ছবি সংগৃহীত

সমালোচনায় ২০১৫, খেটে খাওয়া মানুষের দুর্দিনের বছর

Nazmul Hasan Shanto
লেখক
প্রকাশিত: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫, ১৭:০৩
আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫, ১৭:০৩

(প্রিয়.কম) বাংলাদেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা দিয়ে শুরু হয় ২০১৫ সাল। বছরজুড়ে ব্লগার ও এক প্রকাশক হত্যা, বিদেশি নাগরিক হত্যা, চেকপোস্টে পুলিশ হত্যাসহ নানা ঘটনায় বারবার বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে বাংলাদেশ।

বছরের প্রথম ভাগে রাজনৈতিক সহিংসতার জেরে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোলবোমা হামলার ঘটনা ঘটলেও শেষ ভাগে শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলা, চেকপোস্টে পুলিশ ও মিলিটারি পুলিশের উপর হামলা, মসজিদ ও মন্দিরে হামলা, নৌবাহিনীর সংরক্ষিত এলাকায় বোমা হামলা ও সর্বশেষ রাজশাহীর বাঘমারায় মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনায় দেশের নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে সমালোচনায় পড়ে সরকার।

এছাড়া প্রশ্ন ফাঁস, পচা গম আমদানি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ, লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদ বাতিল, শিশু হত্যা, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি, বর্ষবরণে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় বছরজুড়ে সরকারকে সমালোচনার মুখে থাকতে হয়।

২০১৫ সালের উল্লেখযোগ্য সমালোচিত ঘটনাগুলো তুলে ধরা হলো-

রাজনৈতিক সহিংসতা

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রথম বছর পূর্ণ হয় ৫ জানুয়ারি। এ দিন ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ পালন করতে রাজধানীতে সমাবেশের ডাক দেয় বিএনপি। কিন্তু পুলিশি বাধায় গুলশান কার্যালয়ে আটকা পড়েন দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ৫ জানুয়ারি কার্যালয়ের ফটকে দাঁড়িয়েই সাংবাদিকদের সামনে লাগাতার অবরোধের ডাক দেন তিনি। এরপর ১৯ জানুয়ারি এবং সর্বশেষ গত ১৩ মার্চ দু’দফায় সংবাদ সম্মেলনেও তিনি বলেছেন, ‘যৌক্তিক পরিণতিতে না পৌঁছা পর্যন্ত অবরোধ চলবে।’

লাগাতার অবরোধ ও হরতালের মধ্যে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সারাদেশে ভাঙচুর, বাসে আগুন দেওয়া হয়। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় দেশ।

পরবর্তীতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়া গত ৫ এপ্রিল আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিয়ে গুলশানের বাসায় ফিরে যান। টানা ৯২ দিন গুলশানে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবস্থানের পর খালেদা জিয়া বাসায় ফেরার দু’তিন দিনের মধ্যেই হরতালের কর্মসূচি বন্ধ ঘোষণা করে বিএনপিসহ ২০ দল। 

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মতে, জানুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ পর্যন্ত আড়াই মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতায় উৎপাদন ব্যবস্থায় ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। যা মোট জিডিপি’র দশমিক ৫৫ শতাংশ। সিপিডি’র তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৮১ দিন অবরোধ ও ৬৭ দিন হরতাল হয়েছে। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বস্ত্রখাতে। এই খাতে ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। এরপর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় পর্যটন খাতে, যার পরিমাণ ৮২৫ কোটি টাকা। তাদের তথ্য অনুযায়ী, এবারের অবরোধে পেট্রোলবোমায় অগ্নিদগ্ধসহ বিভিন্নভাবে মারা যান ১৫৩ জন। এদের বেশিরভাগই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। 

