
বিয়ের প্রতীকী ছবিটি সংগৃহীত।
সত্যিই কি বিয়ের ঋতু আছে?
আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:১৩
(প্রিয়.কম) নভেম্বর থেকে জানুয়ারি, বাংলায় বললে অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ মাসকে ‘বিয়ের ঋতু’ হিসেবে চিন্তা করা হয়। অর্থাৎ, বিয়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে নিজেদের অজান্তেই। আবার, পৌষমাসে বিয়ে হলে নাকি কন্যা আচার ভ্রষ্টা এবং স্বামী বিয়োগিনী হতে পারে, এমন কুসংস্কারও প্রচলিত রয়েছে। শরৎকালে বিয়ে করতে গেলেও পড়তে হয় কুসংস্কারের খপ্পরে। গ্রাম বাংলায় প্রচলিত রয়েছে- ভাদ্র মাসে বিয়ে করতে নেই, এ মাস অপয়া-অশুভ!
তবে এসব বিশ্বাসের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। মূলত একেক অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থান ও তাদের জীবিকা নির্বাহের পদ্ধতির কারণে, বিয়ের ঋতুর হেরফের হয়। যেমন, বহুকাল ধরেই পৌষ মাসে গ্রাম বাংলার বাসিন্দারা নানা প্রকার কাজে ব্যস্ত থাকেন। পৌষে তারা ধানসহ আরও নানা প্রকার ফসল সংগ্রহ করেন। এ মাসের ফসল দিয়েই সারা বছর পার করতে হয় তাদের। আর তাই এ মাস হচ্ছে ব্যস্ততার মাস, কোনোরূপ বিনোদনের ঠাঁই নেই এ মাসে। ফলে, বিয়ের মতো জমকালো আনন্দ উৎসবের লাগাম টানার উদ্দেশ্যেই তৎকালীন সমাজপতিরা তৈরি করে নিয়েছিলেন ‘মিথ’। এটিই কালের বিবর্তনে কুসংস্কার হিসেবে প্রবেশ করেছে সংস্কৃতিতে। এখানে প্রশ্ন জাগে, বিয়ের অনুষ্ঠানে তেমন কীইবা আড়ম্বর যে কাজ করার মাসে বিয়ে করা যাবে না?
উত্তর হচ্ছে, এখন আমাদের বিয়েতে উৎসব আয়োজনের সংখ্যা অনেক কমে গেলেও, আগে এতটা কম ছিল না। আমাদের বর্তমান কৃষ্টি-কালচারের একটা বড় অংশ মূলত বিভিন্ন ধর্ম থেকে এসেছে। এ যুগের বিয়ের অনুষ্ঠান বলতে আমরা কেবল কনে দেখা, গায়ে হলুদ, বিয়ে ও বৌভাত পর্যন্তই বুঝি। কিন্তু বিভিন্ন ধর্মে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপ্তি অনেক বড়।
আমরা যে বিয়ে করছি, অতীতের রীতিনীতি অনুযায়ী সেই বিয়েকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। এক- চলন্ত বিয়ে, দুই- নামন্ত বিয়ে এবং তিন- ঘরজামাই বিয়ে। বর যদি কনের বাড়ি গিয়ে বিয়ে করেন, তাহলে সেটা চলন্ত। বর যদি কনেকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে বিয়ে করেন, সেটা নামন্ত। আর বর বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে থেকে গেলে সেটিকে ঘরজামাই বিয়ে বলা হয়।
