কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

হিজাব পরা। ছবি: সংগৃহীত

হিজাব নিয়ে গৎবাঁধা ধারণা ভাঙছেন নিউজিল্যান্ডের মুসলিম নারীরা

রুহুল আমিন
জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ১২ জুলাই ২০১৯, ১৪:০৯
আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৯, ১৪:০৯

(প্রিয়.কম) বর্তমান বিশ্বে মুসলিম নারীরা হিজাব পরা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতায় পড়ছেন। কোনো কোনো দেশে ইতোমধ্যে হিজাব নিষিদ্ধও হয়েছে। আবার কেউ কেউ ‘অহেতুক’ ঝামেলা এড়াতে স্বেচ্ছায় হিজাব পরা ছেড়েছেন। তবে এই ক্ষেত্রে ভিন্নতাও দেখা যাচ্ছে। যেমন নিউজিল্যান্ডে বসবাসকারী মুসলিম নারীরা হিজাব পরার বিষয়টিকে নতুনভাবে সামনে আনছেন। তারা আধুনিকতার মিশেলে ধর্মীয় দিকটি বিবেচনায় নিয়ে হিজাব পরা এবং সমাজে নিজের অবস্থান জানান দিতে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছেন।

নিউজিল্যান্ডের সেই সব নারীদের নিয়ে গবেষণা করেছেন আনুশ সোলতানিহান্নাহ থিনিয়ান নামে দুই নারী। আনুশ সোলতানি হলেন ওয়াইকাটো বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি প্রার্থী। আর হান্নাহ থিনিয়ান হলেন ইউনাইটেড ন্যাশন্স ইউনিভার্সিটির প্রিন্সিপাল রিসার্চ ফেলো। নারীদের হিজাব সংক্রান্ত তাদের যৌথ একটি প্রতিবেদন দ্য কনভারসেশন ডটকমে প্রকাশিত হয়েছে। প্রিয়.কমের পাঠকদের জন্য সেই প্রতিবেদনটি ভাষান্তর করা হলো।

গত মার্চে ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে হামলার পর নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন যখন হিজাব পরেন, তখন বিশ্বব্যাপী তিনি খুব প্রশংসিত হন। যদিও হিজাব পরা নিয়ে অনলাইনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও দেখা গেছে। সমালোচকরা বলে থাকেন, অনেক রক্ষণশীল মুসিলম দেশ আছে যেখানে হিজাব না পরলে নারীদের জনসম্মুখে অপমানিত করা হয়, শাস্তি দেওয়া হয়, এমনকি আটক পর্যন্ত করা হয়।

ক্রাইস্টচার্চে হামলার পর মুসলিম কমিউনিটিতে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা। ছবি: সংগৃহীত

মুসলিম নারীদের হিজাবকে ঘিরে এই বিতর্ক দীর্ঘদিনের। সত্যিই কি হিজাব নারীদের নিষ্পেষণ বা জুলুম করে, নাকি এটা ভিন্ন কোনো অর্থও বহন করে?

নিউজিল্যান্ডের শহরে বাস করা তরুণ মুসলিম নারীদের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে এই অনুসন্ধানী গবেষণাটি করা হয়। এতে দেখানো হয়েছে, তারা কীভাবে রোজকার জীবন ও পরিচয় ব্যবহার করে নিষ্পেষণের প্রথাগততার পরিবর্তন করছে।

হিজাবকে ঘিরে বিতর্ক

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে (নাইনি ইলেভেন) নিউ ইয়র্কে সন্ত্রাসী হামলার পর এবং সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে হিজাব পরা নারীরা পশ্চিমা রাজনীতিক, সংবাদমাধ্যম কর্মী ও শিক্ষাবিদদের কাছে ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠেন। এই আলোচনা মুসলিম নারীদের এমন একটা কাঠামো দেওয়ার চেষ্টা করে, যেখানে এই হিজাবকে ইসলামের দ্বারা সংগঠিত নিষ্পেষণের প্রতীক অথবা ইসলামি মৌলবাদীর হুমকির অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

শুধু তাই নয়, হিজাব মুসলিম নারীকে নিষ্পেষণ করে, সেই ধারণা এখনো বিদ্যমান। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এই আধিপত্যবাদী বিতর্কে সম্ভবত একটা বিষয় বাদ পড়েছে। আর তা হলো বর্তমান সময়ের অধিকাংশ মুসলিম নারী হিজাব বিষয়ক ধারণার পুনর্ব্যাখ্যা দিচ্ছেন এবং সেভাবে হিজাব পরে ধর্ম চর্চা করছেন।

