‘দেশে ফিরে বিচার পাচ্ছেন না মধ্যপ্রাচ্যে নির্যাতিত গৃহকর্মীরা’
সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরে আসা গৃহকর্মীরা ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না। দালালদের ভয়ে ও দারিদ্র্যতার কারণে নির্যাতিত হয়েও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। বুধবার এমনটা জানিয়েছে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ)। তারা বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে নির্যাতন ও কর্মস্থলে হেনস্তার শিকার হওয়া দেশে ফিরে আসার পর তাদের দালালরা তাদের ভয় দেখায়। এছাড়া আইনি সহায়তার খরচ জোগাতে না পারায় ন্যায়বিচার পাচ্ছে না তারা।বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে আসা ১১০ জন অভিবাসী কর্মীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে ওকাপ। তাদের মধ্যে ৮৬ শতাংশ জানিয়েছে, তারা পূর্ণ বেতন পায়নি। ৬১ শতাংশ শারীরিকভাবে নির্যাতনের কথা জানিয়েছে। ২৪ শতাংশ জানিয়েছে, তাদের নিয়মিত খাবার দেয়া হয়নি ও ১৪ শতাংশ যৌন নির্যাতনের কথা জানিয়েছে।রয়টার্স জানায়, দালালের মাধ্যমে সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজ করতে গিয়েছিল নূরী বেগম। তিনি জানান, তাকে মারধর করা হতো। সেখানে দুই মাস তাকে কোনো বেতন দেয়া হয়নি। এমনকি জেলও খাটতে হয়েছিল দুই মাস। অবশেষে বাংলাদেশে ফেরত আসেন তিনি। গত আগস্টে তার দালালের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করে আদালতের দ্বারস্থ হন তিনি। এজন্য দালালের নৃশংস মারধরের শিকার হন তিনি। বেগম বলেন, আমার দালালের বাড়ি আমার বাড়ির কাছেই। মামলা করায় সে আমায় মেরেছে। আমার পা ভেঙে দিয়েছে। আমি ১৫ দিন হাসপাতালে ছিলাম। এখন আমি আমার এক বন্ধুর বাসায় থাকি। নিজের বাসায় থাকি না।প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারী সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ জানান, অভিবাসীদের গড়ে তুলতে আরো অর্থ ব্যয় করতে হবে সরকারকে। তিনি বলেন, বিদেশে আমাদের নারী কর্মীদের চাহিদা বাড়ছে। তাদের সুরক্ষা দিতে হবে আমাদের। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। কিন্তু তবুও ফাঁকফোকর রয়ে গেছে। আমাদের সেগুলো পূরণে কাজ করতে হবে।উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিদেশিকর্মী সরবরাহকারী দেশগুলোর একটি। প্রতিবছর এখান থেকে কাজের খোঁজে বিদেশ যায় প্রায় ৭ লাখ মানুষ। কিন্তু এদের বেশির ভাগই বিদেশ যাত্রা করে বেসরকারি দালালদের সহায়তায়। ফলে অনেকেই না জেনে মানবপাচারের শিকার হন।ওকাপ জানিয়েছে, বিদেশ যাত্রাকারী প্রতি ১০ জনের একজন হচ্ছে নারী। এদের মধ্যে অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ও দরিদ্র। তাদের উচ্চ বেতনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদেশ পাঠিয়ে থাকে দালালরা। কিন্তু বিদেশ পৌঁছানোর পর অনেকেই দেখেন ভিন্ন পরিস্থিতি। নির্মমতার শিকার হন তারা। অনেকে প্রতিশ্রুত চাকরি পান না। অনেকে চাকরি পেলেও বেতন পান না। বেশির ভাগই শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের শিকার হন।ওকাপের এক অনুসন্ধান অনুসারে, প্রতি বছর বিদেশে নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরে আসে হাজারো নারী অভিবাসীকর্মী। এদের মধ্যে মাত্র ৩১৮ জন ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো থেকে ৯ হাজার ২০০ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। সরকারি তথ্যঅনুসারে, ২০১৭ সালে মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে গিয়েছিল প্রায় ৮৩ হাজার নারী কর্মী। ২০১৫ সালে সৌদি আরবের সঙ্গে গৃহকর্মী পাঠানোর চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। এরপর থেকে সেখানে অভিবাসীকর্মীদের যাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। একইসঙ্গে দেশে ফিরে আসা কর্মীদের সংখ্যাও বেড়ে যায়। এদের বেশির ভাগই দাবি করেন, তারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন পৃষ্ঠা ১৭ কলাম ৪। দাতব্য সংস্থা ব্র্যাকের হিসাব অনুসারে, ২০১৮ সালে দেশে ফিরে এসেছেন ১ হাজার ৩০০ গৃহকর্মী। ২০১৯ সালে এখন পর্যন্ত ফিরে এসেছেন ৯০০। এদের প্রত্যেকেই বিদেশে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানান।ওকাপকে সাক্ষাৎকার দেয়া বহু নারী জানিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যে তাদের এজেন্টরা তাদের মারধর করেছে, না খাইয়ে রেখেছে ও বারবার নির্যাতনকারী মালিকের কাছে ফিরে যেতে বাধ্য করেছে।ওকাপ জানায়, এত নির্যাতন ও নির্মমতা সহ্য করার পরও এসব গৃহকর্মী আদালতে যেতে চায় না। তাদের ভাষ্য, এই ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত। তারা নির্যাতনের কথা শুনিয়ে কলঙ্কিত হতে চায় না। তাদের ভয়, বাংলাদেশে দালালরা মামলা প্রত্যাহার করে নিতে চাপ দেবে তাদের। কিন্তু এসব বাধা সত্ত্বেও বেগম আদালতে গেছেন। তিনি বলেন, সে যখন আমায় মেরেছে, আমি আর পিছু হটবো না।
- ট্যাগ:
- বাংলাদেশ
- গৃহকর্ত্রী
- ঢাকা