প্রতিনিধিত্ব করে। এই প্রতিবেদনের আলচ্য বিষয় থার্ড সিনেমা। এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন নির্মাতা রাম কৃষ্ণ সাহা।
জেনে নেওয়া যাক থার্ড সিনেমা কী? প্রথম ও দ্বিতীয় সিনেমার বড় দূরত্বে থাকা থার্ড সিনেমার মাধ্যমে প্রকাশ ঘটে অপেক্ষাকৃত নিরীক্ষাধর্মী ও প্রতিবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শের। থার্ড সিনেমার তাত্ত্বিক তেশোম এইচ গ্যাব্রিয়েল বলেছেন, থার্ড সিনেমা হলো তৃতীয় বিশ্বের চলচ্চিত্র যা সব অর্থে সাম্রাজ্যবাদ ও শ্রেণীশোষনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তবে গ্যাব্রিয়েলের কথায় মনে হতে পারে থার্ড সিনেমা সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শে নির্মিত সিনেমার আরেক নাম। কিন্তু থার্ড সিনেমা কেবলই 'সমাজতান্ত্রিক' ছবি নয়। পল ওয়াইলমেন বলেছে, একটি দেশের সংস্কৃতি, লোক-ঐতিহ্য, শিল্প-আঙ্গিক ইত্যাদি কাঁচামাল যে আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয় থার্ড সিনেমা তা বর্ণনা করতে চায়। তবে তৃতীয় বিশ্বের সিনেমামাত্রই যে থার্ড সিনেমা হবে, তা নয়। থার্ড সিনেমা বিশ্বের যেকোন দেশ থেকেই আসতে পারে।
বিষয়টি হচ্ছে নির্মাণের, অঞ্চলের নয়। প্রথম বিশ্বের চলচ্চিত্রকাররাও যোগ দিয়েছেন এ ধারায়। যেমন স্পাইক লি নির্মাণ করেছেন তার বর্ণবাদবিরোধী ছবি ডু দ্য রাইট থিং, জিম জারমুশ বানিয়েছেন কফি অ্যান্ড সিগারেট, জন অ্যাকমফ্রা করেছেন হ্যান্ডসওয়ার্থ সংস আর সারা গ্যাভরন চিত্রায়ণ করেছেন ব্রিকলেন। থার্ড সিনেমা কতগুলো রীতিনীতি মেনে চলে। যেমন, ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করে তার মধ্যেকার কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে সেখানে নারী অধিকার, আদিবাসী ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বিপন্নতা এবং শ্রেণিসংগ্রাম নিয়ে কথা বলে সে।
সমাজের বুদ্ধিজীবী ও গণমানুষের মধ্যে শিক্ষা ও সংলাপের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে থার্ড সিনেমা। রাজনীতির ক্ষেত্রে খোলা মন নিয়ে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর মাধ্যমে নতুন সম্ভাবনাকেও মেলে ধরে থার্ড সিনেমা। সোলানাস-গেটিনোর আওয়ার অব ফার্নেসেস, গিলো পন্টেকর্ভোর ব্যাটল অব আলজিয়ার্স, ওসমান সেম্বেনের হাল্লা, থমাস গুতিয়েরেজ আলিয়ার মেমোরিজ অব আন্ডারডেভেলপমেন্ট, মৃণাল সেনের পদাতিক, ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণরেখা কিংবা জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া এগুলোর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দেশ ও কালভেদে থার্ড সিনেমা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকজুড়ে লাতিন আমেরিকায় থার্ড সিনেমার চর্চা হলেও এর শুরুটা হয়েছিল পঞ্চাশের দশকের শেষে আর্জেন্টিনার সান্তা ফের ডকুমেন্টারি স্কুল থেকে, যার নেতৃত্ব দেন ফার্নান্দো বিরি তার টায়ার ডাই নামের প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণের মধ্যে দিয়ে। এরপরে ষাটের দশকে কিউবার সরকার কিউবা ফিল্ম ইন্সটিটিউট স্থাপন করে এবং সেখান থেকে বেরিয়ে এসে জুলিও গার্সিয়া এসপিনোজা ‘ইম্পারফেক্ট সিনেমা’র ধারনা দেন, যা মূলত স্বল্প বাজেটের রাজনীতিমনস্ক সিনেমাকে নির্দেশ করে।