ইসলাম চর্চা ও পর্দা প্রথার বিষয়টি বোঝার যে ভিন্ন ভিন্ন পথ আছে, সেটি দেখানোর জন্য প্রযুক্তি ও সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোর সহায়তা নিচ্ছেন মুসলিম নারীরা। গবেষণায় এমন দুটি পথের খোঁজ পাওয়া গেছে, যেখানে ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুক ব্যবহার করে মুসলিম নারীরা তাদের মুসলিমত্ব ও নারীত্ব সম্পর্কে বিকল্প বক্তব্য প্রচার করছে।

হিজাব ফ্যাশন নিয়ে হ্যাশট্যাগ

আমরা যেসব মুসলিম তরুণীদের সাক্ষাতকার নিয়েছি তারা ইসলামি ফ্যাশনের প্রচার করতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এক জায়গায় মিলিত হয়েছেন। তাদের উদ্দেশ্য হলো, ইসলামিকভাবে যাকে শালীনতা ও পর্দা করা বলে তাকে নোংরা, পীড়াদায়ক ও ফ্যাশনের জন্য ক্ষতিকর ভাবার যে জনপ্রিয় সংস্কৃতি তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।

মুসলিম তরুণীরা খুব সচেতনভাবেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই তৎপরতা চালাচ্ছেন এবং হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে ছবি পোস্ট দিচ্ছেন। এর মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে ফ্যাশন অনুরাগী হিসেবে উপস্থাপন করছেন। মিস ইউনিভার্স নিউজিল্যান্ড প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া প্রথম হিজাব পরিহিত নারী হলেন নুরুল শেমুল। তিনি এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন।

সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া নুরুল শেমুল। ছবি: সংগৃহীত

তিনি বলেন, ‘একজন মুসলিম নারী হিসেবে আমাদের শালীনতা বজা রাখা দরকার এবং আমাদের সুন্দর দেখার জন্য কোনো প্রতিযোগিতা বা কারও অনুমোদন দরকার নেই। কিন্তু এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া আমার জন্য এই কারণে জরুরি ছিল যে, শালীন থেকেও মেয়েদের সুন্দর ও ফ্যাশনেবল থাকা যায় তা দেখানো। আমার মতো অন্য মুসলিম নারীরাও এই বিষয়টি উপলব্দি করবেন বলে আমি মনে করি।’

হ্যাশট্যাগ ‘হিজাবিস্তা’

হিজাব ও ফ্যাশন নিয়ে গৎবাঁধা যে ধারণা আছে, তা ভাঙতে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করেন নুরুল। মুসলিম নারীদের হিজাব নিয়ে ধারণার পরিবর্তনে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী আরেক তরুণী হলেন হাসুন আলি। বিভিন্ন ছবিতে দেখা যায়, হাসুন আলি হাই-হিল জুতা এবং শরীর মোড়ানো পোশাকের সঙ্গে এক ধরনের রঙিন হিজাব পরেন। যাতে তাকে খুব স্টাইলিশ মনে হয়। হাসুন আলি সবসময় তার ছবির সঙ্গে #মুসলিমাহফ্যাশন, #হিজাবিস্তা ও #হিজাবফ্যাশন হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করেন।

বেশিরভাগ হিজাব পরিহিত নারী বলে থাকেন, মুসলিম নারীদের হিজাব পরাসংক্রান্ত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও বৈধ তথ্যের উৎস হলো কোরআন। যদিও কোরআনের আয়াতের সঙ্গে আলির পরিহিত হিজাবের তেমন মিল নেই।

হ্যামিল্টনের মুসলিম নারীরা জনসম্মুখে নিজেদের আড়াল করতে হিজাবের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। বরং তার পরিবর্তে তারা ইসলামি পর্দা প্রথার বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখেন এবং মনোযোগ (অন্যের) আকর্ষণে একাধিক বিনয়ী কৌশল অবলম্বন করেন।

