কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

হুয়াওয়ে, আলীবাবা, বাইডু, টেনসেন্টের মতো চীনা টেক কোম্পানিগুলো সারা বিশ্বে দিন দিন প্রভাব বাড়িয়ে চলেছে। ছবি: সংগৃহীত

চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো কত বড়

মিজানুর রহমান
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ২১ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:৪৯
আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:৪৯

(প্রিয়.কম) চীনা টেক ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম কয়েকটি স্তম্ভ হচ্ছে বাইডু, আলীবাবা, টেনসেন্ট, শাওমি, হুয়াওয়ে। বাইডুকে যেমন চীনের গুগল বলা হয়, তেমনি আলীবাবাকে অ্যামাজন, টেনসেন্টকে ফেসবুক এবং শাওমিকে অ্যাপলের সঙ্গে তুলনা করা যায়। ২০১৭ সালের নভেম্বরে টেনসেন্টের মার্কেট শেয়ার ৫০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেলে এটি পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম এবং এশিয়ার প্রথম ৫০০ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে পরিণত হয়। বর্তমানে অ্যাপল, গুগল, মাইক্রোসফট ও অ্যামাজনের পরই প্রতিষ্ঠানটির স্থান। মার্কেট শেয়ারের দিক থেকে সুইডেনের মোট জিডিপির চেয়েও বড় টেনসেন্ট।

টেনসেন্ট বিশ্বের সবচেয়ে বড় গেমিং কোম্পানি। পোকেমন গো গেমের কথা মনে আছে? এ গেমটি নিয়ে একসময় সবাই ক্রেজি হয়ে গিয়েছিল। এ গেমটি টেনসেন্টের। তাদের আরেকটি অত্যধিক জনপ্রিয় গেমের নাম ‘অনার অব কিংস’। প্রতিদিন ৭ কোটি খেলোয়াড় অনার অব কিংস গেমটি খেলেন। পোকেমন গো নিয়ে ক্রেজ অনেক হাই থাকার সময় এটির যত খেলোয়াড় ছিলেন, অনার অব কিংসের প্রতিদিনের খেলোয়াড় সংখ্যা তার দ্বিগুণ। টেনসেন্টের মোট আয়ের অর্ধেকই আসে গেমিং থেকে। বেশিরভাগ মানুষ টেনসেন্টকে চেনে তাদের সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম উইচ্যাটের জন্য।

পোকেমন গো গেমটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। ছবি: সংগৃহীত

উইচ্যাট চীনের সবচেয়ে বড় সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম। পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং রাশিয়ার মোট জনংখ্যার চেয়েও উইচ্যাটের গ্রাহক বেশি। উইচ্যাট একটা জাদুকরি অ্যাপ। বাংলাদেশের অনেকেই এটাকে শুধু চ্যাটিং অ্যাপ হিসেবে জানলেও এটা কমপক্ষে ১০টা অ্যাপের কাজ একাই করতে পারে।

চীনে উইচ্যাট ছাড়া সবাই অচল। সামান্য সবজি থেকে শুরু করে সব ধরনের কেনাকাটা ও যোগাযোগে এই উইচ্যাটের বিকল্প নেই চীনে। এটি একই সঙ্গে গুগল, উবার, পেপ্যাল, টুইটার, স্কাইপ, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, অ্যামাজন, টিন্ডার, অ্যাকুওয়েদার, গুগল ম্যাপের কাজ করে। মানে আপনি এই একটি অ্যাপ দিয়েই উপরে উল্লেখিত সবগুলো অ্যাপের কাজ করতে পারবেন।

