‘হাজীর বিরিয়ানি’ গানের স্থিরচিত্র। ছবি: সংগৃহীত
‘হাজীর বিরিয়ানি’ গান নিয়ে যত কথা
আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৮, ১৩:১৯
গত ১৪ অক্টোবর ইউটিউবে প্রকাশিত হয়েছে ‘হাজীর বিরিয়ানি’ শিরোনামে সিয়াম আহমেদ ও পূজা চেরী অভিনীত ‘দহন’ সিনেমার গান। গানটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে সারা দেশে চলছে সমালোচনার ঝড়। সিয়াম আহমেদ বর্তমান তরুণ সমাজের কাছে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে জনপ্রিয়। এর জন্য যে সমালোচনার মাত্রাটাও বেশি, তা বলার অবকাশ রাখে না।
গানটি নিয়ে দেশের বড় বড় গীতিকার, শিল্পীরাও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এ খাতায় আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মতো বিখ্যাত মানুষদেরও নাম আছে। যেকোনো বিষয় নিয়ে যখন সমালোচনা হয় তখন সাধারণত এর পক্ষে ও বিপক্ষে দুই দিকেই মানুষ দাঁড়িয়ে যান। যারা পক্ষে থাকেন তারা বিষয়টির গ্রহণযোগ্যতার জন্য চেষ্টা করে থাকেন আর যারা বিপক্ষে থাকেন তারা একদম তুলোধুনো করে ছেড়ে দেন।
গানটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির পর আমিও এর পক্ষে-বিপক্ষের কারণ খুঁজতে চেষ্টা করলাম। পক্ষে-বিপক্ষে লেখার আগে আমি তুলে ধরতে চাই এই গানটি কেন এত বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এর আগে তো আরও অনেক গানই প্রকাশিত হয়েছে। কয়টা গান নিয়ে সমালোচনা হয়েছে? আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে ‘পুত কইরা দিমু আমি’, ‘যৌবন আমার লাল টমেটোর’ মতো গান এর আগেও অনেক বার বের হয়েছে। কিন্তু কখনো কি এত আলোচনা-সমালোচনা লক্ষ করেছেন? উত্তরটা অবশ্যই না হবে। তাহলে ‘হাজীর বিরিয়ানি’ গান নিয়ে এখন কেন এত সমালোচনা হচ্ছে?
প্রথমত, সিয়াম আহমেদ দেশের একজন শিক্ষিত, ভদ্র, রুচিশীল নায়ক হিসেবে পরিচিত। তার কাছ থেকে মানুষ এ ধরনের গান আশা করে না। দ্বিতীয়ত, গানের বাজে লিরিক্স এবং তৃতীয়ত, বাংলাদেশের সিনেমা বদলেছে।
শেষ কারণটিই সবচেয়ে বড় বলে আমার মনে হয়। দেশের মানুষ আবারও সিনেমার দিকে ঝুঁকেছে। অশ্লীলতার জন্য দেশের মানুষ আমাদের এই সিনেমা শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু আয়নাবাজি, টেলিভিশন, অজ্ঞাতনামা, ঢাকা অ্যাটাক, দেবীর মতো সিনেমা আমাদের সবাইকে আবার সিনেমা হলে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে।
দেশের তরুণ প্রজন্ম একসময় দেশীয় সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু আজ এই গান নিয়ে এত সমালোচনাই প্রমাণ করে দেশের মানুষ আবারও হলে ফিরতে চায়। তার জন্যেই এত আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এটা নিয়ে আমাদের হতাশ হওয়ার পরিবর্তে আশার আলো দেখা উচিত।
এবার আসি আলোচনা-সমালোচনাতে। আমি আগেই বলেছি, আমি দুই পক্ষের কথাই তুলে ধরার চেষ্টা করব। এই গানের বিপক্ষে যেমন একটা বিশাল অংশ রয়েছে, ঠিক তেমনি এই গানের পক্ষে বলার মানুষও প্রচুর। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে এই গানের পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্যের ঝড় বইছে। বিপক্ষে যারা তাদের মন্তব্য হচ্ছে—
- ‘মাতাল হয়ে হিসু করবো দেয়ালে’—এ ধরনের লিরিক্স দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে।
- এত বাজে লিরিক্স এ সময়ে কীভাবে প্রকাশ পায়?
