ছবি সংগৃহীত

কিংবদন্তি নির্মাতার যত অমর সৃষ্টি

শামীমা সীমা
সহ সম্পাদক
প্রকাশিত: ১৩ নভেম্বর ২০১৬, ১০:৫৯
আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৬, ১০:৫৯

(প্রিয়.কম) ‘হুমায়ূন আহমেদ’ নামটি সেই আশির দশকে লেখা হত বইয়ের মলাটে। কিছুদিন বাদেই তিনি টেলিভিশন নাটকে নাট্যকার হিসেবে আবির্ভূত হন। একে একে অসংখ্য জনপ্রিয় নাটক রচনা ও পরিচালনা করার পর তাকে পেয়ে বসে সেলুলয়েডে অমর হবার নেশা। যার ফলাফলে নব্বই দশকের শুরুর দিকে রুপালি পর্দায় মুক্তি পায় হুমায়ূন আহমেদ রচিত ও পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রেমের ছবি ‘আগুনের পরশমনি’। এর পর আর থেমে থাকে নি এই জগতে তার পথচলা। একে একে নির্মাণ করেন আটটি চলচ্চিত্র। মৃত্যুর পরেও যা তাকে অমর করে রেখেছে সেলুলয়েডের ফিতায়।

১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর আজকের দিনে জন্ম নেন প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ। আজ এই প্রয়াত লেখকের ৬৮ তম জন্মদিন। ২০১২ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে তিনি যেমন জনপ্রিয় ছিলেন, তেমনি চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও সমান খ্যাতি পান দর্শক মহলে। প্রায় দুইশোটির মত উপন্যাস লেখার পাশাপাশি টিভি নাটক নির্মাণ করেন তিনি। সেই সঙ্গে চালিয়ে যান সিনেমা নির্মাণ। হুমায়ূন আহমেদের মধ্যে চলচ্চিত্র নির্মাণের আগ্রহ তৈরি হয় নব্বই দশকের প্রথমদিকে। চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে তার আগ্রহ আর সীমাহীন স্বপ্ন ছিল জীবনের শেষভাগেও। মোট ৮টি ছবি নির্মাণ করে গেছেন তিনি। এই ৮টি ছবি হলো- `আগুনের পরশমনি', `শ্রাবণ মেঘের দিন', `দুই দুয়ারী', `চন্দ্রকথা', `শ্যামলছায়া', `নয় নম্বর বিপদসংকেত',`আমার আছে জল' আর `ঘেটুপুত্র কমলা'। সর্বশেষ তিনি নির্মাণ করেন ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ ছবিটি। ২০১২ সালে তার মৃত্যুর পর ৭ সেপ্টেম্বর ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়।

হুমায়ূন আহমেদের নিজের তৈরি ৮টি ছবি ছাড়াও তার উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু ছবি। এসব ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মুস্তাফিজুর রহমান পরিচালিত ‘শঙ্খনীল কারাগার’, সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘আবদার’ মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত ‘দূরত্ব’ ও ‘প্রিয়তমেষু’, শাহ আলম কিরণ পরিচালিত ‘সাজঘর’, আবু সাইয়ীদ পরিচালিত ‘নিরন্তর’, বেলাল আহমেদ পরিচালিত ‘নন্দিত নরকে’, তৌকির আহমেদ পরিচালিত ‘দারুচিনি দ্বীপ’, মেহের আফরোজ শাওন পরিচালিত ‘কৃষ্ণপক্ষ’।

আজ নন্দিত এই তারকার জন্মদিনে দেখে নিতে পারেন তার নির্মিত আটটি চলচ্চিত্র-

আগুনেরপরশমনি (১৯৯৪)
আগুনের পরশমণি ছবিটি ১৯৯৪ সালের বাংলাদেশী স্বাধীনতা যুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র। তার নিজের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে এটিই তার পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এটিতে অভিনয় করেছেন বিপাশা হায়াত, আবুল হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর ডলি জহুর সহ আরো অনেকে। চলচ্চিত্রটি ১৯৯৮ সালে ৮ টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পায়।
https://youtu.be/Xd2ywbYCrCM

শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯)
হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত দ্বিতীয় চলচ্চিত্র। প্রেম নির্ভর এ চলচ্চিত্রে জাহিদ হাসান, মাহফুজ আহমেদ এবং শাওন অভিনয় করেন। এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ নতুন আরেকটু পরিচয়ে পরিচিত হন – গীতিকার। ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ শিরোনামে সুবীর নন্দীর গাওয়া গানটির গীতিকার হুমায়ূন আহমেদ। এই চলচ্চিত্রটিও ছয়টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে। বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের কাহিনী আর সঙ্গীত প্রধান এ ছবিটি দেখতে সেসময় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দর্শক সিনেমাহলে ভিড় জমায়।

https://youtu.be/NBZJyKQnYsk

দুইদুয়ারী (২০০১)
এই চলচ্চিত্রটি হুমায়ূনের অন্য দুই চলচ্চিত্রের থেকে একটু আলাদা – একটি পরিবারে একজন রহস্য মানবের আগমন ও প্রভাবে বিভিন্নরকম কর্মকাণ্ড নিয়ে ছবিটি নির্মিত। এর আগের দুটো চলচ্চিত্রে প্রধাণত টিভি অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয় করলেও এই ছবিতে বাণিজ্যিক ধারার অন্যতম নায়ক রিয়াজ অভিনয় করেন। দুই দুয়ারী মোট তিনটি ক্যাটাগরীতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে।

https://youtu.be/T1RAzywlcB0

চন্দ্রকথা (২০০৩)
নির্মাতার চতুর্থ ছবি চন্দ্রকথার প্রধান চরিত্র চন্দ্রের মাধ্যমে দুর্বলের প্রতি সবলের ক্ষমতার প্রয়োগ, সামাজিক অবিচার প্রভৃতি তুলে ধরেন হুমায়ূন আহমেদ। প্রথম চলচ্চিত্রের প্রধান অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর আবারও হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্রে হাজির হন চন্দ্রকথা-র মাধ্যমে। এই চলচ্চিত্রের প্রায় সবগুলো গানই হুমায়ূন আহমেদ রচনা করেন। পুরনো দিনের জমিদারদের কঠোর মনোভাব, বিলাসিতা আর শিল্পকর্মের প্রতি গভীর অনুরাগ ছবিটিতে তুলে ধরা হয়। এছবিতে হুমায়ূন আহমেদ একই সঙ্গে তুলে ধরেন মানবতা আর নিষ্ঠুরতা।

এতে অভিনয় করেন ফেরদৌস, শাওন, চম্পা, আসাদুজ্জামান নূর, আহমেদ রুবেল,  স্বাধীন খসরু, ডা. এজাজুল ইসলাম ও আরো অনেকে।

https://youtu.be/XMcRY4Z2ai4
শ্যামল ছায়া (২০০৪)
শ্যামল ছায়া চলচ্চিত্রের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ আবারও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে ফিরে যান। এই ছবিতে বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে যুক্ত হয় হুমায়ূন ফরীদির অভিনয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একটি নৌকায় বিভিন্ন ধর্মের এবং পরিচয়ের একত্রিত যাত্রার ছবি তুলে ধরেন হুমায়ূন আহমেদ। পাশাপাশি তুলে ধরা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব গাঁথা।

এতে অভিনয় করেন রিয়াজ, শাওন, হুমায়ূন ফরীদি, তানিয়া আহমেদ, চ্যালেঞ্জার, ডা. এজাজুল ইসলাম প্রমুখ। বিশ্ব চলচ্চিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার অস্কারে বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগের প্রতিযোগিতায় সে বছর বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে হুমায়ূন আহমেদের শ্যামল ছায়া।
https://youtu.be/NdGA2mCjqXA
নয় নম্বর বিপদ সংকেত (২০০৭)
হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে নয় নম্বর বিপদ সংকেত সবচেয়ে নিস্প্রভ এবং বাণিজ্যিক। তিনি কেন এই চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন সেটা দর্শকের কাছে বোধগম্য নয়, তবে ছবির টাইটেলে ‘একটি অর্থহীন মুভি’ হিসেবে স্বীকৃতি দর্শককে বিভ্রান্ত করে ভালোভাবেই। এই ছবির মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদের নাম শিল্প নির্দেশক ও নৃত্যপরিচালকের খাতায় অন্তর্ভূক্ত হয়।