ব্লগার ও এক প্রকাশক হত্যা

শুধু ২০১৫ সালেই খুন করা হয় চারজন ব্লগার ও এক প্রকাশককে। এদের মধ্যে অভিজিৎ রায় ২৬ ফেব্রুয়ারি, ওয়াশিকুর রহমান বাবু ৩০ মার্চ, সিলেটে অনন্ত বিজয় দাশ ১২ মে এবং ৭ আগস্ট নীলাদ্রি নীল হত্যার শিকার হন। আর ৩১ অক্টোবর একই কায়দায় খুন করা হয় ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে। এই সবগুলো ঘটনার দায় কোনো না কোনোভাবে স্বীকার করেছে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা’ টিম। তদন্তে এমন বিষয় উঠে এসেছে বলে বারবার দাবি করেছে পুলিশ। যদিও চলতি বছরের ২৫ মে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার।

ব্লগার খুনের তারিখ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অভিজিৎ হত্যার ৩৪দিন পর খুন করা হয় বাবুকে, ৪৩ দিন পর অনন্তকে ৮৭ দিনের মাথায় নীলাদ্রি এবং এর ৮৩ দিন পর খুন করা হলো ব্লগার অভিজিতের প্রকাশক দীপনকে। ব্লগার আহমেদ রাজীব ছাড়া অন্য সব খুনের বিরতির সময় হিসেব করে দেখা যায়, গড়ে ৬২ দিনে তারা একজনকে খুন করেছে। ব্লগার খুনের যাত্রা শুরু হয় ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আহমেদ রাজীব হায়দারকে খুনের মধ্যে দিয়ে।  

বিদেশি নাগরিক হত্যা 

চলতি বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর গুলশানে ইতালীয় নাগরিক তাভেলা সিজারকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার মাত্র ছয় দিনের মাথায় জাপানের নাগরিক কুনিও হোশিকে রংপুরে একই কায়দায় হত্যার ঘটনায় আবারও আন্তর্জাতিক মাধ্যমে খবর হয় বাংলাদেশ। এক সপ্তাহের মধ্যে দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনায় যুক্তরাজ্য, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ইতালি বাংলাদেশে বসবাসরত সে দেশগুলোর নাগরিকদের চলাফেরায় সতর্কতা জারি করে দূতাবাসগুলো। বিদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তায় কঠোর নজিরবিহীন ব্যবস্থা গ্রহণ করে সরকার। এর মধ্যে দিয়ে বিদেশি নাগরিক হত্যা ঠেকানো গেলেও হত্যা-নাশকতা সম্পূর্ণভাবে দমন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

চেকপোস্টে দুই পুলিশ হত্যা ও মিলিটারি পুলিশের ওপর হামলা

গাবতলীর পর্বত সিনেমা হলের সামনে ২২ অক্টোবর পুলিশ চেকপোস্টে তল্লাশির সময় দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে এএসআই ইব্রাহিম মোল্লা (৩৭) নামের এক পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন।   

এর ১৪ দিনের মাথায় সাভারের আশুলিয়ার বাড়ইপাড়া এলাকায় নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের একটি চেকপোস্টে শিল্প-পুলিশের পাঁচ সদস্যের ওপর আতর্কিত হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। এতে মুকুল (২৩) নামের এক পুলিশ সদস্য নিহত হন ও গুরুতর আহত হন নুরে আলম নামের আরেক পুলিশ সদস্য।  

এদিকে, রাজধানীর কচুক্ষেত এলাকায় ১০ নভেম্বর সকালে চেকপোস্টে এক মিলিটারি পুলিশকে কুপিয়ে আহত করা হয়। পরে আহত মিলিটারি পুলিশ সদস্যকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়।