ব্রাজিলীয় ‘ক্ষুধার নন্দনতত্ত্ব’ ধারনাও এক্ষেত্রে আলোচ্য। ব্রাজিলে ‘সিনেমা নভো’ আন্দোলনে গ্লবার রোচা নেলসন পেরেইরা ডস স্যান্টোস-এর মতো পরিচালকরা দেশটির সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও পশ্চাৎ পদ মানুষদের ওপরে যেসব সিনেমা নির্মান করেন, সেসব ছবির নন্দনতত্ত্বকে তারা নাম দেন ‘ক্ষুধার নন্দনতত্ত্ব’। লাতিন আমেরিকার পাশাপাশি আফ্রিকা ও এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে থার্ড সিনেমার চর্চা। প্রথম প্রজন্মের মৌরিতানীয় চলচ্চিত্রকার মেড হন্ডো আফ্রিকায় থার্ড সিনেমার অন্যতম একজন প্রবক্তা হন। তিনি ১৯৬৭-তে নির্মাণ করেন সোলেইল। এশিয়ার মধ্যে চীন ও ভারতে থার্ড সিনেমার প্রকাশ ঘটে সত্তরের দশকে। চীনে নবধারার সিনেমার সূচনা করেন ঝাং ইমু, চেন কাইগি ও তিয়ান ঝুয়াং ঝুয়াং।
এঁদের বলা হতো ‘শিল্পের সন্তান’। এছাড়া এশিয়ার মধ্যে ফিলিপিনো চলচ্চিত্রকার কিদলাত তাহিমিকের নামটিও সহজেই চলে আসে থার্ড সিনেমার কাতারে। তাকে বলা হয় ফিলিপিনো নিউ ওয়েভ সিনেমার জনক। একইসঙ্গে উল্লেখযোগ্য ফ্রাঙ্কো-ভিয়েতনামী নির্মাতা ট্রান আন হাংয়ের নাম, যিনি কাজ করেছেন উত্তর-উপনিবেশভিত্তিক গল্প আর আত্মজীবনী নিয়ে। ভারতে থার্ড সিনেমার আগমন ঘটে ইন্ডিয়ান প্যারালাল সিনেমা ও ইন্ডিয়ান নিউ ওয়েভের হাত ধরে।
১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেন পথের পাঁচালী, যা পরবর্তী সময়ে ইন্ডিয়ান প্যারালাল সিনেমা নামে একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করে। একই বছর মৃণাল সেন নির্মাণ করেন রাতভোর। এর আগে ১৯৫২ সালে যদিও ঋত্বিক ঘটক নাগরিক নির্মাণ করেন এবং ১৯৫৮ সালে তাঁর নির্মিত অযান্ত্রিক ছবিটি দর্শক ও বোদ্ধাদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে আশির দশকে সত্যজিৎ রায়ের কলকাতা ট্রিলজি অর্থাৎ প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৭০), সীমাবদ্ধ (১৯৭১) ও জন অরণ্য (১৯৭৬) এবং মৃণাল সেনের কলকাতা ট্রিলজি অর্থাৎ ইন্টারভিউ (১৯৭১), কলকাতা-৭১ (১৯৭২) ও পদাতিক (১৯৭৩) ছবিতে থার্ড সিনেমার জোরালো বৈশিষ্ট্যগুলো প্রতিফলিত হয় এবং ভারতে থার্ড সিনেমার বিকাশে এই ছবিগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। বাংলাদেশের থার্ড সিনেমা বাংলাদেশে চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে থার্ড সিনেমার চর্চা করেছেন পথিকৃৎ চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান ও চলচ্চিত্রাচার্য আলমগীর কবির, যাদের দুজনই ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। এক্ষেত্রে জহির রায়হানের একটি উদাহরণই যথেষ্ট, যার নাম জীবন থেকে নেয়া। এছাড়া তার পরিকল্পিত, একুশে ফেব্রুয়ারী কিংবা অসমাপ্ত, লেট দেয়ার বি লাইটের নামও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বটবৃক্ষের ছায়ায় বসে বাঙালির স্বাধীনতার যে মূলমন্ত্র তিনি উচ্চারণ করেছেন জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রে তা দেশ-কাল ছাপিয়ে থার্ড সিনেমার আন্তর্জাতিক মানচিত্রে স্থান করে নেওয়ার কথা ছিল; যদিও বাস্তবে হয়নি।
