
প্রতীকী ছবিটি এআই-এর সহায়তায় তৈরি করা হয়েছে
অবহেলা আর সংকটে গ্রামীণ মাতৃস্বাস্থ্য
আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ১৭:১২
২০২৪ সালের ১৪ মার্চ সাতক্ষীরায় সন্তান প্রসবের পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান সাফজয়ী নারী ফুটবলার রাজিয়া খাতুন। সন্তান প্রসবের প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পরই নিভে যায় মাত্র ২৫ বছর বয়সী এই তরুণীর প্রাণ। মাঠে দেশকে জয় এনে দেওয়া রাজিয়ার মৃত্যু যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, প্রসব এখনো কীভাবে গ্রামীণ নারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা।
অবকাঠামো আছে, কিন্তু ডাক্তার নেই
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে ধাপে ধাপে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী গ্রামীণ স্বাস্থ্য অবকাঠামো। কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন সাবসেন্টার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল—সব মিলিয়ে এক সুবিন্যস্ত নেটওয়ার্ক। করোনা মহামারির সময় এ নেটওয়ার্কের কার্যকারিতা আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে।
কিন্তু সেই শক্তিশালী কাঠামো কার্যকর হচ্ছে না জনবল সংকটে। সরকারি হিসাবেই দেশে প্রায় ১০ হাজার চিকিৎসকের পদ শূন্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য অন্তত ১০ জন চিকিৎসক থাকা উচিত, অথচ বাংলাদেশে আছে মাত্র ৬.৩ জন। শহরের ৬৭ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক পাওয়া গেলেও গ্রামে এ হার মাত্র ২৫ শতাংশ। ফলে উপজেলা হাসপাতালগুলোতে একদিকে এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাফির মতো যন্ত্র আছে, অন্যদিকে সেগুলো চালানোর মতো বিশেষজ্ঞ নেই।
মাতৃমৃত্যুর সংখ্যায় দ্বন্দ্ব
১৯৯০ সালে প্রতি লাখ জীবিত জন্মে ৫৭৪ জন মায়ের মৃত্যু হতো। দুই দশক ধরে ধাপে ধাপে এই হার কমে এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব বলছে, সর্বশেষ মাতৃমৃত্যুর হার ১৫৩। তবে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল বলছে, হার ১২৩। কোন সংখ্যা সঠিক, তা নিয়ে নীতিনির্ধারকেরা বিভ্রান্ত। তবে বাস্তবতা হলো—প্রতিদিনই রাজিয়ার মতো কেউ না কেউ মারা যাচ্ছেন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, খিঁচুনি ও অনিরাপদ গর্ভপাতই প্রধান কারণ।
অদক্ষ ধাত্রীর হাতে প্রসব
বাংলাদেশে এখনো প্রায় ৮০ শতাংশ প্রসব হয় বাড়িতে। এর ৯০ শতাংশই ঘটে অদক্ষ ধাত্রীর হাতে। এ কারণেই প্রসবকালীন জটিলতার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। দূরত্ব, যাতায়াত খরচ, চিকিৎসক সংকট আর কুসংস্কারের কারণে অনেক পরিবার গর্ভবতী নারীকে হাসপাতালে নিতে চায় না। ফলে অদক্ষ ধাত্রীর ওপর নির্ভরশীলতা প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে।
“চরম অবহেলা”
স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন ওজিএসবি–র সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম বলেন, “রাজিয়ার মৃত্যু হয়েছে চরম অসচেতনতা ও অবহেলার কারণে। সরকার, দাতা সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা—সবার মাতৃস্বাস্থ্যের প্রতি যথাযথ নজর দেওয়া উচিত। শূন্যপদে দ্রুত চিকিৎসক নিয়োগ, গ্রামে কাজের জন্য আর্থিক-সামাজিক প্রণোদনা, মিডওয়াইফদের ক্ষমতায়ন, প্রতিটি উপজেলায় ২৪ ঘণ্টা জরুরি প্রসূতি সেবা, রক্তব্যাংক ও অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।”
সম্ভাবনার আলো
সমাধানের পথও আছে। প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফরা মা ও নবজাতকের প্রায় ৯০ শতাংশ সেবার চাহিদা পূরণ করতে পারেন। গবেষণা বলছে, শুধু মিডওয়াইফ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করলেই মাতৃমৃত্যু ৪০ শতাংশ কমানো সম্ভব। সরকার ইতোমধ্যে কয়েক হাজার মিডওয়াইফ নিয়োগ দিয়েছে। একইভাবে টেলিমেডিসিন ও মোবাইল ক্লিনিক চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে গ্রামীণ নারী দূর থেকেও বিশেষজ্ঞের পরামর্শ পান। তবে নেটওয়ার্ক সমস্যা ও ফোনের অভাব বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
সংকটের প্রতিচ্ছবি
রাজিয়া খাতুনের মৃত্যু শুধু একজন ফুটবলারের গল্প নয়, এটি পুরো গ্রামীণ মাতৃস্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। অবকাঠামো আছে, কিন্তু মানবসম্পদ নেই। হাসপাতাল আছে, কিন্তু সেবা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যত দিন না আস্থা ফিরবে, যত দিন না সচেতনতা বাড়বে, তত দিন রাজিয়ার মতো আরও বহু তরুণীর জীবন ঝরে যাবে।