তাজিয়া মিছিল ও মসজিদ-মন্দিরে হামলা

পবিত্র আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি চলাকালে ২৩ অক্টোবর দিবাগত রাতে রাজধানীর পুরান ঢাকার হোসনি দালান এলাকায় ইমামবাড়ায় শিয়াদের সমাবেশে বোমা হামলায় দুইজন নিহত হন। এ ঘটনায় অন্তত অর্ধ শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পুরান ঢাকার ৪০০ বছরের ইতিহাসে এ ধরনের হামলাকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর আঘাত ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টা হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় ২৬ নভেম্বর মাগরিরের নামাজের পর শিয়া সম্প্রদায়ের একটি মসজিদে ঢুকে এলোপাতারি গুলি চালায় দুর্বৃত্তরা। এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন মোয়াজ্জেম হোসেন (৭০) নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হন ইমামসহ তিন মুসল্লি।

গত ১০ ডিসেম্বর দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার ডাবর ইউনিয়নের জয়নন্দ ইসকন মন্দিরে কীর্তন ও ধর্মসভার মধ্যে গুলি ও বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দুইজন আহত হন।  

এর আগে ৪ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ১টার দিকে দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার কান্তজিউ মন্দিরে ঐতিহাসিক রাস মেলায় ককটেল বিস্ফোরণে কমপক্ষে ছয়জন আহত হন। 

এদিকে, ২৫ ডিসেম্বর  রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের একটি মসজিদে জুমার নামাজের সময় বোমা হামলায় একজন নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হন আরও তিনজন। নিহত ওই যুবকই বোমা বহন করেছিল বলে নিশ্চিত করা হয় পুলিশের পক্ষ থেকে।

এসব ঘটনার বাইরে চট্টগ্রামের নৌবাহিনীর সংরক্ষিত এলাকায় গত ১৮ ডিসেম্বর দু’টি পৃথক বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন ছয়জন। 

হামলাগুলোর প্রতিটিই ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। সাধারণ মানুষের মাঝেও এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়। এসব হামলার পর বারবারই ওঠে আসছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর নাম। পাশাপাশি আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ আরও কয়েকটি ছোট ছোট জঙ্গি সংগঠনের নামও এসেছে। প্রায় সব ঘটনায় দুই-একজন গ্রেফতার হলেও কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব হামলা পূর্বপরিকল্পিত এবং হামলার মূল লক্ষ্য দৃষ্টি আকর্ষণ

বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন

চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনে এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশ ফটকে কতিপয় দুষ্কৃতকারী বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে আসা কয়েকজন নারীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। নারীদের উপর এই হামলা ঠেকাতে গিয়ে একদল যুবকের হামলায় ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি লিটন নন্দীসহ সংগঠনটির বেশ কয়েকজন কর্মী আহত হন। যৌন হয়রানির এ ঘটনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক আমজাদ আলী পুলিশের দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করেছেন। এ ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলনে ফেটে পরে সারাদেশের মানুষ। মানববন্ধন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ���েরাওসহ নানা কঠোর কর্মসূচি পালন করে ছাত্র ইউনিয়ন, গণজাগরণমঞ্চসহ বিভিন্ন সংগঠন। পরদিন ১৫ এপ্রিল শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ যৌন হয়রানির ঘটনায় মামলা দায়ের করেন। বর্ষবরণে নারী লাঞ্ছনার ঘটনায় সিসি টিভির ফুটেজ দেখে আটজনকে শনাক্ত করা হয় এবং শনাক্তকৃত আট জনকে ধরিয়ে দিতে পারলে প্রত্যেকের জন্য এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। একজন অপরাধীকেও গ্রেফতার করতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ।  

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের উপ-পরিদর্শক দীপক কুমার দাস গত ২৪ ডিসেম্বর মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য ঢাকা মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মামলার তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে ৮-১০ জন দুষ্কৃতকারী কতিপয় নারীর শাড়ি ধরে টান দেয়। তদন্তে সাক্ষ্যপ্রমাণ ও ঘটনার পারিপার্শ্বিকতায় মামলার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে সত্য প্রমাণিত হয়।’

আইএস-তালেবান-জেএমবি সম্পৃক্ততার প্রশ্ন? 

