ছবি সংগৃহীত

শবে বরাত নিয়ে বাড়াবাড়ি এবং ছাড়াছাড়ি কোনটাই কাম্য নয়

মিরাজ রহমান
সাংবাদিক ও লেখক
প্রকাশিত: ১১ মে ২০১৭, ১১:২১
আপডেট: ১১ মে ২০১৭, ১১:২১

শবে বরাত নিয়ে বাড়াবাড়ি এবং ছাড়াছাড়ি কোনটাই কাম্য নয়। ছবি : সংগৃহীত

(প্রিয়.কম) বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশে শবে বরাতকে চিহ্নিত করার জন্য বেশ কিছু পরিভাষায় ব্যবহৃত হয়- এক. শবে বরাত। দুই. লাইলাতুল বরাত। তিন. লাইলাতুন নিসফ মিন শাবান। চার. লাইলাতুম মুবারাকাহ। প্রত্যেকটি পরিভাষাই ভিন্ন ভাষার বিধায় একটু ব্যাখ্যা বা পরিচতি কাম্য।

এক. শবে বরাত গোটা পরিভাষাটি ফারসি। ফারসি ভাষায় শব অর্থ হচ্ছে রাত বা রজনী আর বরাত অর্থ হচ্ছে ভাগ্য। সুতরাং ফারসি ভাষার এই পরিভাষার গোটা অর্থ হলো শবে বরাত মানে ভাগ্য রজনী।

দুই. লাইলাতুল বরাত বা বারাআত। এটি আরবি পরিভাষা। আরবিতে লাইলাতুন অর্থ হচ্ছে রাত বা রজনী এবং বরাত বা বরাআত অর্থ হচ্ছে পরিত্রান বা মুক্তি। সুতরাং আরবি এই পরিভাষার গোটা অর্থ হচ্ছে লাইলাতুল বরাআত মানে হচ্ছে পরিত্রাণ বা মুক্তির রজনী।

তিন. লাইলাতুন নিসফ মিন শাবান- এটিও মূলত একটি আরবি পরিভাষা। হাদিসে এই পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়েছে বলে মুহাদ্দিসিনরা মতামত ব্যক্ত করেছেন। লাইলাতুন অর্থ রাত। নিসফ অর্থ কোনো কিছুর মধ্য ভাগ আর মিন শাবান অর্থ হচ্ছে শাবান মাসের। সুতরাং লাইলাতুন নিসফ মিন শাবানের অর্থ হচ্ছে শাবান মাসের মধ্য রজনী।

চার. লাইলাতুম মুবারাকাহ। একটিও আরবি পরিভাষা। এটি মূলত পবিত্র কোরআনে ব্যবহৃত পরিভাষা। লাইলাতুন অর্থ রাত বা রজনী আর মুবারাকাহ অর্থ হচ্ছে বরকতপূর্ণ। এই পরিভাষাটির উদ্দেশিত সঠিক রাত কোনটি (শবে বরাত নাকি শবে কদর) সেটা নিয়ে মুফাসসিরিনদের মাঝে কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে। (মুফতী মিজানুর রহমান সাঈদ, কোরআন-হাদিসের আলোকে শবে বরাত, পৃষ্ঠা-১৮)

পরিভাষা যেটাই হোক শবে বরাত নিয়ে বর্তমানে বেশ বির্তকমণ্ডিত একটি অবস্থা বিরাজমান- সেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কেউ বলতে চাচ্ছেন শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত বলতে ইসলামে (কোরআন-হাদিসে) কিছুই নেই। আবার কোনো কোনো মুসলিম পক্ষ এই বক্তব্য কোনোভাবেই মেনে নিতে নারাজ যে শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত নামে ইসলামে কিছু নেই। এর মাঝামাঝি আরো একটি দল বা গ্রুপের অবস্থান রয়েছে যারা লাইলাতুল বরাতকেন্দ্রিক বিতর্কের কারণে কিছুটা মনক্ষুন্ন। চলুন তাহলে দেখি এর সমাধান আসলে কি?

