‘মাসুদ রানা’ নিয়ে শেখ আবদুল হাকিম ও কাজী আনোয়ার হোসেন যা বলছেন

প্রথম আলো প্রকাশিত: ১৬ জুন ২০২০, ১৩:১০

লিখিত চুক্তিপত্র না থাকায় সেবা প্রকাশনীর কাজী আনোয়ার হোসেন ও লেখক শেখ আবদুল হাকিমের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ২৬০টি বইয়ের লেখক হিসেবে শেখ আবদুল হাকিমকে স্বীকৃতি দেওয়া রায় বলছে, ‘বই প্রকাশের আগে লেখক-প্রকাশকের মধ্যে প্রকাশিতব্য বইয়ের সংখ্যা, পারিশ্রমিক, কমিশনপ্রাপ্তি ইত্যাদি বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট চুক্তি থাকা উচিত।’

আবদুল হাকিম সেবা প্রকাশনীতে টানা ৪৫ বছর লিখেছেন। কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল, সেই প্রসঙ্গটি রায়ে একাধিকবার উঠে এসেছে। আদালতে কয়েকজন সাক্ষীর বক্তব্যে তা প্রমাণিত হয়েছে। রায় বলছে, বইয়ের রয়ালিটি দেওয়াকে কেন্দ্র করে মূলত কাজী আনোয়ার হোসেন ও শেখ আবদুল হাকিমের মধ্যে বিরোধের জন্ম।

সেবা প্রকাশনীর অন্যান্য লেখকের মতো আবদুল হাকিম পাণ্ডুলিপি দিয়ে টাকা নিতেন। বই বিক্রির পর আরও টাকা পেতেন। কাজী আনোয়ার হোসেনের সৃষ্টি ‘মাসুদ রানা’ পাঠকসমাজে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন লেখককে দিয়ে লিখিয়ে লেখার কিছু পরিবর্তন বা সম্পাদনা করে কাজী আনোয়ার হোসেন নিজের নামে এসব বই প্রকাশ করেছেন। তবে রায়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করছেন কাজী আনোয়ার হোসেন।

রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন জানিয়ে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘সত্য বলতে, আমি একটা সিরিজ তৈরি করলাম—“ধ্বংস পাহাড়”। “মাসুদ রানা”। তাতে রাহাত খান আছেন, সোহেল আছে, সোহানা আছে, ইত্যাদি চরিত্র আমি তৈরি করলাম। একটা বিশেষ ঢঙে আমি এগুলো তৈরি করেছি। পাঠক পছন্দ করলেন। এভাবে চলতে শুরু করল। একটা সময়ে আমি দেখলাম, আমি আর কুলিয়ে উঠতে পারছি না। ব্যবসা–বাণিজ্য। তখন আমি শেখ আবদুল হাকিমকে বললাম, “আপনি লিখতে চান এটা? আমি বলে দেব, ঠিক কীভাবে লিখতে হবে। কীভাবে চরিত্র হবে। সে অনুযায়ী যদি লিখে দেন, তাহলে আপনাকে এককালীন টাকা দেব এবং এটার ওপর আপনার কোনো রাইট থাকবে না। যেহেতু আমার সিরিজ। আমার সিরিজে তো আপনি লিখতে পারেন না। আমার সিরিজ “মাসুদ রানা” লিখে অন্য কোনো জায়গায় ছাপতে পারেন না। এটাতে উনি (শেখ আবদুল হাকিম) রাজি হলেন। টানা ৪৫ বছর ধরে লিখলেন। এরপর নানান ধরনের বইও তিনি লিখেছেন। সেগুলোয় তাঁর নাম গেছে। শুধু “মাসুদ রানা” ও “কুয়াশা” সিরিজে আমার নামে গেছে। কারণ, সিরিজ দুটি আমার।’

কাজী আনোয়ার হোসেনই যে ‘মাসুদ রানা’র জনক, তা স্বীকার করেন লেখক শেখ আবদুল হাকিম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কাজীদা “মাসুদ রানা”র জনক। কাজী আনোয়ার হোসেন। তিনি সত্যিকারের একজন ভদ্রলোক। গোপন করে তো উনি কিছু করেননি। ওনার নামে বই ছাপা হোক, তাতে আমার সম্মতি ছিল। আমি তো তখন আইন জানতাম না। উনি যেটা বলেছেন, সেটা মেনে নিয়েছি। বলেছেন, ওনার নামে ছাপলে বেশি বিক্রি হবে, আমরা মেনে নিয়েছি। আমি তো একা না। অনেকেই তো এভাবে লিখেছেন। একটা মানুষ, যিনি পরের নামে লেখেন, তাঁর তো নিডি অবস্থা। আমাকে লিখতে হয়েছে। আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করেন, আপনি জেনেশুনে কেন অন্যের নামে লিখেছেন। এর উত্তর দেওয়া যাবে না। আমি করতে বাধ্য হয়েছি। আমি লিখলাম, উনি কিনে নিলেন। দয়া করে আমাকে বছরের পর বছর টাকা দিয়েছেন। একবার তো দিচ্ছেন, আবার তিন মাস পরপর টাকা দিচ্ছেন। চাইলে টাকা দেন, না চাইলেও টাকা দেন। যখন আইন জানলাম, তখন আমার চোখ খুলে গেছে।’

