গ্রামীণ এলাকায় নারীর স্বাস্থ্যসেবা এখনও সহজলভ্য নয়। অলংকরণ: লাবিব হাসান

প্রসবকালীন স্বাস্থ্যঝুঁকি: গ্রামীণ নারীদের চিকিৎসা সংকট

তানজিল রিমন
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৯ আগস্ট ২০২৪, ১৮:৩৬
আপডেট: ২৯ আগস্ট ২০২৪, ১৮:৩৬

২০২৪ সালের ১৪ মার্চ সাতক্ষীরায় সন্তান প্রসবের পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান সাফজয়ী নারী ফুটবলার রাজিয়া খাতুন। মাত্র ২৫ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, গোটা সমাজের জন্য বেদনাদায়ক ঘটনা। মাঠে দেশকে গৌরবান্বিত করা রাজিয়ার জীবন এমনভাবে ঝরে যাওয়া যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, গ্রামীণ নারীরা এখনো প্রসবজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে জর্জরিত।

রাজিয়ার মৃত্যুর পর নতুন করে আলোচনায় আসে প্রসবকালীন চিকিৎসাসেবা বিষয়টি। বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা বলছেন, অবহেলার কারণেই রাজিয়ার মৃত্যু হয়েছে। এমন ঘটনা নতুন নয়। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও এমন মৃত্যু হচ্ছে। স্বাস্থ্য অবকাঠামো আছে, কিন্তু কার্যকর সেবা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যত দিন না আস্থা ফিরবে এবং যথাযথ জনবল ও সচেতনতা নিশ্চিত হবে, তত দিন রাজিয়ার মতো আরও বহু নারীকে প্রাণ হারাতে হবে।

মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণগুলো হলো-

অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ: প্রসবের সময় বা পরপর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ সবচেয়ে বড় কারণ। এটি প্রতিরোধযোগ্য, যদি সময়মতো চিকিৎসা দেওয়া যায়। যেটা রাজিয়ার ক্ষেত্রে হয়েছিল। প্রসবের পর পাঁচ ঘণ্টা তার রক্তক্ষরণ হয় এবং পরবর্তীতে হাসপাতালে নেওয়ার সময় তার মৃত্যু হয়।

ইক্ল্যাম্পসিয়া বা খিঁচুনি: গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপজনিত জটিলতা থেকে খিঁচুনি হয়, যা দ্রুত চিকিৎসা না পেলে মৃত্যু হতে পারে।

অনিরাপদ গর্ভপাত: ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বা অদক্ষ হাতের গর্ভপাত বহু নারীর মৃত্যু ঘটায়।

সংক্রমণ: প্রসবের পর সঠিক চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণ হয়ে মৃত্যু হতে পারে।

প্রসবকালীন জটিলতা ও দীর্ঘ সময় প্রসব: বিশেষ করে অদক্ষ ধাত্রীর হাতে প্রসব হলে মায়ের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে।

শক্তিশালী অবকাঠামো, জনবলের অভাব

বাংলাদেশে শক্তিশালী গ্রামীণ স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং জেলা হাসপাতাল পর্যন্ত নেটওয়ার্কের বিস্তার যথেষ্ট। কোভিড-১৯ মহামারির সময় এই নেটওয়ার্ক টিকা বিতরণে কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—এই অবকাঠামো সচল রাখতে যথেষ্ট জনবল নেই। দেশে প্রায় ১০ হাজার চিকিৎসকের পদ শূন্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ১০ জন চিকিৎসক থাকার কথা, অথচ বাংলাদেশে আছে মাত্র ৬.৩ জন। শহরের ৬৭ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক থাকলেও গ্রামে এ হার মাত্র ২৫ শতাংশ। উপজেলা হাসপাতালগুলোতে যন্ত্রপাতি থাকলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা টেকনিশিয়ান না থাকায় সেগুলো অব্যবহৃত পড়ে থাকে।

মাতৃমৃত্যুর অস্বস্তিকর পরিসংখ্যান

গত দুই দশকে মাতৃমৃত্যুর হার কমলেও গ্রামীণ বাস্তবতা এখনো আশঙ্কাজনক। ১৯৯০ সালে প্রতি লাখ জীবিত জন্মে ৫৭৪ জন মা মারা যেতেন, বর্তমানে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে তা ১৫৩। তবে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল বলছে হার ১২৩, আবার অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) হিসাবে ১৬৪। শহরে মাতৃমৃত্যুর হার ১৩৫ হলেও গ্রামে ১৫৭। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও ইক্ল্যাম্পসিয়া (খিঁচুনি) মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ। অনিরাপদ গর্ভপাতও একটি উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলো সময়মতো চিকিৎসা পেলে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

অদক্ষ ধাত্রীর হাতে প্রসব

বাংলাদেশে এখনও প্রায় ৮০ শতাংশ প্রসব হয় বাড়িতে, যার ৯০ শতাংশ হয় অদক্ষ ধাত্রীর হাতে। ফলে সামান্য জটিলতাও প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। হাসপাতাল না যাওয়ার পেছনে রয়েছে বহু কারণ: দূরত্ব, খরচ, সামাজিক কুসংস্কার, এবং সরকারি ব্যবস্থার প্রতি আস্থার অভাব। অনেকে জানেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক পাওয়া যাবে না। ফলে পরিচিত ধাত্রীর কাছে যাওয়া সহজ মনে হয়। এই চক্র ভাঙা যাচ্ছে না: অকার্যকর স্বাস্থ্যব্যবস্থা আস্থাহীনতা তৈরি করছে, আস্থাহীনতা আবার অদক্ষ ধাত্রীদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে।

