
ছবি সংগৃহীত
সিডিআর প্রদানে বিটিআরসির নির্দেশ মানছে না অপারেটররা
আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৭, ১৬:৫৩
(প্রিয়.কম) কল ডিটেইলস রেকর্ড (সিডিআর) প্রদানে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন অ্যান্ড রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) নির্দেশনা থাকলেও তা মানছে না দেশের মোবাইল ফোন অপারেটররা। আর এই কারণে নিজের কল লিস্টের তালিকার জন্য আবেদন করতে গ্রাহকসেবা কেন্দ্রে গিয়ে বা কল সেন্টারে ফোন করেও ভোগান্তি কমছে না গ্রাহকদের।
এমনকি মোবাইল ফোন সেবা দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রাহক সেবা প্রতিনিধিরাও জানেন না এই বিষয়ে বিটিআরসির কোনো নির্দেশনা আছে কিনা।
ইনকামিং কলের তথ্য না পাওয়া প্রসঙ্গে আফসানা নামের এক ব্যবহারকারীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হলে তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার স্বামী কানাডা প্রবাসী। সম্প্রতি আমাকে তিনি কানাডায় যাওয়ার জন্য বললে আমি বাংলাদেশের কানাডিয়ান অ্যাম্বাসিতে যোগাযোগ করি। তখন অ্যাম্বাসিতে আমি ভিসা’র জন্য আবেদন করি। এরপর অ্যাম্বাসি থেকে আমার স্বামী কানাডায় থাকে তার প্রমাণ চাইলে, আমি তার সঙ্গে আমার মোবাইল ফোনের কথোপকথনের কথা বলি। তখন তারা প্রমাণস্বরূপ আমার কাছে ফোনের কল লিস্ট চায়।
এরপর আমি গ্রামীণফোন কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগ করলে তারা আমাকে শুধু আউটগোয়িং কলের লিস্ট দেয়। কিন্তু আমি যেহেতু বাংলাদেশ থেকে তাকে ফোন করতাম না, তাই সেই আমাকে কানাডা থেকে ফোন করতো। তাই সম্পূর্ণ রেকর্ড ইনকামিং লিস্টে। তাই আমি কাস্টমার কেয়ারে ইনকামিং কলের লিস্ট চাইলে তারা তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে।
একই অভিযোগ করে মাসুম রেজা নামের আরেক ব্যবহারকারী বলেন, কল লিস্টের জন্য রবি’র কল সেন্টারে ফোন করেছিলাম, নয় মিনিট অপেক্ষা করে একজন প্রতিনিধি ফোন ধরলো। এরপর তিনি জানালেন তারা নাকি ইনকামিং কল লিস্ট দেন না। তার সঙ্গে মোট কথা হয় আরও তিন থেকে চার মিনিট। আমারতো এই ১৩ মিনিট কথা বলা আর খরচ করাটাই বৃথা।
কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধিদের কাছে সঠিক নির্দেশনা না থাকায় ইনকামিং কল লিস্ট পেতে গ্রাহকদের ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। অপরদিকে সম্পূর্ণ কল লিস্ট প্রদানে সরকারি আদেশ থাকা সত্বেও তা মানছে না অপারেটররা।
বিটিআরসি সুত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বিটিআরসির ২০১তম সভায় কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান কর্তৃক নিজ নম্বরের সিডিআর প্রাপ্তি প্রসঙ্গে বিস্তারিত কার্যপত্র উপস্থাপন করা হয়। ওই সভায় এই বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং বাস্তবায়ন করতে বিটিআরসির সিস্টেম এন্ড সার্ভিস বিভাগকে দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তীতে ৮ ফেব্রুয়ারি বিটিআরসির সিস্টেম এন্ড সার্ভিস বিভাগের পরিচালক লে. কর্ণেল মো. জুলফিকারের স্বাক্ষরিত এক কার্যপত্রে সিডিআর প্রদান প্রসঙ্গে মোবাইল ফোন অপারেটরদেরকে একটি নির্দেশনা প্রদান করে নিয়ন্ত্রণ কমিশন।
নির্দেশনায় বলা হয়, সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে যে মোবাইল ফোন গ্রাহকরা পারিবারিক ও ব্যবসায়িকসহ নানাবিধ কারণে তাদের কললিস্ট তথা ইনকামিং ও আউটগোয়িং কলের তালিকা চেয়ে সংশ্লিষ্ট অপারেটরের কাস্টমার কেয়ার সেন্টারগুলোয় আবেদন করলে মোবাইল ফোন অপারেটররা তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। তারা শুধু আইটেমওয়াইজ বিলের তালিকা দেয়া হয়।
কার্যপত্রের নির্দেশনা অনুযায়ী, কোন গ্রাহক তার নিজের কল ডিটেইলস রেকর্ড (সিডিআর) চেয়ে আবেদন করলে আবেদনের তারিখ হতে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে এই তথ্য প্রদান করার কথা বলা হয়। একইসঙ্গে এই সিডিআরের জন্য আবেদনের তারিখ থেকে পূর্ববর্তী ৬০ দিনের ইনকামিং ও আউটগোয়িং কল, কলগুলোর সময়, তারিখ, স্থায়িত্ব এবং এসএমএসের তথ্য দেওয়ার নির্দেশনাও দেয় বিটিআরসি।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়, সিডিআরপ্রাপ্তির আবেদনের ক্ষেত্রে গ্রাহককে বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন-সংক্রান্ত কাগজপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র ও চালু সিমসহ সংশ্লিষ্ট অপারেটরের কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে হাজির হতে হবে। কাস্টমার কেয়ার সেন্টার সিমের মালিকানা যাচাই করে আবেদন গ্রহণ করবে।