বই বেশি ছাপলেও কম দেখানো হয় বলে দাবি করে শেখ আবদুল হাকিম বলেন, ‘একটা বইয়ের পাণ্ডুলিপি জমা দিলে ১০ হাজার টাকা আমাকে দিতেন কাজী সাহেব (কাজী আনোয়ার হোসেন)। এক মাস পর যখন বইটা বের হতো, তখন আরও কিছু টাকা পেতাম। পরে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে রয়ালিটি দিতেন। কিন্তু গোলমাল লাগছে, আমার বই তাঁরা ছাপছেন, সেটা কিন্তু খাতায় তুলছেন না। এটা তো সিরিয়াস একটা সমস্যা। একটা বই তাঁরা ছাপলেন ৬০ হাজার কপি। কিন্তু আমাকে দেখাচ্ছেন সাত হাজার। আমি তো ৫৩ হাজার বইয়ের পয়সা পাচ্ছি না।’ বইয়ের এই রয়ালিটি চাওয়া নিয়ে সেবা প্রকাশনীর কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্বের মূল সূত্রপাত হয়েছিল বলে দাবি করেন লেখক শেখ আবদুল হাকিম।

‘মাসুদ রানা’ ও ‘কুয়াশা’ সিরিজের কিছু বই শেখ আবদুল হাকিম হাকিম লিখেছেন, সেটি কপিরাইট বোর্ডের কাছেও লিখিতভাবে কাজী আনোয়ার হোসেনের পক্ষ থেকে জানানো হয়। রায় বলছে, কাজী আনোয়ার হোসেনের পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হয়, আবদুল হাকিম সেবা প্রকাশনীতে চাকরি করতেন। চাকরি থেকে আনোয়ার হোসেনের নির্দেশে বইগুলো লিখেছেন। মালিকের কথায় বই লেখায় আবদুল হাকিম বইয়ের স্বত্ব পেতে পারেন না। যেসব বইয়ের ভেতর আবদুল হাকিমের নাম রয়েছে, সেগুলো ছাড়া কোনোভাবে তিনি অন্য বইয়ের স্বত্ব দাবি করতে পারেন না। তবে কপিরাইট বোর্ড রায় বলেছে, আবদুল হাকিম যে সেবা প্রকাশনীতে চাকরি করতেন, এর সপক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ হাজির করতে পারেননি প্রতিপক্ষ কাজী আনোয়ার হোসেন। আবদুল হাকিম চাকরিজীবী হলেও পাণ্ডুলিপিপ্রণেতা হিসেবে রচনার মূল মালিক তিনি। প্রণোদনা, পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা চাকরি দিয়ে কারও রচনা নিজের বলে দাবি করা যায় না। যদি যেত, তাহলে ‘আকবরনামার’ লেখক হতেন সম্রাট আকবর, পণ্ডিত আবুল ফজল নন।

‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ‘জাল’ নামের বইটি যে শেখ আবদুল হাকিমের লেখা, সেটি কপিরাইট বোর্ড নিশ্চিত বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। রায়ে বলা হয়, ‘জাল’ বইটি প্রথম মুদ্রণে লেখক হিসেবে শেখ আবদুল হাকিমের নাম ছিল। তবে তৃতীয় মুদ্রণে তাঁর নাম নেই। নিশ্চিত হয়ে গত বছর ‘জাল’ বইটি হাকিমের নামে কপিরাইট সনদ দেওয়া হয়। কপিরাইট বোর্ডের ওই রায়ের বিপক্ষে কাজী আনোয়ার হোসেন কোনো আপিল করেননি। লেখক না হওয়া সত্ত্বেও কাজী আনোয়ার হোসেন বইয়ে নিজের নাম ছেপে কপিরাইট আইন লঙ্ঘন করেছেন। কপিরাইট আইন অনুযায়ী, প্রণেতার স্বত্বের মালিকানা কোনোভাবে হস্তান্তরযোগ্য নয়। প্রণেতার সম্মতি থাকলেও তাঁর পরিবর্তে লেখক হিসেবে নিজের নাম প্রকাশ করাও নৈতিকতার পরিপন্থী। ‘মাসদু রানা’ লেখার পক্ষে হাকিমের ৬ যুক্তি‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ২৬০টি বই এবং ‘কুয়াশা’ সিরিজের ৫০টি বই লেখার সপক্ষে শেখ আবদুল হাকিম ছয়টি যুক্তি কপিরাইট বোর্ডের কাছে তুলে ধরেছেন। প্রথম যুক্তি: কাজী আনোয়ার হোসেন নিজে গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন, তিনি আর ‘মাসুদ রানা’ লেখেন না। হাকিমসহ কয়েকজন তা লেখেন। একই সঙ্গে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ‘অটল সিংহাসন’ ও ‘প্রমাণ কই’ বইয়ের আলোচনা বিভাগে কাজী আনোয়ার হোসেন স্বীকার করেছেন, তিনি ‘মাসুদ রানা’ সিরিজ লেখেন না।দ্বিতীয় যুক্তি: ‘মাসুদ রানা’ ও ‘কুয়াশা’ সিরিজের বইগুলো কোন বইয়ের ছায়া অবলম্বনে লেখা হয়েছে, তা সবই তিনি বলতে পারবেন।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত

আরও