সামাজিক প্রতিবন্ধকতা

প্রসবকে ঘিরে কুসংস্কার ও পুরুষতান্ত্রিক সিদ্ধান্তগ্রহণ আজও বড় বাধা। অনেক পরিবার হাসপাতালে প্রসবকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে। সচেতনতার অভাব, দারিদ্র্য এবং সাংস্কৃতিক বিশ্বাস মিলে গ্রামীণ নারীদের জীবনের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তোলে। যেমনটা সাফজয়ী ফুটবলার রাজিয়ার ক্ষেত্রেও হয়েছিল। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। বাড়িতেই সন্তানের জন্ম দেন তিনি।

সংকট মোকাবিলায় করণীয় কী

বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু হার কমেছে ঠিকই, তবে গ্রামীণ নারীরা এখনো ভয়াবহ ঝুঁকিতে রয়েছেন। প্রসবের সময় চিকিৎসকের অভাব শুধু নারীর জীবনকেই নয়, নবজাতকের ভবিষ্যৎকেও বিপন্ন করছে। এর মোকাবিলায় সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন- উপজেলা পর্যায়ে ৪৩টি মাতৃসদন হাসপাতালে সিজারিয়ান সুবিধা চালু হয়েছে। কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী বাড়ি বাড়ি গিয়ে গর্ভবতী নারীদের সচেতনতা ও প্রাথমিক সেবা দিচ্ছেন। তবে এ উদ্যোগ এখনো পর্যাপ্ত নয়। দেশের বেশিরভাগ প্রান্তিক এলাকায় প্রসূতি চিকিৎসক নেই। অধিকাংশ নারী বাধ্য হয়ে জেলা হাসপাতালে রেফার হয়ে যান, যা দূরত্ব, খরচ ও সময়ের কারণে জীবনঝুঁকি বাড়ায়।

মিডওয়াইফ: আশার আলো

২০১৩ সাল থেকে সরকার পেশাদার মিডওয়াইফ নিয়োগ শুরু করেছে। ইতিমধ্যে কয়েক হাজার মিডওয়াইফ কাজ করছেন উপজেলা হাসপাতালে। ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মিডওয়াইফরা মা ও নবজাতকের ৯০ শতাংশ সেবার চাহিদা পূরণ করতে পারেন, আর তাদের মাধ্যমে মাতৃমৃত্যু ৪০ শতাংশ কমানো সম্ভব। তবে প্রয়োজনীয় সংখ্যার তুলনায় ঘাটতি এখনো ব্যাপক। এ ছাড়াও পেশাগত প্রতিরোধ ও স্বীকৃতির অভাবও তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগ

টেলিমেডিসিন ও মোবাইল ক্লিনিকের মতো উদ্যোগ কিছু এলাকায় সফলতা দেখিয়েছে। ভিডিও কলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পাচ্ছেন গ্রামীণ নারীরা। কিন্তু নেটওয়ার্ক সমস্যা, ফোনের অভাব এবং নারীদের ডিজিটাল সুবিধায় সীমিত প্রবেশাধিকার—এসব কারণে সেবা সবার কাছে পৌঁছায় না। প্রযুক্তি আংশিক সমাধান দিলেও মূল সমস্যা—জনবল সংকট—থেকে যায়।

প্রয়োজন টেকসই স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও সেবা সম্প্রসারণ

ঢাকা মেডিকেল কলেজের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ড. নাজমা হক বলেন, “গ্রামীণ মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ হলো সঠিক সময়ে চিকিৎসক ও হাসপাতাল না পাওয়া। শুধু অবকাঠামো নির্মাণ নয়, দক্ষ চিকিৎসক নিয়োগ, রক্তব্যাংক ও জরুরি পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই সবচেয়ে জরুরি।”

স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম বলেন, “এখনও অসচেতনতা ও অবহেলার কারণে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মায়েদের মৃত্যু হচ্ছে। সরকার, দাতা সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা—সবার মাতৃস্বাস্থ্যের প্রতি যথাযথ নজর দেওয়া উচিত। শূন্যপদে দ্রুত চিকিৎসক নিয়োগ, গ্রামে কাজের জন্য আর্থিক প্রণোদনা, মিডওয়াইফদের ক্ষমতায়ন, প্রতিটি উপজেলায় ২৪ ঘণ্টা জরুরি প্রসূতি সেবা, রক্তব্যাংক ও অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।”

উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রসূতি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ, প্রতিটি উপজেলায় ২৪ ঘণ্টা জরুরি প্রসূতি সেবা ও ব্লাডব্যাংক চালু, গ্রামীণ ধাত্রীদের আধুনিক প্রশিক্ষণ ও সরকারি স্বীকৃতি, অ্যাম্বুলেন্স ও হটলাইন সেবা আরও সম্প্রসারণ এবং প্রসব-পরবর্তী মা ও শিশুর ফলোআপ সেবা নিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করছেন তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টেকসই স্বাস্থ্যব্যবস্থা, দক্ষ জনবল নিয়োগ ও জরুরি সেবা সম্প্রসারণ ছাড়া এই সংকট থেকে মুক্তি সম্ভব নয়।