এ ছাড়া হোটেল বা হাসপাতালের বুকিং, কোন রাস্তায় বা কোন শপিং মলে মানুষের সমাগম বেশি বা যানজট বেশি সেটাও এই অ্যাপে দেখা যায়। এটাকে বলা হয় সুপারঅ্যাপ। সব কাজ একটি অ্যাপেই করা যায় বিধায় এ অ্যাপে নজরদারিও খুব সহজ। ধরুন, আপনার গাড়িটি পরিস্কার করতে হবে। আপনি উইচ্যাটের মাধ্যমে একজন ওয়াশিংম্যানকে ডাকলেন। তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার বাসায় এসে হাজির। কাজ শেষে আপনি তাকে উইচ্যাটে পেমেন্ট করে দিলেন। আপনার পরিস্কার করা গাড়িটির ছবি আপনি উইচ্যাটে শেয়ার করলেন। সেটি দেখে আরেকজন ওই ওয়াশিংম্যানকে ডাকলেন। তিনি উইচ্যাটে আপনার অফার অ্যাকসেপ্ট করলেন। বাসা থেকে বেরিয়ে তিনি উইচ্যাটে ম্যাপ অন করে একটি গাড়ি ডাকলেন। উইচ্যাটের মাধ্যমেই সেই গাড়ির বিল পরিশোধ করলেন। পরে আপনার বাসায় গিয়ে তিনি গাড়িটি পরিস্কার করলেন এবং আপনিও তাকে উইচ্যাটে বিল দিলেন। অর্থাৎ পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কোনো ফিজিক্যাল মানির দরকার নেই। সত্যিকারের ক্যাশলেস সোসাইটি। আবার আপনার বাইরের কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে ইচ্ছা করছে। আপনি অফিসে বসেই ওই রেস্টুরেন্টে অর্ডার করে দিলেন। অর্ডারের সঙ্গে উইচ্যাটের মাধ্যমে বিলটাও পরিশোধ করে দিলেন। সেখানে যেতে যেতে দেখবেন আপনার খাবার প্রস্তুত। রেস্টুরেন্টের মেন্যুও উইচ্যাটে দেওয়া আছে। অর্থাৎ আপনি কোথায় যাচ্ছেন, কার সঙ্গে দেখা করছেন, সেখানে কতক্ষণ সময় কাটিয়েছেন, কে আপনার বাসায় যাচ্ছে, আপনি কার বাসায় যাচ্ছেন, আপনি কি খাচ্ছেন, কি কিনছেন, কত টাকা পরিশোধ করছেন, সব উইচ্যাটের মাধ্যমে ট্র্যাক করা সম্ভব।

উইচ্যাটকে বলা হয় ‘সুপারঅ্যাপ’।

টেনসেন্টের পর আলীবাবা চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম কোম্পানি। এটা অনেকটা অ্যামাজনের মতো। অ্যামাজন ও আলীবাবা বিশ্বব্যাপী ই-কমার্স, ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য দখল করে আছে। এ ছাড়া বিনোদন ও নিউজ মিডিয়ার বাজারেও তাদের গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি আছে। অালীবাবার ই-কমার্স সাম্রাজ্য বিশাল। ২০১৭ সালের ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে শুধু একদিনেই আলীবাবা ২৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিক্রি করেছে! যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাক ফ্রাইডের চেয়ে এ অঙ্কটা শুধু দ্বিগুণই নয়, বরং এ অঙ্কটা আমেরিকার অন্যতম জনপ্রিয় রিটেলার শপ কোহল’স, মেসিস, নর্ডস্ট্রমোর সমন্বিত মার্কেট শেয়ারের চেয়েও বেশি। আলীবাবার ই-কমার্সে যত পণ্য বিক্রি হয়, তা অ্যামাজন এবং ই-বের সম্মিলিত বিক্রির চেয়ে বেশি।

চীনের সার্চ ইঞ্জিন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স, অ্যাডভারটাইজিং এবং চালকবিহীন গাড়ির ক্ষেত্রে বাইডু কর্তৃস্থানীয় অবস্থায় আছে।