যে প্রকার বিয়েই হোক না কেন, আগের কালে একেকটি বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার ধাপ ছিল বিস্তর। যেমন-পাত্র-পাত্রী নির্বাচন, বৌ জোড়লী বা অলংকার চড়ানী, গদ গলানো, লগ্ন আনা, পানসল্লা, বরের তেলোয়াইদেয়া বা তেল চড়ানী, বর কনের সোহাগ ধরা, বৌ নামানী, হাইচধরা, কনের শ্বশুরবাড়ি যাত্রা, গৃহদেবতা পূজা, সিধা দেওয়া, ঢোল-বাদ্য এবং অনুসরণসহ বিহারে গিয়ে বুদ্ধপূজা, প্রদীপ পূজা ও ত্রিরত্ন বন্দনা, মঙ্গল সূত্র পাঠ, বিয়ে অনুষ্ঠান, বিয়ের মন্ত্র, সহমেলা, নবদম্পতি গোসল, নবদম্পতিকে গুরুজনের আশীর্বাদ গ্রহণ, বেয়াই ভাতা, মাটি হোঁড়ানী, পিণ্ডদান, ছোয়াইং তোলা, বৌভাত খাওয়া, মাড়ি হোরানী, ন দিন্যা যাওয়া, ফিরাইন্যা ভাত, বারমাসে তের ফল বেয়ার, মঙ্গলঘট, কলসির জল ভরান, বরকলা, বরকনের গায়ে হলুদ স্নান, ঘাটা ঘরা, পানমিটা, বরসজ্জা, কনে সজ্জা, ডুলিধরা, নতুন বধুকে ভাত তরকারী ও ধান দেখানো, বর বধুর ফুলশয্যা, নতুন জামাইর সালামী, বউ দেখা, রং ও ফুট খেলা, বর-কনের পিতা মাতার অনুমতি, স্ত্রী-পুরুষ স্বগ্রামী এবং ভিন্ন গ্রামীদের সান্ধ্য ভোজ, যৌতুকপ্রথা, ইত্যাদি।
হতে পারে কাজের সময়ে বিয়ে করতে গেলে অনেকটা সময় ব্যয় হত, তাই তৎকালীন সমাজপতিরা কিছু কিছু ঋতুকে বিয়ের জন্য নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন নানা কুসংস্কারের আশ্রয় নিয়ে। যেমন-পূর্বে প্রচলিত ছিল যে- বৈশাখ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, অগ্রহায়ণ ও মাঘ, এই সাত মাসে বিয়ে-শাদী অনুষ্ঠিত হলে সেই কন্যা- স্বামী ও শ্বাশুর পরিবারের জন্য শুভ ও মঙ্গলজনক হয়। এখানে জ্যৈষ্ঠ, কার্তিক, পৌষ, ফাল্গুন ও চৈত্রকে বিয়ের ঋতুর মধ্যে রাখা হয়নি। এদিকে সনাতন ধর্মে ভাদ্র ও চৈত্র মাসে বিয়ে হয় না। একই সংস্কার দেখা যায় ‘খিয়াং’ আদিবাসীদের সংস্কৃতিতেও। আগের দিনের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী নিজের জন্মমাসে বিয়ে করাও নাকি বারণ। জন্মমাসে বিয়ে করলে নাকি মহাদুঃখে পতিত হতে হয়।
বর্তমান কালেও বিয়ের ঋতু নিয়ে রয়েছে মতভেদ। কেউ কেউ গরমকালে বিয়ের পক্ষপাতি, তবে বেশিরভাগ মানুষই শীতকালকে বিয়ের ঋতু হিসেবে নির্ধারণ করে নিয়েছেন। আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিয়ের ঋতু নির্ধারণ করা হয়েছে বিভিন্ন কারণের ওপর ভিত্তি করে। যেমন-হাওর অঞ্চলে অর্থাৎ সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোণা ইত্যাদি জেলায় এপ্রিল মাসে পাহাড়ি ঢল বেয়ে পানি নামে। এর ফলে তাদের চাষাবাদের জমি চলে যায় পানির নিচে। সুতরাং এ ঋতুতে তারা হয়ে পড়েন বেকার। তখন যেহেতু কোনো কাজ থাকে না, তাই তারা এ ঋতুতে বিয়ে-শাদির বন্দোবস্ত করে থাকেন।
সম্প্রতি দেশের কিছু অঞ্চলে ঈদ-উল-আজহার পর পর বিয়ে করার প্রচলন ঘটেছে। এর কারণ- কোরবানির মাংস দিয়ে বিয়ের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা। ফলে বাড়তি খরচের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আবার ঈদ-উল-ফিতরের পরও বিয়ের আয়োজন হয়ে থাকে। এর কারণ মূলত ‘ছুটি’। জীবিকার তাগিদে ঢাকায় বসবাসকারী গ্রামের মানুষেরা ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যান। তখন গ্রাম হয়ে ওঠে লোকারণ্য। এ কারণেই বিয়েশাদির অনুষ্ঠান করা হয় ঈদের পর, যাতে অনুষ্ঠানে অধিক মানুষের সমাগম ঘটতে পারে।