- মাদক নিয়ে কথাগুলো যথেষ্ট আপত্তিকর। ‘গাঁজা টান’, ‘বাবা (ইয়াবা)’ টাইপ কথা বাংলা গানে কীভাবে থাকতে পারে?
- এই গান থেকে ছেলেমেয়েরা কী শিখবে?
- গানকে ব্যান্ড করা হোক।
- দেশের সংস্কৃতির সাথে এই গান যায় না।
- এই গান দিয়ে মাদককে প্রমোট করা হয়েছে।
এই ধরনের আরও মন্তব্য। বিখ্যাত সংগীত ব্যক্তিত্ব আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল তার নিজস্ব ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন: ‘মাতাল হয়ে হিসু করবো দেয়ালে, শালা...যা হবে তা দেখা যাবে সকালে’—এমন একটি বিকৃত রুচির গান বাংলাদেশের সিনেমার পর্দায় চিত্রায়িত হয়েছে জেনে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
আরও অনেকেই এই গানের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এবার আসি গানের পক্ষে যারা আছেন তারা কী বলছেন—
- ‘চার বোতল ভদকা’ টাইপ হিন্দি গানের তালে তো ড্যান্স করেন। তাহলে এই গানে সমস্যা কোথায়?
- এই গানে একটা মাদকসেবনকারী ছেলের চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সুতরাং একজন নেশাসক্ত ছেলে যা করে, এই গানে তো সেটাই দেখাবে নাকি?
- গল্পের প্রয়োজনে এই ধরনের গান থাকতেই পারে।
- আমাদের দেশে ‘তামাক পাতা’ গান এত জনপ্রিয়, তাহলে এই গানে এত চুলকানি কেন?
এই গানের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আব্দুল আজিজ। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা এই গানের মাধ্যমে এই ছেলেটির চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে চাচ্ছি। দেখবেন পুলিশ দৌড়াচ্ছে, মদ খাচ্ছে, লাফালাফি করছে। ও যে কতখানি থার্ডক্লাস মেন্টালিটির ছেলে, এই জিনিসটা আমরা গানের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।’
সিনেমার পরিচালক রায়হান রাফি এই গানের ব্যাপারে তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন: ‘আপনারা যারা কষ্ট পেয়েছেন, তাদের কাছে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। আপনারা আর একটু ধৈর্য নিয়ে সিনেমা মুক্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। সিনেমাটি দেখার পর আপনাদের গানটি অযৌক্তিক মনে হবে না।’
কেউ কেউ আবার পক্ষে-বিপক্ষের বাইরে গিয়ে এটাকে সিনেমা হিট করার একটা চেষ্টা বলে মনে করছেন। কারণ এই গানের মাধ্যমে সারা দেশে এখন আলোচনায় এই সিনেমা।
এখন গানটি কি গল্পের স্বার্থেই করা নাকি সিনেমার প্রচারণার জন্য—সেটা কিছুদিনের মধ্যেই প্রমাণ হয়ে যাবে। কিন্তু গানটির মেকিং যে দুর্দান্ত, সেটা কিন্তু বলার অপেক্ষা রাখে না। ক্যামেরার কাজ থেকে শুরু করে অভিনয়, নাচ সবকিছুই হলো চোখে পড়ার মতো।
আমার মনে হয় গানের লিরিকগুলো এত সস্তা না হয়ে আরও সুন্দর হতে পারত। ঠিক তেমনি আমাদের সবারও এত কঠোর হওয়া উচিত নয়। দেশীয় সিনেমার স্বার্থে আমাদের উচিত সিনেমা মুক্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করা।
[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল না-ও থাকতে পারে।]