সিডিআর প্রসঙ্গে বিটিআরসির নির্দেশনা।
সরেজমিনে দেখা যায়, কার্যপত্রের নির্দেশনা কাগজ পর্যন্তই রয়ে গেছে। কারণ, নির্দেশনা প্রদানের সময় প্রায় তিন মাস হয়ে এলেও তা আমলে নেয়নি মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো। এই বিষয়ে দেশের বৃহৎ মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোনের কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধি রায়হান জানান, সিডিআর পেতে একজন প্রিপেইড ব্যবহারকারীর আবেদনের প্রেক্ষিতে ১১৫ টাকা সার্ভিস চার্জের মাধ্যমে ৬০ দিনের আউটগোয়িং কলের বিস্তারিত এবং পোস্টপেইডের গ্রাহকের ক্ষেত্রে ৬ মাসের ইনকামিং কলসহ আউটগোয়িং কলের তথ্য পাওয়া যাবে। তবে প্রিপেইড গ্রাহকগণ ইনকামিং কল বা এসএমএসের কোন তথ্য পাবেন না।
বাংলালিংকের কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধি আফরোজা জানান ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, প্রিপ্রেইড গ্রাহকরা অনলাইনে ১০ দিনের সিডিআর দেখতে পারবেন। তবে শুধুমাত্র পোস্টপেইড গ্রাহকরাই ৬০ দিনের এই কল লিস্টের তথ্য পেতে পারেন।
রবি’র কাস্টমার কেয়ারের প্রতিনিধি মোহাইমেন জানালেন আরেক তথ্য। তিনি বলেন, কোনভাবেই ইনকামিং কল ও এসএমএস এবং দুই মাসের তথ্য দেয়া যাবে না। তবে ‘প্রিপেইড বিল.রবি.কম.বিডি’ এই লিংকে গিয়ে নির্দিষ্ট নম্বর রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে ভ্যাট ও এসএসডি চার্জসহ ৫০ টাকা পরিশোধের মাধ্যমে একমাসের আউটগোয়িং কল ও এসএমএসের তথ্য পাওয়া যাবে।
প্রত্যেক অপারেটরের কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধিকে সিডিআর সংশ্লিষ্ট বিটিআরসির দেয়া নির্দেশনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, আমাদেরকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যেই নির্দেশনা দিয়েছেন তা আপনাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এর বাইরে আমরা কিছু জানি না।
এই বিষয়ে গ্রামীণফোনের এক্সটার্নাল কমিউনিকেশন্সের ডেপুটি ডিরেক্টর সৈয়দ তালাত কামাল প্রিয়.কমকে বলেন, এখন আমরা আমাদের পোস্টপেইড গ্রাহকদের সম্পূর্ণ সিডিআর সেবা দিতে পারছি। যদিও তা প্রিপ্রেইড গ্রাহকদের ক্ষেত্রে বর্তমানে শুধু মাত্র চার্জড আইটেমের (গ্রাহকের নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে খরচ হয় এমন সেবা) সিডিআর দিতে সক্ষম। তবে ইনকামিং কল ও এসএমএসের মতো বিনামূল্যের সার্ভিস এই সিডিআরের অন্তর্ভূক্ত না। আর আমরা আসলে খরচ হচ্ছে না এমন কোন রেকর্ড সিস্টেমে রাখতে পারছি না। তাই চার্জ আইটেম হিসেবে আমরা শুধু আউওটগোয়িং কল লিস্টটাই দিতে পারছি।
তিনি আরও বলেন, গ্রাহকদেরকে এই সুবিধা আমরা বিটিআরসির নির্দেশনা পাওয়ার আগে থেকেই দিচ্ছি। তবে নতুন নির্দেশনা পাওয়ার পর থেকে আমরা সিস্টেম আপডেট করছি। খুব শীঘ্রই হয়তো এই সার্ভিসটাও আমরা প্রিপ্রেইড গ্রাহকদের দিতে পারব।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে আরেক অপারেটর বাংলালিংকের এক কর্মকর্তা বলেন, বিটিআরসির ওই নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের টিম কাজ করছে। আর যেহেতু সিডিআরের ক্ষেত্রে গ্রাহকের প্রাইভেসির ব্যাপার থাকে, তাই সিডিআর আবেদনকারী আসলেই ওই গ্রাহক কিনা সেটা যাচাইয়ের জন্যও নতুন সিস্টেম তৈরি করছে বাংলালিংক। তাই একটু সময় লাগছে। তবে অতি শীঘ্রই গ্রাহকরা এই সেবা বাংলালিংকের কাছ থেকে পাবেন।
এই বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিটিআরসির চেয়ারম্যান ড. শাজাহান মাহমুদ প্রিয়.কমকে বলেন, সিডিআর নিয়ে গ্রাহকদের এই সমস্যাটা আমাদের আসলে জানা ছিল না। আর এখন পর্যন্ত কেউ লিখিত কোন অভিযোগও দেয়নি। কেউ অভিযোগ করলে নিশ্চই আমরা এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।
যেসব অপারেটররা নির্দেশনা দেওয়ার পরেও মানছে না, তাদের বিষয়ে কমিশন যথাযত আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানান বিটিআরসির চেয়ারম্যান।
প্রিয় টেক/কামরুল