একজন ধনাঢ্য বয়স্ক ব্যক্তি হঠাৎ করে তার আপনজনদের কাছে পেতে চান। তাদের এক করা তার জন্য হয়ে উঠে কঠিন। সবাইকে তার মৃত্যুসংবাদ দিয়ে একত্রিত করা হয়। এরপর ঘটতে থাকে একের পর এক মজার মজার ঘটনা। সম্পূর্ণ বিনোদনধর্মী এছবিতে অভিনয় করেন  রহমত আলী, তানিয়া আহমেদ, রুপক, মিঠু, ডা. এজাজ আহমেদ, ফারুক আহমেদ প্রমুখ।

https://youtu.be/wFSDPmNMLfI

আমার আছে জল (২০০৮)
হুমায়ূন আহমেদের পাঠক নন্দিত উপন্যাস ‘আমার আছে জল’। নুহাশ চলচ্চিত্রের প্রযোজনায় এছবির কাহিনী, সংলাপ, চিত্রনাট্য, গীতরচনা, শিল্পনির্দেশনা ও পরিচালনা করেছেন হুমায়ূন আহমেদ নিজেই। সিলেটের মনোরম লোকেশনে চিত্রায়িত এছবিতে একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা অবকাশযাপন আর ত্রিভুজ প্রেমের গল্প তুলে ধরা হয়।

ছবিটিতে অভিনয় করেন বিদ্যা সিনহা মিম, ফেরদৌস, জাহিদ হাসান, শাওন, পীযূষ বন্দোপাধ্যায়, সালেহ আহমেদ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, মুনমুন আহমেদ, এজাজুল ইসলাম, মুনিরা মিঠু, মাজনুন মিজান, পুতুল, রুদ্র, ওয়াফা প্রমুখ। ২০০৮ সালে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ছবি ‘আমারআছেজল’ দু’টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভকরে।

https://youtu.be/BXtFB8Lsx0M

ঘেটুপুত্র কমলা (২০১২)
হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত সর্বশেষ ছবি ‘ঘেটুপুত্র কমলা’। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রযোজিতএ ছবিটি মুক্তির আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন এই ছবির নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ। তবে আমেরিকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০ দিনের জন্য বাংলাদেশে এসে বন্ধুদের নিয়ে ছবিটি দেখেন হুমায়ূন আহমেদ। ছবিটির মহরতে হুমায়ূন আহমেদ ঘোষণা দিয়েছিলেন, এটি হবে তার শেষ ছবি। তাৎক্ষণিকভাবে অনেকে তাকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদের ঘোষণাই সত্য হয়।

৫০ বছর আগের সুনামগঞ্জের ভাটিঅঞ্চলের জুলসুকা গ্রাম নিয়ে ছবিটির পটভূমি। সেসময় ভাটিঅঞ্চলের অভিজাত লোকেরা বালকদের নারী সাজিয়ে নাচ-গানের মাধ্যমে বিলাসিতা করতো। তাদের নাম ছিল ঘেটুপুত্র। অভিজাত মানুষের বিনোদনের খোরাক এইসব ঘেটুপুত্রের জীবনবঞ্চনার গল্প নিয়েই ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ ছবিটি তৈরি করেন হুমায়ূন আহমেদ। ছবির নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন কিশোর শিল্পী মামুন। আরো অভিনয় করেছেন তারিক আনাম খান, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, তমালিকা কর্মকার, প্রাণ রায়, কুদ্দুস বয়াতি, জুয়েল রানা, শামীমা নাজনীন সহ অনেকেই।

https://youtu.be/gVvcblDXEwk

সম্পাদনা: গোরা