
প্রতীকী ছবিটি এআই-এর সহায়তায় তৈরি করেছেন লাবিব হাসান
অনলাইনে অনিরাপদ নারী: সামাজিক দৃষ্টি, আইনের সীমাবদ্ধতা ও প্রতিরোধের উপায়
আপডেট: ২০ আগস্ট ২০২৪, ১৫:৩২
তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে সহজ করে তুললেও বাংলাদেশের নারীদের জন্য অনলাইন জগৎ অনেক সময় হয়ে উঠছে ভীতিকর ও অনিরাপদ। ভুয়া আইডি, ব্যক্তিগত ছবি বিকৃতি, অশ্লীল মন্তব্য থেকে শুরু করে ব্ল্যাকমেইল—এসব সাইবার অপরাধ নারীদের স্বাভাবিক জীবনকে বিপন্ন করছে। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, অনলাইনে হয়রানির শিকার নারীদের ৮০ শতাংশই তরুণী, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব হয়রানির কারণে শারীরিক ক্ষতির চেয়ে মানসিক ক্ষতিই বড়। অনেকে পড়াশোনায় মনোযোগ হারাচ্ছেন, কেউ চাকরির সুযোগ থেকে সরে যাচ্ছেন, আবার কেউ সামাজিক যোগাযোগ একেবারেই সীমিত করছেন। হতাশা, দুশ্চিন্তা আর আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে অনেকের মধ্যে।
সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএএফ) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইবার অপরাধের শিকারদের মধ্যে ৫৯ শতাংশ নারী। সবচেয়ে বেশি হয়রানি হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বিশেষত ফেসবুকে। অপরাধের ধরনগুলোর মধ্যে রয়েছে সাইবারবুলিং (৪৬ দশমিক ৯১ শতাংশ), ছবি বিকৃতি ও পর্নোগ্রাফি, ব্ল্যাকমেইলিং (১৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ), ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস ও আইডি হ্যাকিং।
ঢাকার এক কলেজছাত্রী মিতা (ছদ্মনাম) ফেসবুক আইডি হ্যাকিংয়ের শিকার হন। তার ব্যক্তিগত ছবি বিকৃতি করে ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় ব্ল্যাকমেইল। মিতা বলেন, “প্রতিদিন অচেনা আইডি থেকে অশ্লীল বার্তা আসত। আমি পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। অভিযোগ করতে চাইনি, কারণ পরিবার বলেছিল সম্মান নষ্ট হবে।”
মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, অনলাইন হয়রানির প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি এবং তা শুধু ভার্চুয়াল জগতে সীমাবদ্ধ নয়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম বলেন, “এ ধরনের হয়রানি নারীর আত্মবিশ্বাসে বড় আঘাত করে। অনেক তরুণী শিক্ষা ছেড়ে দেয়, কেউ কর্মক্ষেত্র থেকে সরে আসে। এর প্রভাব পরিবার ও সমাজ পর্যন্ত গড়ায়।”

সমাজবিজ্ঞানী ড. ফাহমিদা আখতার বলেন, “ডিজিটাল হয়রানি আসলে পুরোনো পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার নতুন রূপ। নারীকে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রযুক্তিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।”
আইন আছে, প্রয়োগ দুর্বল
সাইবার অপরাধ দমনে ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন চালু হলেও তা রাজনৈতিক কারণে অপব্যবহার হয়েছে বলে সমালোচনা রয়েছে। পরে ২০২৩ সালে নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইনে যৌন হয়রানি, ব্ল্যাকমেইলসহ বিভিন্ন সাইবার অপরাধে পাঁচ বছর কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান আছে।
তবে বাস্তবে ভুক্তভোগীদের মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ মামলা করেন, আর দায়ের করা মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার ৫ শতাংশেরও কম। অন্যদিকে ৮৮ শতাংশ নারী অভিযোগই জানান না। অনেকের ধারণা, অভিযোগ করেও লাভ নেই। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের গবেষণায় বলা হয়েছে, ডিএসএ–এর অধীনে দায়ের হওয়া মামলার বেশির ভাগ ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে হয়নি; বরং রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। নতুন আইনেও অনেক বিতর্কিত ধারা বহাল থাকায় সমালোচনা আছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু শাস্তির বিধান রাখলেই চলবে না, বরং ভুক্তভোগীকে দ্রুত বিচার ও সহায়তা দেওয়ার কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও ডিজিটাল ফরেনসিক দক্ষতা বাড়ানো ছাড়া এ অপরাধ দমন সম্ভব নয়।
সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল হাসান বলেন, “ভুক্তভোগীরা দেরি করে অভিযোগ করায় প্রমাণ মুছে যায়। পুলিশেরও ডিজিটাল ফরেনসিক দক্ষতা সীমিত। ফলে মামলার বিচার ঝুলে যায়।”
সীমিত উদ্যোগ
নারীর জন্য পুলিশের ‘সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ (PCSW), জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ ও শিশু–কিশোরদের জন্য হটলাইন ১৩২১৯—এসব উদ্যোগ ভুক্তভোগীদের কিছুটা সহায়তা করছে। তবে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর তুলনায় এ উদ্যোগের পরিসর সীমিত।
এনজিও ও তরুণদের নানা ক্যাম্পেইন যেমন ‘টেক ব্যাক দ্য টেক’ বা ‘সাবধানে অনলাইন’ সচেতনতা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। কিন্তু এগুলো এখনও বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ, যেগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব তৈরি হয়নি।
প্রতিরোধের পথ
বিশেষজ্ঞদের মতে, নারীর জন্য নিরাপদ ডিজিটাল পরিবেশ গড়তে হলে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা ও ডিজিটাল শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা, পুলিশের ফরেনসিক সক্ষমতা বাড়ানো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল নিরাপত্তা অন্তর্ভুক্ত করা এবং ভুক্তভোগীদের জন্য মনোসামাজিক সহায়তা দেওয়া জরুরি।
পাশাপাশি পরিবার ও সমাজকে ভুক্তভোগীর পাশে দাঁড়াতে হবে। হয়রানিকে ব্যক্তিগত সমস্যা হিসেবে নয়, অপরাধ হিসেবে দেখা দরকার। ভুক্তভোগীদের দোষারোপ করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
অনলাইনে ব্যক্তিগত তথ্য ও ছবি শেয়ারের ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীদেরও সতর্ক হতে হবে। প্রাইভেসি সেটিংস নিয়মিত হালনাগাদ করা, অপরিচিত প্রোফাইল থেকে আসা মেসেজ এড়িয়ে চলা এবং সন্দেহজনক কার্যকলাপে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইন হোক বা অফলাইন—নারী যেন নির্ভয়ে নিজের মত প্রকাশ করতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করা রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের যৌথ দায়িত্ব। নিরাপদ ডিজিটাল পরিবেশ ছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়।