একজন দীপঙ্করের ‘বাতিঘর’

মানবজমিন প্রকাশিত: ২০ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

ওই যে দেখা যাচ্ছে জাহাজের কেবিন। মাস্তুল, পাটাতনও চোখে পড়ছে। সমুদ্রে নোঙ্গর করা। এর মধ্যে পণ্যবাহী কনটেইনার। আরে এতো জাহাজ নয়। বইঘর! চট্টগ্রামের সাহিত্য-সংস্কৃতির আধার ‘বাতিঘর’। এখন চট্টগ্রামের দর্শনীয় স্থান। অথচ এর শুরুটা এক ইতিহাস। আড্ডা থেকেই এর সূচনা। বন্ধুরা মিলে আড্ডায়, কথাবার্তায় এ স্বপ্নের বুনন। চারপাশে নেতিবাচক খবর। বইবিমুখ হয়ে যাচ্ছে মানুষ। যুবসমাজ ঝুঁকছে অপসংস্কৃতিতে। পাঠাভ্যাস ঠেকছে তলানিতে। মাথায় ছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির অভিজ্ঞতা। বইবাজার আর ভালো প্রকাশনার খোঁজখবর। এসব নিয়েই আড্ডা হতো চেরাগির মোড়ে। একদিন বন্ধুরাই প্রস্তাব করলো একটি বইয়ের দোকান গড়ার।  সময়টা ২০০৫ সাল। চেরাগির মোড়ে মাত্র ১০০ স্কয়ার ফিট জায়গায় যাত্রা শুরু। একেবারে তারিখ ধরে বললে ১৭ই জুন। কবি নির্মলেন্দু গুন উদ্বোধনে হাজির ছিলেন। একটি বইয়ের দোকান। গল্প, কবিতা, উপন্যাসের কিছু বই এই ছিল সম্বল। তবে এর নামকরণও হয়েছিল মজার কায়দায়। সব বন্ধুরা মিলে বেশকিছু নাম কাগজে লিখে আড্ডায় জমা দিলো। তার মধ্যে থেকে ‘বাতিঘর’ নামটি বাছাই হলো। আর এ নিয়ে বিতর্কও হলো। এটি কি কোন লাইট হাউজ নাকি? লোকজন কি লাইট কিনতে এখানে আসবে? সময়ের আবর্তনে স্পষ্ট হলো, কেন এর নাম বাতিঘর? কি করতে চায় বাতিঘর? না এটি সাধারণ কোনো লাইট হাউজ নয়। অন্ধকারে পথ দেখাতে সংস্কৃতির আলো হাতে যে পথ চলবে- এটি সেই ‘বাতিঘর’। দিন যাচ্ছে আর এর ব্যাপ্তি ও কলেবর বেড়েছে। ৩ জন কর্মী থেকে ১৪ বছরে এখন ৩৩ জন কর্মী। একটি থেকে এখন ৩টি আউটলেট। চট্টগ্রাম, ঢাকা এবং সবশেষ সিলেটে। প্রথমদিকে শুধু ঢাকার বাজার থেকে বই যেত। পরে ধীরে ধীরে দেশের বাইরে বিভিন্ন বইমেলায় অংশ নিতে থাকে বাতিঘর। বইয়ের সংগ্রহ বাড়তে থাকে। পাঠকের চাহিদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে থাকে বাতিঘর। যে কোনো বই পাঠক যখন অন্যত্র না পায় তখন বাতিঘর তাদের ভরসাস্থল।দিন যায়, দিন আসে। শুধু কি বই বিক্রয় করবে বাতিঘর? না নিছক তা নয়। লেখক-পাঠকের মেলবন্ধনে কাজ শুরু করে বাতিঘর। একে একে দুই বাংলার প্রথিতযশা লেখকরা বাতিঘরে এসে আড্ডা দিতে থাকে পাঠকদের সঙ্গে। তাদের লেখা পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে মশগুল হতে থাকে আড্ডায়। প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, বিক্রম শেঠ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, হেলাল হাফিজ, জাফর ইকবালের মতো প্রখ্যাত লেখকদের পদচারণায় মুখর এখন সবক’টি বাতিঘর। হালে যুক্ত হয়েছে প্রকাশনাও। শুধু বই নয়, প্রতিটি সেন্টারেই রয়েছে কফির ব্যবস্থা, লম্বা সময় নিয়ে বই পড়া, উন্মুক্ত আলোচনার ব্যবস্থা। সব মিলে এ যেন এক সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র। আর প্রতিটি আউটলেট সাজানো হয়েছে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য মাথায় রেখে। চট্টগ্রামে