বাংলাদেশে বেশিরভাগ জেলাতেই শীতকালকে বিয়ের ঋতু হিসেবে গণ্য করা হয়। আর এই ‘গণ্য’ করাকে পুঁজি করে বাণিজ্যিকমনস্ক মানুষ বিয়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট ঋতুকে প্রতিষ্ঠা করতে যেন মরিয়া হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর কথাই ধরা যাক। শীত এলেই ব্যাংকগুলোতে দেখা যায় বিয়ের ঋণ দেওয়ার ঘটা। এছাড়াও ওয়েডিং প্ল্যানার কিংবা ওয়েডিং ফটোগ্রাফারদের জন্য তো শীত ঋতু যেন আশীর্বাদ স্বরূপ। শীতকে বিয়ের ঋতু হিসেবে গণ্য করার ফলে দেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে।
বিউটি পার্লারগুলোর ব্যস্ততাও এ সময় ওঠে তুঙ্গে। শীতে ঠিক কতটা বিয়ের ধুম পড়ে সেই বিষয়ে জানতে প্রিয়.কম যোগাযোগ করেছিল ‘পারসোনা’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও রূপবিশেষজ্ঞ কানিজ আলমাস খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বিয়ের অনুষ্ঠান মূলত মানুষের জীবনযাত্রার ব্যস্ততার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের এখানে গ্রীষ্ম ও শীত এ দুই ঋতুতেই বিয়ের আয়োজনের ধুম পড়ে। বর্তমানে দেশের মানুষ তথা পরিবারগুলোর সময় অনেকটাই তাদের বাচ্চাদের স্কুলের সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলে। গ্রীষ্ম ও শীতে দুটি দীর্ঘ ছুটি পাওয়া যায়। তাই বাচ্চাদের এ ছুটিকে তারা কাজে লাগায়, বিয়ের অনুষ্ঠান করে এ দুই ঋতুতেই।’
‘একটা সময় ছিল যখন বিয়ের অনুষ্ঠান হতো খুবই সংক্ষিপ্ত পরিসরে। পাত্র-পাত্রী নির্ধারণ করে, দু-চারজন ব্যক্তির উপস্থিতিতে একজন কাজী ডেকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হত। কিন্তু এখনকার সময় ভিন্ন। এখন মানুষ একটি বিয়ের পেছনে অনেকগুলো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তারা চায়, তাদের সংসারের শিশুটিসহ সবাই যেন সেই বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করতে পারে। আর শীত ঋতুতে পরিবেশ যেহেতু ঠাণ্ডা থাকে, তাই এ ঋতুতে বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো করা অনেক সুবিধাজনক হয়,’ বলেন কানিজ।
‘পারসোনা’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপবিশেষজ্ঞ কানিজ আলমাস খান। ছবি: সংগৃহীত।
গ্রীষ্ম ও শীত ঋতু ছাড়া বছরের অন্যান্য ঋতুতে তাদের বিউটি পার্লারে বিয়ের কনেদের আগমন কেমন? -এমন প্রশ্নে কানিজ আলমাস খান বলেন, ‘ইমারজেন্সি কিছু বিয়ে তো হয়েই থাকে। মোটামুটিভাবে কিছু বিয়ের আয়োজন হয় গ্রীষ্ম ও শীত ব্যতীতও।’
বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বিয়ের ঋতু কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ? -এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে প্রিয়.কম যোগাযোগ করেছিল সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বর্তমান সভাপতি গোলাম কুদ্দুস এবং বাংলাদেশের একজন প্রগতিবাদী চিন্তাবিদ ও লেখক অধ্যাপক যতীন সরকারের সঙ্গে।
