‘বোইনে কই তুই, মারে ক দশ লাখ টাহা লাগবো, না হলে কাল্লা কাইটা নদীতে ভাসাইয়া দিবো। এরইমধ্যে একজন তাকে পেটানো শুরু করলো। ডলার লাগবো ডলার। ভয়ে কান্না করছে আর বলছে ডলারই দিবো ভাই ডলাই দিবো...। মাগো ডলারই দিবো, মাগো আমারে মাইরালাইতেচে। মাগো কাইলকার ভিতর টাহা দিতো হবো, মা আমারে মাইরালাইতেচে, মাগো মাইরালাইতেচে।’
এভাবেই উচ্চ স্বরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জীবন বাঁচাতে বোনকে ফোন দিয়ে দশ লাখ টাকার কথা জানান লিবিয়ায় আটকে পড়া এক নির্যাতিত ভাই। লিবিয়াতে নির্যাতিত ভিকটিমদের কান্নাকাটি, আকুতি মিনতি বাংলাদেশে থাকা তাদের পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজনদেরকে পাঠিয়ে এভাবে টাকা দাবি করে মানবপাচারকারীরা। এসব ভয়ঙ্কর কল রেকর্ড শুনে ভিকটিমদের বাঁচাতে তার আত্মীয়-স্বজন দিশেহারা হয়ে ভিটে বাড়ি বিক্রি করে টাকা পাঠায়।
ভিকটিমদের লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক রেখে অমানুষিক শারিরীক নির্যাতনের বেশ কিছু কল রেকর্ড ডেইলি বাংলাদেশের হাতে আসে। সেখানে ভিকটিম শুধু টাকা, আর ডলার চাইছে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে। কথা বলার সময় অপর পাশে তাদের শারীরিক নির্যাতনের শব্দও শোনা যাচ্ছে রেকর্ডে।
গত ২৮ মে, লিবিয়ার মিসদাহ উপ-শহরের মরুভূমিতে ২৬ জন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করে মানবপাচারকারীরা। সেইসঙ্গে মারাত্বক ভাবে আহত করা হয় আরো ১১ জনকে। লিবিয়া এবং ইটালিতে অভিবাসী হতে যাওয়া অনেক বাংলাদেশি বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনে আহত, নিহত ও চিরতরে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতি ২৬ জন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে দেশের আইনশৃংখলা বাহিনী।
হাতে পাওয়া এক কল রেকর্ডে শোনা যায় একজন স্বামী তার স্ত্রীকে বলছেন, হ্যালো, সুমি। পরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছেন, ‘আমি তোমারে না কইছি এই নাম্বারে ফোন দিতো, তুমি তো ফোনও দিলেনা। তুমি দুলাভাইরে কও আমারে দশ লাখ টাকা দিতো। আমারে এখান থাইক্যা ছুটাই লিয়া যাইতো। আমি আষ্টদিন ধইরা কিছু খাইনাই। ওরা আমারে মাইরা ফেলাবো। ওরা মানুষের মাইরা ফেলাইতাছে। সজল ভাইয়ের বায়িত যাও, সজল ভাইয়ের ইমু নাম্বার এই নাম্বারে পাঠাও আর তোমরা আমার ফোন ধরনা ক্যারে।’
আবারো ২৪ সেকেন্ডে কল রেকর্ডে ভিকটিম তার স্ত্রীকে বলছে, সুমি গো আমারে বাঁচাও গো। দশ লাখ টাকার জন্য আমারে মাইরালাইতাচে। সুমি গো, আমার লাশও দেখতে পাইবানা গো। সুমি আমারে মাইরালাইলো গো।’
অপর একটি কল রেকর্ডে একজন বলছেন, ‘ময়নারে আমারে বাঁচাও গো ময়না। বাইত থ্যাইকা এক দুই লাখ টাহা আপাততো পাঠাও গো। ময়না আমারে মাইরালাইবো, লাশ পাইবা গো ময়না লাশ।’
দেশের আইনশৃংখলা বাহিনী অনুসন্ধান করে জানতে পারে, লিবিয়ার বিভিন্ন এস্টেটে কাজ ও লিবিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশি দালালরা অন এ্যারাইভাল ও ভিজিট ভিসার মাধ্যমে এসব সহজ সরল মানুষকে লিবিয়ায় পাচার করে। এরপর ভিকটিমদের দেশটির বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক রেখে অমানুষিক নির্যাতন করে। আর সেই নির্যাতনে সহযোগিতা করছে এ দেশের কিছু দালাল। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনকে আটক করেছে র্যাব, পুলিশ ও সিআইডি।
অপর একটি কল রেকর্ডে শোনা যায়, ‘আমারে মাইরা দুইটা হাত ভাঙ্গা হালাইচে গো সোনা। আমারে বাঁচাও গো সোনা, বাঁচাও। বাইত ফোন দাও গো, জাফর ভাইয়ের কতা তুমি হুইনো না গো, আমার প্রাণ ভিক্ষা দাও গো সোনা, ভিক্ষা দাও।’
এভাবে প্রায় সব কল রেকর্ডে সবাই পরিবারের কাছে কান্নাকাটি করছে আর ডলার, টাকা চাচ্ছে নিজের জীবন বাঁচাতে। মারাত্বক ভাবে আহত করার কথা পরিবারের কাছে বলছেন তারা।
সম্প্রতি লিবিয়ায় ২৬ জন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় পুলিশ প্রধান ড. বেনজির আহমেদ বলেছেন, যারা আমাদের দেশের নাগরিকদের প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশে নিয়েছে, যাদের কারণে এই নির্মম মৃত্যু ঘটেছে তাদের একজনকেও ছাড় দেয়া হবে।
আইজিপি আরো বলেছেন, তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করে এই চক্রের প্রত্যেক সদস্যকে আইনী প্রক্রিয়ায় কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। যেন ভবিষ্যতে কোনো বাংলাদেশিকে এভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে তার জীবন নিয়ে খেলার দুঃসাহস কেউ দেখাতে না পারে। দেশে ও বিদেশে যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেনো এদের প্রত্যেককে খুঁজে বের করা হবে।
বিষয়টি নিয়ে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, যারা মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। লিবিয়ায় যে ঘটনাটি ঘটেছে তা মর্মান্তিক। আমরা এরইমধ্যে এর মূলহোতাকে গ্রেফতার করেছি। আমরা কাউকে ছাড় দেবো না। এখনো আমাদের অভিযান চলছে।
অন্যদিকে, ২৬ বাংলাদেশি নাগরিককে গুলি করে হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ডিআইজি (অর্গানাইজড ক্রাইম) ইমতিয়াজ আহমেদ বলেছেন, বিদেশে পলাতক মানবপাচারকারী চক্রকে ধরতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা নেয়া হবে। প্রয়োজনবোধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা হবে।
সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
We use cookies to ensure you get the best experience on our website.