দুই বিদেশি হত্যা ও মসজিদে হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের ‘দায় স্বীকার’-এর খবর জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণ সংস্থা সাইট ইনটিলিজেন্স। যদিও তার কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ দিতে পারেনি সাইট। এদিকে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘটনায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততা না থাকলে দেশীয় জঙ্গি সংগঠনগুলো বিদেশি জঙ্গিদের অনুকরণে এসব হামলা চালাচ্ছে। যাদের মূল উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ। 

এছাড়া সরকারের পক্ষে দৃঢ়ভাবে বলা হচ্ছে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও মদদে জেএমবিসহ অন্যান্য দেশি জঙ্গি সংগঠনগুলো দেশকে অস্থিতিশীল করতে এসব নাশকতা চালাচ্ছে। এসব অপতৎপরতা বন্ধে সরকার সক্রিয় রয়েছে। দেশে আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই

প্রশ্ন ফাঁস ও মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের দাবি

এ বছর মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার আগের দিনই প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠায় পরীক্ষা বাতিল ও নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগের মধ্যেই গত ১৮ সেপ্টেম্বর পরীক্ষা নেওয়া হয়। এরপর থেকেই ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ কর্মসূচি চালিয়ে আসছিল। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তারা আমরণ অনশন কর্মসূচি দিলে এক পর্যায়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা গণতদন্ত করার আশ্বাস দিলে শিক্ষার্থীরা অনশন ভাঙ্গেন। ফাঁসের অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হলেও গত ৪ অক্টোবর স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জানান, মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে প্রশ্ন ফাঁস বিষয়ক গণতদন্ত কমিটি’ গঠিত হয় গত ১৯ অক্টোবর বেলা ১২ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’র শিক্ষক লাউঞ্জে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের ১৭ জন নাগরিকের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির দুই সদস্য ঢাকার বাইরে অবস্থানের কারণে পরবর্তীতে ১৫ সদস্যের কমিটিই প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণস্বরুপ প্রতিবেদন তৈরি করে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভর্তি পরীক্ষায় ব্যাপক অনিয়ম ও বাণিজ্যিক তৎপরতা হয়েছে। টাকার বিনিময়ে ভর্তি নিশ্চিত করবার জন্য প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ বিভিন্ন অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা নতুন করে নেওয়ার সুপারিশ করেছে গণতদন্ত কমিটি।

পচা গম আমদানি 

চলতি বছর ব্রাজিল থেকে চারশ’ কোটি টাকা ব্যয়ে দুই লাখ পাঁচ হাজার ১২৮ মেট্রিক টন গম আমদানি করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। তবে আমদানি করা ওই গম ‘পচা ও পোকাযুক্ত’ মর্মে একাধিক দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পুলিশ, বিজিবি, আনসার, জেলখানা, ডিলার ও আটাকলের পাশাপাশি টিআর (টেস্ট রিলিফ) ও কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য) কর্মসূচিতেও তা বিতরণ হয়। ওই গম নিয়ে আপত্তি তোলে পুলিশ।

এ বিষয়ে গত জুনে হাইকোর্টের রুলের জবাবে খাদ্য অধিদপ্তর ওই গম ‘খাওয়ার উপযোগী’ বলে দাবি করে। এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম জাতীয় সংসদে বলেন, গমের মান নিয়ে তিনি ‘স্যাটিসফায়েড’। তবে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) তাদের পরীক্ষায় জানিয়েছে, এই গম নিম্নমানের। এ নিয়ে চরম বিতর্কের মুখে পরে খাদ্য মন্ত্রণালয়। দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানাভাবে এর প্রতিবাদ জানালে চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় সরকারকে। পরে অবশ্য ৮ জুলাই এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে রাজিল থেকে আনা গম খাদ্য উপযোগী বলে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গম পরীক্ষার সব রিপোর্ট পর্যালোচনা করে এবং উভয়পক্ষের শুনানি শেষে এ সংক্রান্ত রিট নিষ্পত্তি করে আদালত এ আদেশ দেন। তবে এ গম নিতে কাউকে বাধ্য করা যাবে না বলেও আদেশে উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট।

গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি 

আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমা সত্বেও ২৭ আগস্ট বিকেল চারটায় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, বিদ্যুতের দাম গড়ে ২.৯৩ শতাংশ হারে আর গ্যাসের দাম ২৬.২৯ শতাংশ হারে বাড়ানো হয়েছে

এতে গ্যাস ব্যবহারে এক চুলার কানেকশনে ৬০০ টাকা, আর দুই চুলার কানেকশন ৬৫০ টাকা হবে। যে দর এর আগে ছিল যথাক্রমে ৪০০টাকা ও ৪৫০ টাকা।

বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ১ থেকে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত ইউনিট প্রতি আগের দর অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে ৫০ থেকে ৭৯ ইউনিট খরচে ইউনিট প্রতি ২৭ পয়সা বেড়ে ৩.৫৩ টাকা থেকে ৩.৮০ টাকা করা হয়েছে। গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে বর্ধিত এই মূল্য কার্যকর হয়েছে। 

এর আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে গ্রাহক পর্যায়ে এ পর্যন্ত সাত দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ গত বছরের মার্চ মাসে গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে প্রতি ইউনিটে ৪০ পয়সা করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। আর পাইকারি বিদ্যুতের দাম দুই টাকা ৩৭ পয়সা থেকে ছয় দফায় ৯৮ দশমিক ৩১ শতাংশ বাড়িয়ে চার টাকা ৭০ পয়সা করা হয়। পাইকারি পর্যায়ে সর্বশেষ বাড়ানো হয় ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে। এ ছাড়া গ্যাসের মূল্য সর্বশেষ ২০০৯ সালের আগস্টে ১১ দশমিক ২২ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছিল।

গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্তকে জনগণের সঙ্গে প্রতারণামূলক ও অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই প্রতবছরই গ্যাস-বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ। যুক্তি হিসেবে তিনি প্রিয়.কমকে বলেন, এই খাতের অর্জিত অগ্রগতি ধরে রাখতেই প্রয়োজন এই মূল্য সমন্বয়। তার মতে, ২৭২ মেগাওয়াট দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু করলেও এখন উৎপাদন ক্ষমতা ১৪ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। এই খাতকে স্বনির্ভর ও স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্যও এটি প্রয়োজন বলেও মত দেন তিনি।

শিশুকে সাংসদের গুলি 

গত ২ অক্টোবর ভোরে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দহবন্ধ ইউনিয়নের গোপালচরণ এলাকায় সাংসদ লিটনের ছোড়া গুলি দুই পায়ে বিদ্ধ হয় গোপালচরণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহাদাত হোসেন সৌরভের (৮)। পরদিন আহত শিশু সৌরভের বাবা এমপি লিটনকে আসামি করে সুন্দরগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন। এছাড়া বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগে ৬ অক্টোবর সুন্দরগঞ্জ থানায় আরও একটি মামলা করেন সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সর্বানন্দ ইউনিয়নের উত্তর সাহাবাজ গ্রামের হাফিজার রহমান। এরপর সাংসদের বিচাররের দাবিতে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে এলাকাবাসীসহ সারা দেশের মানুষ।     

এসব মামলায় গত ১৪ অক্টোবর  রাজধানীর উত্তরা থেকে লিটনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে ৮ নভেম্বর এমপি লিটনের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন আদালত। এ মামলার শুনানি শেষে জেলা আমলি আদালতের বিচারক মঈনুল হাসান ইউসুফ এমপি লিটনের জামিন মঞ্জুর করেন।

ল্যাংটা ফকির-আব্দুল কাদের ও খিজির খান হত্যা

চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থানার বাংলাবাজারে গত ৪ সেপ্টেম্বর মাজারে প্রবেশ করে ল্যাংটা ফকির ও আব্দুল কাদের নামের দু’জনকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্য সুজন আটক হওয়ার পর হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বলে জানায় পুলিশ।