স্মার্টফোন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান শাওমি চীনের আরেক টেক জায়ান্ট। মাত্র ২০১০ সালে যাত্রা শুরু করা এ কোম্পানিটি এখন বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী কোম্পানি। অ্যাপল, স্যামসাং ও চীনেরই আরেক প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে তাদের উপরে আছে। শাওমি আবার বাইডুর খুবই ঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান। বাইডুর সঙ্গে মিলে তারা অত্যন্ত শক্তিশালী আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইঞ্জিন তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে এবং আইওটি বিজনেসে (ইন্টারনেট অব থিংস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স ব্যবহার করে বিভিন্ন ডিভাইসের মধ্যে সামঞ্জস্য সৃষ্টি করা) তারা খুবই খুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি হয়ে উঠছে।

অনেকেই হুয়াওয়েকে স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে জানে। কিন্তু হুয়াওয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় টেলিকমিউনিকেশন যন্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। মোবাইল নেটওয়ার্কের কাজের দিক থেকেও তারা সারা বিশ্বে অনন্য। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে তারা থ্রিজি, ফোরজি ও ফাইভজি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের কাজ করেছে। চীনেরই আরেকটি প্রতিষ্ঠান জেডটিই নেটওয়ার্কিং জগতে অনেক বড় নাম। আবার স্মার্টফোনের মার্কেট শেয়ারের দিক থেকে এ বছর অ্যাপলকেও ছাড়িয়ে গেছে হুয়াওয়ে। সারা বিশ্বে স্মার্টফোনের মার্কেট শেয়ারের দিক থেকে তারা এখন দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। স্যামসাং প্রথম অবস্থানে থাকলেও সামনের বছরের প্রথম প্রান্তিকেই হুয়াওয়ে স্যামসাংয়ের স্থান দখল করে নেবে বলে বলছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

চীনের আরেক সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাইটডান্স। উবারের পর এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টার্টআপ। আমরা যত সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ ইউজ করি, ফেসবুক, টুইটার, স্ন্যাপচ্যাট, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, এসবের প্রায় সবগুলোই আমেরিকান। কিন্তু এ বছর চীনা অন্তত দুটি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ বিশ্বব্যাপী ঝড় তুলে দিয়েছে। একটা হচ্ছে এখনকার ক্রেজ টিকটক (TikTok), আরেকটা হচ্ছে ভিগো (Vigo)। একটা সামলোচনা ছিল, চীনা সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপগুলো চীনের বাইরে ততটা জনপ্রিয় নয়। কিন্তু এ দুটি অ্যাপ সে ধারা ভেঙে দিয়েছে। টিকটকের ৪০ শতাংশ ব্যাবহারকারীই চীনের বাইরের।

মানুষের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করার প্রবণতা খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। মানুষ এখন ভিডিও অ্যাপের দিকে ঝুঁকছে। চলতি বছর সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হওয়া দশটি অ্যাপের মধ্যে সোশ্যাল ভিডিও অ্যাপই তিনটা। এই তিনটার মধ্যে টিকটক এবং ভিগো, এ দুটি হচ্ছে চীনা কোম্পানি বাইটডান্সের মালিকানাধীন। প্রযুক্তিপ্রেমী ছাড়া এটার নাম কেউ খুব একটা জানে না। শুধু গত এক বছরে তাদের ভ্যালু বেড়েছে অবিশ্বাস্যভাবে। মাত্র ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক মার্কেটে যাত্রা শুরু করা বাইটডান্সের ভ্যালু গত বছর ছিল ২০ বিলিয়ন ডলার। অথচ এ বছর কোম্পানির ভ্যালু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫ বিলিয়ন ডলার! সফটব্যাংক গত বছর বাইটডান্সে বিনিয়োগ করার পর কোম্পানির মার্কেট শেয়ার এমনভাবে বেড়েছে।

পশ্চিমা বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো চীনে নিষিদ্ধ অথবা খুবই সেন্সরড, এটা প্রায় সবারই জানা। তারপরও চীনের কোনো সমস্যা হচ্ছে না, কারণ তারা নিজেরাই নিজেদেরই সক্ষমতা তৈরি করে নিয়েছে। এ কোম্পানিগুলোই চীনের ডিজিটাল ইকোনমির মূল চালিকাশক্তি।