সম্ভবত জহির রায়হান সম্পর্কে আমাদের উদাসীনতা বা প্রচারবিমুখতাই এর জন্য দায়ী। অথচ সবচেয়ে উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা যে ব্যাটল অব আলজিয়ার্সের নাম উচ্চারণ করি তা কিন্তু নির্মিত হয়েছিল সফল বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর, স্বাধীন দেশে, সেইসব বিপ্লবীর পৃষ্ঠপোষকতায়। আর জীবন থেকে নেয়া নির্মিত হয়েছিল সবচাইতে প্রতিকূল রাজনৈতিক অবস্থা ও গণ-আন্দোলনের সময়। আর সেজন্যই তাকে আশ্রয় নিতে হয়েছে রূপকের, যার জাদুকরী ক্ষমতা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত টের পেয়েছিল। জহির রায়হানের অন্তর্ধানের পর তার সহযোদ্ধা আলমগীর কবির রাজনৈতিক ও বিপ্লবী চলচ্চিত্র নির্মাণের যে গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন, তার মাধ্যমে বেরিয়ে আসে তাঁর সূর্যকন্যা ও ধীরে বহে মেঘনার মতো যুগান্তকারী সব কাজ। সূর্যকন্যায় তিনি নারীমুক্তির কথা বলেছেন সাহসী উচ্চারণে, বলেছেন সমাজ পরিবর্তনের কথা। ধীরে বহে মেঘনায় বলেছেন বাংলাদেশের পুনর্জাগরণের কথা।
এরপরে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী নির্মাণ করেন নব্য ঔপনিবেশিকতাবিরোধী ছবি ঘুড্ডি, শেখ নিয়ামত আলী এবং মশিহউদ্দীন শাকের যৌথভাবে নির্মাণ করেন সূর্যদীঘল বাড়ি। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য তিনটি নাম মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল ও তারেক মাসুদ। মোরশেদুলের আগামী, সূচনা ও চাকা এবং মোকাম্মেলের হুলিয়া, নদীর নাম মধুমতি ও চিত্রা নদীর পাড়ে এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ, যেগুলোর মধ্যে থার্ড সিনেমার বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অপরদিকে, তারেক মাসুদের কাজের সঙ্গে সাদৃশ্য পাওয়া যায় প্রতিবাদী এবং বৈপ্লবিক থার্ড সিনেমার যেখানে লোক-ঐতিহ্য ও দেশজ সংস্কৃতির উপস্থাপনও লক্ষণীয়। ‘মাটির ময়না’য় বারবার বাউল আর বয়াতিদের গান উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে পরিচালক এই ছবির ফর্মে যুক্ত করেছেন দেশজ ছাপ। বিখ্যাত থার্ড সিনেমা তাত্ত্বিক তেশোম গ্যাব্রিয়েলের মতে, কোনো দেশের লোকজ সঙ্গীত এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক উপাদান থার্ড সিনেমায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ছবিটি প্রত্যক্ষরূপে ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস, গোঁড়ামি আর সাম্প্রদায়িকতার সমালোচনা করেছে। ছবিটি প্রথমে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং পরবর্তীকালে কিছু পরিবর্তন সাপেক্ষে মুক্তি দেয়া হলেও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়নি। থার্ড সিনেমা প্রায় সময়ই গতানুগতিকভাবে সিনেমা হলে মুক্তি না দিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে দর্শককে দেখানো হয়। যাদের উদ্দেশ করে এ ধরনের ছবি তৈরি হচ্ছে, সেই দর্শকরা যেন এমন ছবি দেখতে পারেন তা এ পদ্ধতির মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়। তারেক আর ক্যাথরিন মাসুদের শেষ পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি ‘রানওয়ে’ (২০১০) ধর্মীয় উগ্রচিন্তা আর জঙ্গিবাদের সমালোচনা তুলে ধরেছে। সিনেমা হলে মুক্তি দেয়ার আগে তারেক মাসুদ ব্যক্তিগতভাবে দেশের বিভিন্ন শহরে গিয়ে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও অন্যদের জন্য ছবিটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন। বহু সংখ্যক কমবয়সী দর্শক এই ছবি দেখার সুযোগ পায় এবং ছবিটির বিভিন্ন দিক নিয়ে পরিচালকের সঙ্গে সরাসরি আলোচনাও হতে থাকে। বক্তব্যধর্মী সাহসী ছবি দর্শক যেন দেখতে পায় এবং তা নিয়ে মতপ্রকাশ করতে পারে, এমন পরিবেশ তৈরির জন্য তারেক মাসুদের আন্তরিকতা ছিল প্রশংসনীয়।