এদিকে রাজধানী মধ্যবাড্ডার গুদারাঘাটে নিজ বাসায় গত ৫ অক্টোবর পিডিবি’র সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খানকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এসময় তার পরিবারের সদস্যদের হাত-পা-মুখ বেঁধে ফেলে যায় তারা। এ ঘটনার পরদিন রাজধানীর বাড্ডা থানায় একটি হত্যা মামলা (নম্বর-৭) দায়ের করেন নিহতের ছোট ছেলে আশরাফুল ইসলাম।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ  

এ বছর দুই দফায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করা হয়। বছরের শুরুতে একবার এবং বছরের শেষ দিকে একবার এসব বন্ধ করে সরকার। প্রথম দফায় ১৮ জানুয়ারি নিরাপত্তাজনিত কারণে ইন্টারনেটের জনপ্রিয় অ্যাপস ভাইবার ও ট্যাঙ্গো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ সরকার। গত ১৯ জানুয়ারি জনপ্রিয় ইনস্ট্যান্ট ম্যাসেজিং অ্যাপ্লিকেশন ভাইবার ও ট্যাঙ্গোর সাথে হোয়াটস অ্যাপ, লাইন ও মাই পিপলও বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ভাইবার, ট্যাঙ্গো, হোয়াটসঅ্যাপ, মাইপিপল এবং লাইন ২১ জানুয়ারি মধ্য রাতে খুলে দেওয়া হয়।

প্রথম দফার বিষয়টি আলোচনায় না আসলেও দ্বিতীয় দফায় ব্যাপক সমালোচনায় পড়ে সরকার। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়ায় সমালোচনার মাত্রা বেড়ে যায়। 

নিরাপত্তাজিনিত কারণে গত ১৮ নভেম্বর ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জার বন্ধ করে দেয় সরকার। ওই দিন বেলা দেড়টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখা হয়। এক ঘন্টা পর পুনরায় ইন্টারনেট সেবা চালু হয়। টানা ২২ দিন বন্ধ থাকাবস্থায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নির্ভর ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ দ্রুত এসব অ্যাপ খুলে দেওয়ার দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। এরপর গত ১০ ডিসেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক খুলে দেয়া হয়।

তবে ২২ দিন বন্ধ থাকার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুক খুলে দেওয়ার তিন দিনের মাথায় বন্ধ করে দেওয়া হয় মাইক্রো ব্লগিং সাইট টুইটার এবং অনলাইনে কথা বলার অ্যাপ স্কাইপ ও ইমো। ১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এই তিনটি অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করতে দেশের সকল মোবাইল অপারেটর এবং টেলিকম সার্ভিস প্রোভাইডারদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে অবিলম্বে এই সেবাগুলো বন্ধের নির্দেশ দেয়। 

এরপর ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে বন্ধ থাকা সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুলে দেয় সরকার। ওই দিন ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, স্কাইপসহ বন্ধ থাকা সামাজিক যোগাযোগের সব মাধ্যম খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ। ওই দিন থেকে খুলে যায় ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার, লাইন, ট্যাংগো, হ্যাংআউট, স্কাইপ, ইমো, টুইটারসহ বন্ধ থাকা সামাজিক যোগাযোগের সব মাধ্যম।   