প্রথম কথা হচ্ছে শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত নামে ইসলামে (কোরআন-হাদিসে) কোনো রাত থাকুন বা না থাকুন এবং এই রাতকেন্দ্রিক কোনো আমলের আলোচনা কোরআন-হাদিসে বর্ণিত হোক বা নাই হোক- এই বিষয়টি নিয়ে কোনো প্রকার দলাদলি, কোনো প্রকার কোনো বিতর্কিত অবস্থান গ্রহণ করা এবং এই উদ্দেশ্যে মুসলিম ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ বা লালন করা কোনো প্রকৃত মুসলিমের উচিত হবে না। পাশাপাশি শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত আছে বলে এই রাতে নানাবিধ কুসংস্কার বা বিদআতি কাজ-কারবারে লিপ্ত হওয়াও সঙ্গত হবে না। মোট কথা শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাতকেন্দ্রিক কোনো প্রকারের কোনো বাড়াবাড়ি এবং ছাড়াছাড়ি কোনোটাই কাম্য নয়। বাড়াবাড়ির পথটিও যেমন সঠিক না। ছাড়াছাড়ির মতটিও শুদ্ধ নয়। ইসলাম ভারসাম্যতার ধর্ম। ইসলামের সকল শিক্ষাই সরল পথের পথ নির্দেশ করে এবং বর্তমানে এসে শবে বরাতকেন্দ্রিক এই আলোচনাটিতে প্রকৃত মুসলিম হিসেবে খুবই ভারসাম্যশীল অবস্থান গ্রহণ করাই শ্রেয়। কী হবে সেই ভারসাম্যশীল অবস্থান?

শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাতের ব্যপারে সুষ্ঠু ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান হলো- এ রাতের ফজিলত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত এবং তা যুগ যুগ ধরে বুজূর্গানে দীন ও উলামাদের আমলের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য হয়ে আসছে। এই রাতে সম্মিলিত কোনো আয়োজন বা উৎসব জাতীয় কোনো আনুষ্ঠানিকতায় না গিয়ে অথবা এই রাতকে উদযাপনের বিশেষ কোনো পন্থা উদ্ভাবন না করে, এই রাতকেন্দ্রকি দলবদ্ধ ইবাদত-আয়োজন-বিদআতি কাজে লিপ্ত না হয়ে একাকি বা গোপনে বেশি বেশি ইবাদত-আমল করা উচিত এবং আল্লাহ মহানের কাছে বেশি বেশি তাওবা-উসতেগফার করা। আবার একইভাবে এই রাতকে অন্য সব সাধারণ রাতের মতো মনে করে অলসতায় কাটানো বা সাভারিকভাবে রাত্রি যাপন করা এবং এই রাতের ফজিলতের সব হাদিসকে দূর্বল বা জাল মনে করাও ঠিক না। আরো একটি বিষয় মাথার রাখা উচিত- শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাতকে শবে কদরের মতো বা তার চেয়েও বেশি গুরুত্ববহ ও ফজিলতপূর্ণ মনে করাও ভিত্তিহীন ধারণা।

শবে বরাত বিষয়ে হাদিসে এসেছে হজরত মুআয ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, নবি করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান, হা. ৫৬৬৫, আল মুজামুল কাবীর ২০/১০৯, শুআবুল ইমান, হদিস নং. ৬৬২৮)

হজরত আসিম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবি বকর তাঁর পিতার সনদে দাদা হযরত আবুবকর (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসুল সা. ইরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা শাবানের ১৫তম রাত্রে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং সকল পাপীকে (যারা ক্ষমা প্রার্থনা করে) ক্ষমা করে দেন। তবে মুশরিক (আল্লাহর সাথে সমকক্ষ সাব্যস্তকারী) ও মুশহিন (হিংসুক) ব্যতীত। (বায়হাকি ফি শুয়াবিল ঈমান হা. ৩৮৩৫)

হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.), আবু সালাম আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা), আবু মুসা আশআরী (রা.) আবু হুরায়রা (রা.), আবুবকর (রা.),আউফ ইবনে মালিক (রা.) ও হজরত আয়েশা (রা) সকলেই এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। হাদিসবিশারদগণ উক্ত হাদিসের রাবীদেরকে ছেক্বাহ তথা বিশ্বস্ত বলেছেন। মূল কথা হাদিসটি ‘সহীহ’। (সহী ইবনে হিব্বান, আত তারগীব ওয়াত তারহীব ২ খণ্ড:পৃঃ ১১৮, মাজমাউল ফাওয়ায়ীদ খণ্ড ৮,পৃ. ৬৫, মুসনাদে বাযযার,খণ্ড ৮.পৃ. ৬৭)