সামাজিকভাবে সংঘবদ্ধ মুসলিম নারীরা

প্রচলিত ধারণায়, মুসলিম নারীরা অনুগত, স-বিচ্ছিন্ন এবং হিজাব তাদের সামাজিক জীবনের সঙ্গে মিশে যাওয়া থেকে বিরত রাখে বলে তারা বিশ্বাস করেন। কিন্তু আমাদেরকে যারা সাক্ষাতকার দিয়েছেন তারা এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। বরং তারা এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছেন।

ইয়াসমিন বোরহান দেশটির প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন এভাবে, ‘নাইন ইলেভেনের (৯/১১) পর আমার মনে হয়েছে মুসলিম নারী হিসেবে সমাজে আমাকে আরো বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। আমি অবাক হলাম এটা দেখে যে, আমি একজন কিউই হয়েও এখানকার মানুষের কাছে আমি সত্যিকারের কিউই না। আমি বুঝলাম, আমি কি, তা তাদের জানাতে হবে। আমি বুঝতে পারলাম, আমাকে সত্যি সত্যি ভালোভাবে উপস্থাপন করতে হবে।’

ক্রাইস্টাচার্চের মসজিদে হামলার পর সেখানকার বাসিন্দারা। ছবি: সংগৃহীত

বোরহানের বেশিরভাগ পোস্টে হ্যামিল্টনের বাসিন্দারের সঙ্গে নিজের অংশগ্রহণের দিকটি ফুটে ওঠে। এক পোস্টে দেখা যায়, নিউজিল্যান্ড ব্রেস্ট ক্যানসার ফাউন্ডেশনের জন্য স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে হাস্যোজ্জ্বল বোরহান অর্থ সংগ্রহ করছেন।

আমাদের সঙ্গে সাক্ষাতকার দিয়েছেন, এমন অনেক মুসলিম তরুণী তাদের রোজকার জীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট দিয়ে থাকেন। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য, মুসলিম নারী সম্পর্কে যে আধিপত্যশীল ধারণা তা পরিবর্তন করা এবং মুসলিম নারীরা ক্ষমতাহীন, সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, তা প্রমাণ করা। তারা আশাবাদী, তাদের এই পোস্ট অন্য মুসলিম নারীদের সামাজিকভাবে সক্রিয় করে তুলতে উৎসাহী করবে। উদাহরণস্বরূপ মোনা নাবিলাহ’র কথা বলা যায়।

মোনা বলেন, ‘আমি মনে করি মুসলিম নারীদের আত্মবিশ্বাস অনুযায়ী অন্যদের (অসক্রিয় মুসলিম নারী) সচেতনতা বাড়ানো দরকার এবং তাদের বোঝানো তাদের সক্রিয় হওয়া কতটা জরুরি। আমি এমনটা মনে করি, কারণ সক্রিয় নারীরা সবসময় পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্য কাজ করে। মুসলিম নারীদের তাদের নিজ নিজ কমিউনিটিতে একসঙ্গে থাকা দরকার। কারণ তারা খুবই শঙ্কিত বা খুব লাজুক।’

প্রচলিত ধারণা ভাঙতে এবং জনসম্মুখে নিজেদের উপস্থিতির জানান দিতে মুসলিম নারীরা অনলাইন ও অফলাইনে প্রচুর শ্রম দিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুসলিম নারীরা মৌখিক ও দৃশ্যমানভাবে জানাচ্ছেন, তারা আসলে কি এবং তাদের জীবন যাপন কেমন। তাদের পোস্ট করা ছবিগুলো রঙিন, ফ্যাশন দ্বারা প্রভাবিত, সাহসী, উদ্দীপ্ত এবং রোজকার জীবনের প্রতিফলন থাকছে সেসব ছবিতে।

সমাজে মুসলিম নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং হিজাব ফ্যাশনের ফেনোমেনা, বিশেষ করে বর্তমান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগ তাদেরকে নিজেদের শরীরের ব্যাপারে যে নিজেরাই কেবল কর্তৃত্ব দেখাতে পারে সে সুযোগটি দিচ্ছে। নিষ্পেষক ও নির্যাতনের গৎবাঁধা বয়ানের বর্তমান বিশ্বে এই ফেনোমেনা একটা ইঙ্গিত মাত্র। সে ইঙ্গিত হলো মুসলিম নারীরা নারীবাদ, অ্যাক্টিভিজম ও ভোগবাদের আধুনিক ধারণার সঙ্গে নিজেদের বিশ্বাস ও ধর্মানুরাগের নতুন এক মিশেল তৈরি করেছেন।

প্রিয় সংবাদ/রিমন