বাতিঘর সাজানো হয়েছে পুরনো জাহাজের আদলে, ঢাকায় লালবাগ কেল্লা আর সিলেটে ক্বীন ব্রিজ। সবাই যেন বাতিঘরকে তার নগরের অতিপরিচিত সজ্জন বলে মনে করে। আর ১৪ বছরে এই সফলতার  কাণ্ডারী যিনি- তিনি দীপঙ্কর দাশ। বইপাগল এই মানুষটি তার স্বপ্ন নিয়ে লড়ছেন এক যুগের বেশি সময়। দীপঙ্করের এগিয়ে চলাপটিয়ার ধলঘাট ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পীটস্থান, বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদারের জন্মগ্রাম। এই ধলঘাটেই জন্ম গ্রন্থবিপণি বাতিঘরের উদ্যোক্তা দীপঙ্করের। কলেজ জীবনে পটিয়ার মোস্তাফিজুর রহমান পাবলিক লাইব্রেরি নামক একটি পাঠাগার দীপঙ্করের হৃদয়ে জ্ঞানবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। পড়াশোনার ফাঁকে সেই পাঠাগারে নিয়মিত যাতায়াত করতেন, এই পাঠাগার তার সামনে এনে দিলো এক নতুন জগৎ আর তা হলো বইয়ের দুনিয়া। সেই পাঠাগারের সদস্যরা একসময় মালঞ্চ সচেতন সাহিত্য গোষ্ঠী নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন, দীপঙ্কর সেই সংগঠনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯৯৭ সালে পটিয়ায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের শাখা খোলা হলে দীপঙ্কর সেই শাখার সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ঢাকায় ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি চালুর উদ্যোগ নেয় তখন দীপঙ্করকে ডেকে পাঠান আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। এখানে কাজ করার সময় দীপঙ্করের সঙ্গে প্রকাশক, গ্রন্থ ব্যবসায়ীসহ অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে। ২০০১ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র চট্টগ্রামেও ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি চালুর উদ্যোগ নেয়। সেই উদ্যোগ বাস্তবায়নে দীপঙ্কর চট্টগ্রামে যোগ দেন। নিজের শহরে এসে কাজ শুরু করেন দ্বিগুণ উৎসাহে। ওই সময় চট্টগ্রামে বইয়ের দোকান গড়ার স্বপ্নটা বাস্তবে রূপ দেয়ার উদ্যোগ নেন দীপঙ্কর। প্রায় চার বছর বেতন থেকে কিছু কিছু জমিয়ে, ধারদেনা করে অবশেষে ২০০৫ সালে চেরাগি পাহাড়ের মোড়ে বাতিঘর শুরু করেন। মাত্র ১০০ বর্গফুটের একটি দোকান, কম দামি বইয়ের তাক, সামনে বসার জন্য একটি টুল-এই ছিল বাতিঘরের শুরুর দিকের অবয়ব। কিন্তু বাতিঘরে বইয়ের সংগ্রহ ছিল বিচিত্র। ছোট্ট এই পরিসরে শুরুতেই ছিল দেশি-বিদেশি প্রায় ৫ হাজার বই। দীপঙ্করের নিজের কথায়ছেলেবেলায় নিজ গ্রাম পটিয়ায় পাঠাগারের সদস্য ছিলাম। পড়ে পেশায়ও ঢাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপত্র নিয়েই কাজ করি। চট্টগ্রামে বেড়াতে গেলেই বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় বসলে অভিযোগ শুনতাম, পছন্দের বই খুঁজে পাই না। তখন ভাবলাম, একটি বইয়ের দোকান করলে কেমন হয়। যেখানে পছন্দের বইগুলো অন্যেরাও এখান থেকে সংগ্রহ করতে পারবে। বই আবেগের জায়গা। শুধু ভাবনার ভিত শক্ত করতে লাগলাম। ২০০৫ সালে কাজে নেমে গেলাম। অনেকেই নেতিবাচক কথা বলেছে। এখন মানুষ বই কিনে না। এ সময়ে বইয়ের দোকান। হতাশ হয়নি। সাতবছর লেগেছে আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে। আর এ সময়টিতে পাঠকই ছিল প্রেরণা। একেকজন পাঠকই আমাদের বাতিঘর।