এই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ মুফতি আব্দুল মালেক লিখেছেন, ‘বিশুদ্ধ মতানুসারে এ রাতের নফল আমলসমূহ সম্মিলিত নয়, ব্যক্তিগতভাবে একাকী পালনীয়। ফরজ নামাজ তো অবশ্যই মসজিদে আদায় করতে হবে। এরপর যা কিছু নফল পড়ার তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়াই উত্তম। এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার কোনো প্রমাণ হাদিস শরিফেও নেই আর সাহাবায়ে কেরামরে যুগেও এর রেওয়াজ ছিল না। (ইক্তিযাউস সিরাতিল মুসতাকীম ২/৬৩১-৬৪১; মারাকিল ফালাহ ২১৯) অবে কোন আহবান ও ঘোষণা ছাড়া এমনিই কিছু লোক যদি মসজিদে এসে যায়, তাহলে প্রত্যেকে নিজ নিজ আমলে মশগুল থাকবে, একে অন্যের আমলের ব্যাঘাত সৃষ্টির কারণ না হয় তবে তাতে কোনো সমস্যা নেই। কোন কোন জায়গায় এই রেওয়াজ আছে যে, এ রাতে মাগরিব বা ইশার পর থেকেই ওয়াজ-নসীহত আরম্ভ হয়। আবার কোথাও ওয়াজের পর মিলাদ-মাহফিলের অনুষ্ঠান হয়। কোথাও তো সারা রাত খতমে-শবীনা হতে থাকে। উপরন্তু এসব কিছুই করা হয় মাইকে এবং বাইরের মাইকও ছেড়ে দেওয়া হয়। মনে রাখতে হবে, এসব কিছুই ভুল রেওযাজ। শবে বরাতের ফাজায়েল ও মাসায়েল আগেই আলোচনা করা যায়। এ রাতে মাইক ছেড়ে দিয়ে বক্তৃতা-ওয়াজের আয়োজন করা ঠিক না। এতে না ইবাদতে আগ্রহী মানুষের পক্ষে ঘরে বসে একাগ্রতার সাথে ইবাদত করা সম্ভব হয়, আর না মসজিদে। অসুস্থ ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় আরামেরও মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। এসব বিষয়গুলো অনুচিত।’ 

শবে বরাতের পরের দিন রোজা রাখা সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছে- হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, পনের শাবানের রাত (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোজা রাখ। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোন ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিযিক প্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দেব। এভাবে সুব্হে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদের ডাকতে থাকেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ১৩৮৪) এই বর্ণনাটির সনদ যয়ীফ। কিন্তু মুহাদ্দিসীন কেরামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হল, ফাজায়েলের ক্ষেত্রে যয়ীফ হাদিস গ্রহণযোগ্য। সুতরাং এই হাদিসের ওপর আমল করার নিয়তে রোজা রাখা যেতে পারে। এছাড়া শাবান মাসে বেশি বেশি নফল রোজা রাখার কথা সহিহ হাদিসে এসেছে এবং আইয়ামে বীয অর্থাৎ প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখার বিষয়টিও সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। বলা বাহুল্য, পনের শাবানের দিনটি শাবান মাসেরই একটি দিন এবং তা আয়্যামে বীযের অন্তর্ভূক্ত। মোটকথা শবে বরাতের নিয়তে বা আইয়্যামে বীযের নিয়তে শাবান মাসের এই সময়টিতে নফল রোজা রাখা যেতে পারে বলে ওলামাগণ মতামত ব্যক্ত করেছেন।

তবে লক্ষ্যনীয় হলো এই রাত উপলক্ষে আপত্তিকর কাজকর্ম খিচুরী বা হালুয়া-রুটির প্রথা, মসজিদ, ঘর-বাড়ি বা দোকান-পাটে আলোক-সজ্জা, পটকা ফুটানো, আতমবাজি, কবরস্থান ও মাজার সমূহে ভিড় করা, মহিলাদের ঘরের বাইরে যাওয়া, বিশেষ করে বেপর্দা হয়ে দোকানপাট, মাজার ইত্যাদি স্থানে ভিড় করা, এসব কিছুই করা যাবে না বা করা উচিত না। এসব কাজের কোন কোনটা তো অন্য সময়েও হারাম। আর কিছু কাজ সাধারণ অবস্থায় জায়েজ থাকলেও এগুলোকে শবে বরাতের কাজ মনে করা বা জরুরি মনে করা এবং এসবের পেছনে পড়ে এ রাতের মূল কাজ তওবা, ইস্তেগ্ফার, নফল ইবাদত ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত থাকার কোন বৈধতা থাকতে পারে কি? এসব কিছুই শয়তানের ধোকা। মানুষকে আসল কাজ থেকে বিরত রাখার জন্যই শয়তান এসব কাজ-কর্মে মানুষকে লাগিয়ে রাখে। 

সম্পাদনা: গোরা