চিন্তাবিদ ও লেখক অধ্যাপক যতীন সরকার। ছবি: সংগৃহীত।
যতীন সরকার প্রিয়.কমকে বলেন, ‘গ্রামবাংলার মানুষ হিসেবে এবং জন্মসূত্রে হিন্দু সম্প্রদায়ের হওয়ার জন্য আমি যতদূর বলতে পারি, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা অনেক আগে থেকেই নানা প্রকার আচার ও রীতিনীতি পালন করে আসছে। সেসব প্রথার সবগুলো এখন পালিত না হলেও বিয়ের দিনক্ষণ কিংবা ঋতু নির্ণয়ের আচার এখনও বাদ দেয়নি। বিয়ের ক্ষেত্রে ব্রাহ্ম আচার মানা হয় এখনও। যেমন- বিশ্বাস করা হয় যে, আষাঢ় মাসে বিয়ে হলে কন্যা ধনধান্যে পরিপূর্ণ হবে। ঠিক তেমনই- শ্রাবণে মৃতবৎসা, ভাদ্রে বেশ্যা, আশ্বিনে মৃত্যু, কার্তিকে রোগাক্রান্ত, পৌষে আচার ভ্রষ্টা ও স্বামী বিয়োগিনী, চৈত্রে মদন উন্মুক্তা হয়ে থাকে। তাই এ ঋতুগুলো বিয়ের জন্য নিষিদ্ধ। বাকি থাকলো বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, অগ্রহায়ণ, মাঘ ও ফাল্গুন। জ্যৈষ্ঠ মাসে আবার বড় পুত্র বা বড় কন্যার বিয়ে দেওয়া নিষেধ। এদিকে বৈশাখ মাসে থাকে ঝড়-বাদল। সুতরাং, বিয়ের জন্য উপযুক্ত ঋতু থাকল- অগ্রহায়ণ, মাঘ ও ফাল্গুন। এই তিন ঋতুতে থাকে শীত। আর তাই আমাদের দেশে শীত ঋতুতে বিয়ের বিয়ের ধুম পরে যায়।’
‘এছাড়াও গ্রহ, নক্ষত্র ও তিথির হিসাব তো আছেই। শীতকালেই কেন বিয়ে হয়, এ বিষয়ে আমার মনে হয়- এ ঋতুগুলোতে খাবার নষ্ট হয় না, ভালো ভালো সবজি ওঠে এবং যাতায়াতেও সুবিধা থাকে বিধায় শীতকালকে বিয়ের জন্য উপযুক্ত মনে করা হয়। আমার জানামতে, মুসলমান মধ্যে বিয়ের ঋতু বলতে কিছুই নেই। তবে তারা বিয়ের ক্ষেত্রে শুক্রবার দিনটিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। আর শহরের কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে তো সারা বছর বিয়ে লেগেই থাকে,’ বলেন যতীন সরকার।
কিন্তু বিয়ের জন্য কোনো ঋতু নির্ধারণ সমর্থন করেন কি-না, এ প্রসঙ্গে যতীন সরকারের উত্তর, ‘এখানে আমার সমর্থনের কোনো বিষয় নেই।’
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বর্তমান সভাপতি গোলাম কুদ্দুস। ছবি: সংগৃহীত।
বিয়ের ঋতু আমাদের সংস্কৃতির অংশ কি-না এবং বিয়ের ঋতু সমর্থন করেন কি-না? -এ প্রশ্নের উত্তরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বর্তমান সভাপতি গোলাম কুদ্দুস প্রিয়.কমকে বলেন, ‘বিয়ের আবার ঋতু কী? আমাদের বাংলা সংস্কৃতিতে বিয়ের কোনো ঋতু নেই। কেউ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে যদি বিয়ের জন্য কোনো ঋতু নির্ধারিত করে, তাহলে সেটি আমাদের সংস্কৃতির বিরোধী। আমি মনে করি, বিয়ের কোনো ঋতু নেই। আর যদি থাকেও, সেটি আমি সমর্থন করি না।’
প্রিয় বিনোদন/গোরা
- ট্যাগ:
- বিনোদন
- বিয়ে
- গোলাম কুদ্দুছ
- 1. বাংলাদেশ