শুরুর তিনবছর শুধু দেশের বই বিক্রি করতাম। পরে ২০০৮ সাল থেকে বাইরের বিভিন্ন মেলা থেকে বই আমদানি শুরু করি। ছোট দোকানটিতে বই রাখার জায়গা ছিল না। বাইরে একটি টুলে লোকজন বসত। বন্ধু স্বজনরা বলাবলি করতে থাকে বড় জায়গায় যাওয়ার জন্য। ২০১২ সালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ভবনে আড়াই হাজার স্কয়ার ফিটে বাতিঘর বৃহৎ পরিসরে যাত্রা শুরু করে। শিল্পী আমিনুর রহমান পুরনো জাহাজের আদলে ঐতিহ্যবাহী একটি ডিজাইনে গড়লেন। হলো ক্যাফে শপ। ঢাকা থেকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ চট্টগ্রাম এলেই আসেন বাতিঘরে। তিনি বললেন, তুমি ঢাকাতেও আসতে পার। তিনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একটি জায়গা দিলেন। ঢাকায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু করে। আর চলতি বছরেই সিলেটে। এরই মধ্যে ধীরে ধীরে বাতিঘর বই প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে। ২০১৬ সালে আমরা অংশ নিই একুশে বইমেলাতে। বাতিঘর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বর্তমানে ছাড়িয়েছে দেড়শ’।চট্টগ্রাম, ঢাকা, সিলেট এরপর কোথায়? চট্টগ্রাম বাতিঘরে ঢুকলেই চমক। জাহাজের কেবিনে হালকা সুরে বাজছে দূর সমুদ্রের গান। মেঝেতে কাঠের পাটাতন, ছাদে ঝুলছে নোঙর ফেলার মোটা রশি, ঈষৎ পড়ে রয়েছে পণ্যবাহী কনটেইনার। জানালায় চোখ দিলে মনে হবে এ যেন এক সমুদ্রগামী জাহাজ, ফেনিল ঢেউ পাড়ি দিয়ে ছুটছে আলোকের সন্ধানে। এটি কোনো জলযান নয়, এটি একটি বইয়ের দোকান। জাহাজের আদলে দোকানের অভ্যন্তরীণ সজ্জায় তুলে ধরা হয়েছে রূপসী চট্টগ্রাম তথা বন্দরনগর চট্টগ্রামকেই। চট্টগ্রামের জামাল খান প্রেস ক্লাব ভবনের নিচতলার গ্রন্থবিপণি বাতিঘর বইয়ের সংগ্রহ প্রায় লাখ ছাড়িয়েছে। একইভাবে ঢাকা বাতিঘরকে সাজানো হয়েছে লালবাগ কেল্লার আদলে। বাংলামোটর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে সপ্তম তলায় এ বিক্রয় কেন্দ্রে ঢুকলে মনে হবে এ যেন মোগল অন্দরমহল। সিলেটের বাতিঘরে গেলে মনে হবে সুরমার বুক চিরে ক্বীন ব্রিজের স্নিগ্ধ বাতাসে ঘুরে বেড়ানো। পাঠকদের চাহিদা মাথায় রেখে ধীরে ধীরে বাতিঘর ছড়িয়ে যাবে দেশের অন্যান্য বড় শহরে এমনটাই স্বপ্ন। আরও শাখা সম্প্রসারণ করতে প্রয়োজন আর্থিক সঙ্গতি। স্বপ্ন আছে কিন্তু তার জন্য অপেক্ষায় দীপঙ্কর। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাদীপঙ্করের স্বপ্ন সারা দেশে একটি রিডার্স সোসাইটি গড়ে তোলা এবং প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে বিশ্বমানের বইয়ের দোকান প্রতিষ্ঠা করা। তবে শুধু বই বিক্রয়ের কেন্দ্র নয় একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনেও ভূমিকা রাখতে চায় বাতিঘর।(ছবি- জীবন আহমেদ )

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও