আমার নীতির আলোচনা-সমালোচনা করার অধিকার তাদের দিয়েছি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, সমালোচকরা সব সময়ই রয়েছে। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। আমার নীতির আলোচনা ও সমালোচনা করার অধিকার আমি তাদের দিয়েছি। সমালোচনায় আমার আপত্তি নেই। কারণ, আমি জানি জনগণ আমাকে ভালোবাসে। আমিও তাদের ভালবাসি। সামান্য কিছু সমালোচনায় আমার বা আমার দলের বা জনগণের কিছু আসবে-যাবে না।১৯৭২ সালের ১৩ মে শনিবার আমেরিকান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের (এবিসি) প্রতিনিধি পিটার জেনিংস ও মি. লুইয়ের সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সাক্ষাৎকারটি ওই বছর ১৪ মে দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ সাক্ষাৎকারটি প্রচার করার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়। এই সাক্ষাৎকারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পিকিং সফর ও আসন্ন মস্কো সফর কোনও না কোনোভাবে বাংলাদেশের জন্য সহায়ক হবে কিনা, জানতে চাওয়া হলে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘নিক্সন নিজের স্বার্থেই বিভিন্ন দেশ সফর করে বেড়াচ্ছেন। তারা বৃহৎ শক্তি। তারা যেকোনও স্থানে যেতে পারেন, যে কোনও বিষয়ে আলোচনা করতে পারেন। সে সম্পর্কে আমার কী বলার থাকতে পারে?’বাংলাদেশে দীর্ঘদিন যাবৎ ষড়যন্ত্র চলছে বলে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশেই ষড়যন্ত্র চালানো হচ্ছে, তা সবাই জানে। কিন্তু আমি এখন তাদের নাম বলতে চাই না।’ এদিকে দেশে ফিরে আসার চার মাসের মধ্যেই আপনার ও দেশের গতিধারার সমালোচনা শুরু হয়েছে উল্লেখ করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হলে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি স্বাধীনতা দিয়েছি। আমিই দেশের অগ্রগতি সাধন করবো। আমার জনগণ কোনও সময়ই হতাশ নয়।’ বিরোধী দল গঠনের বিষয়ে পরিকল্পনা কী সেই প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘জনগণ যদি কাউকে ভোট না দেয়, তাহলে তো আমি আর বিরোধীদল সৃষ্টি করতে পারছি না। নির্বাচন দিলে কেউ যদি তাতে রাজি হয়, তাহলে সে বিরোধী দলে বসবে, আমার তাতে আপত্তির কিছু নেই।’ এই সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু আবারও তার চারটি নীতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমার চার নীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা আপনারা জানেন। আমি কড়াকড়িভাবে সেগুলো অনুসরণ করবো।’নিক্সনকে ধন্যবাদ জানাতে পারি নামার্কিন প্রেসিডেন্টের চীন সফর ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের পর নির্বাচন সম্পর্কে তার মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে কিনা প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে বলে আমি খুশি। তবে এই স্বীকৃতি দিতে অনেক সময় নিয়েছে। কিন্তু আমি যতটুকু জানি মার্কিন জনগণ, সাংবাদিক আর কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা আমাদের বরাবরই সমর্থন দিয়েছেন। আমার দেশের যেসব লোক বাধ্য হয়েছিল দেশত্যাগ করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে, কিছুসংখ্যক মার্কিন নেতা তাদের দেখতেও এসেছিলেন। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাদের নাম স্মরণ করি। কিন্তু মিস্টার নিক্সন আর মার্কিন সরকার সেসময় খোলাখুলিভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছে। আমি সেজন্য তাকে অভিনন্দন বা ধন্যবাদ জানাতে পারি না।’শর্তসাপেক্ষে কোনও সাহায্য নয়স্বীকৃতি পরবর্তী সময়ে আপনার দেশে যেসব সাহায্য আসছে তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে সর্বাধিক সাহায্য দিচ্ছে। এবং ভবিষ্যতে আমেরিকা এদেশকে এককভাবে সর্বাধিক সাহায্য দেবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক কী হবে বলে মনে করেন, এবিসির এই প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র একটা বৃহৎ শক্তি। আমাদের সাহায্য দেওয়ার ক্ষমতা তাদের আছে। কিন্তু আমি একথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছি যে, সাহায্য হতে হবে সম্পূর্ণ শর্তহীন। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আমাদের কিছু সাহায্য দিয়েছে আরও দেবে। তারা এ যাবত যে সাহায্য দিয়েছে তা সম্পূর্ণ শর্তহীন। আমার দেশের সাত কোটি অধিবাসীর অধ্যুষিত একটি ছোট দেশ। আমার দেশের অর্থনীতির সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। আমার নীতি অত্যন্ত পরিষ্কার। আমি স্বাধীনতা ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতিতে বিশ্বাসী। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমার দেশের জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাদের স্মরণ করি। আমার বন্ধুদের বন্ধুত্ব আমি সানন্দে গ্রহণ করেছি।’সেসব কোন ষড়যন্ত্র?ক’দিন আগে ঢাকার কটন মিলে এক ভাষণে আপনি বলেছেন, ‘আমরা ষড়যন্ত্রের অবসান ঘটাবো’, আপনি কোন ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিশ্বের সর্বত্রই ষড়যন্ত্র চলছে।’ এই প্রশ্ন আপনি এখন তুলছেন কেন প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি জানি বিশ্বের সর্বোচ্চ ষড়যন্ত্র চলছে।’ আপনি আরও বলেছিলেন, ‘এসব ষড়যন্ত্রের পেছনে কোথাও কোথাও বিদেশি অর্থ আছে— এটা কোন দেশের অর্থ, প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এ নিয়ে আমি আপনাদের কথা বলবো, তা আপনারা আশা করছেন কী করে। আমার গোয়েন্দা বিভাগ এ ব্যাপারে কাজ করছে। এদেশে গোলযোগ সৃষ্টি করতে কিছু সংখ্যক লোককে তারা অর্থ দেওয়ার চেষ্টা করছে। তা আমি জানি। কিন্তু এদেশের সব ঘরেই আমার লোক আছে। কারও পক্ষেই এখানে কিছু করা সম্ভব হবে না। কিন্তু তবুও কিছু সংখ্যক লোক অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে।’