এমপি আবদুর রহমান বদি 

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বহুল আলোচিত কক্সবাজার-৪ আসনের সাংসদ আবদুর রহমান বদি। মানব পাচার, ইয়াবা ও রোহিঙ্গাদের বৈধকরণ—এই তিন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সরকারের খাতায় নাম আছে তার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা টেকনাফের শীর্ষ ৭৯ মানব পাচারকারীর তালিকায় সাংসদ বদির নাম আছে ১ নম্বরে। এর আগে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের তালিকায়ও সাংসদ বদিকে মাদকের মূল পৃষ্ঠপোষক বলা হয়। আর রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তি এবং জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে সহায়তাকারীদের তালিকায়ও তিনি আছেন ১ নম্বরে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২০১৩ সালের অক্টোবরে এ তালিকা নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়েছিল। সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি মামলায় সাংসদ বদিকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন আদালত। ইয়াবা চোরাচালান বা মানব পাচারের কোনো ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এছাড়া গত ১২ আগস্ট সকালে মাসিক উন্নয়ন সমন্বয় সভায় যোগ দিতে দেরি করায় প্রকৌশলী মিনহাজের কক্ষে গিয়ে তাকে গালিগালাজ করে মারধর করেন এমপি বদি।

তবে এতোসব অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও গত ২৪ নভেম্বর বদিকে টেকনাফ পৌরসভার মেয়র থাকার সময় রাজস্ব ও উন্নয়ন প্রকল্পের দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)

এদিকে দুর্নীতির একটি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেলেও বদির বিরুদ্ধে দুদকের করা একটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ১০ কোটি ৮৬ লাখ ৮১ হাজার ৬৬৯ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন এবং ১ কোটি ৯৮ লাখ ৩ হাজার ৩৭৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত বছরের ২১ আগস্ট এ মামলা করা হয়। তদন্ত শেষে চলতি বছরের ৬ মে চার্জশিট দেয় দুদক। এতে বদির বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ৬ কোটি ৩৩ লাখ ৯৪২ টাকার সম্পদ অর্জন ও দুদকের কাছে দেয়া সম্পদের বিবরণীতে ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৫৩ হাজার ২৭ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়। এ মামলায় গত বছর ১২ অক্টোবর আবদুর রহমান বদি ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। ১৬ অক্টোবর আদালত তার জামিনের আবেদন নাকচ করেন। এ আদেশের বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্টে রিভিশন করেন। হাইকোর্ট ৬ মাসের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেন। ওই আদেশ স্থগিত চেয়ে দুদক আবেদন করলে চেম্বার আদালত তাতে কোনো আদেশ দেননি। ফলে ৩০ অক্টোবর থেকে বদি কারামুক্ত রয়েছেন। 

লতিফের সাংসদ পদ থেকে পদত্যাগ

হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে সংসদের পদ খুইয়েছেন সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। গত ১ সেপ্টেম্বর সংসদে আবেগময় এক বক্তৃতা রেখে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন তিনি। 

শেষবারের মতো রাখা বক্তব্যে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি মুসলমান, আমি বাঙালি, আমি আওয়ামী লীগার। এ পরিচয় মুছে দেওয়ার মতো কোনো শক্তি পৃথিবীর কারও নেই। কারণ, এ আমার চেতনা, আমার জীবনবোধ, প্রাণের রসদ, চলার সুনির্দিষ্ট পথ।’

লতিফ সিদ্দিকী বলেন, ‘মনে হয়েছে আমার নেতার অভিপ্রায়, আমি আর সংসদ সদস্য না থাকি। কর্মী হিসাবে নেতার একান্ত অনুগত ছিলাম। বহিষ্কৃত হওয়ার পর এর ব্যত্যয় কিংবা ব্যতিক্রম সমীচীন মনে করি না। আমার প্রতিবাদ ছিল প্রতিকার পাওয়ার, এখন দ্বিধাহীন কণ্ঠে কারও বিরুদ্ধে কোনো ঘৃণা-বিদ্বেষ উগরে না দিয়ে কোনো অভিযোগ উত্থাপন না করে হৃষ্টচিত্তে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের আসন ১৩৩, টাঙ্গাইল-৪ সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করছি।’

মায়ার মন্ত্রিত্ব-সংসদ সদস্য পদ নিয়ে বিতর্ক

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মন্ত্রীত্ব ও সাংসদ পদ খারিজ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ২০০৮ সালে জ্ঞাত আয়ের বাইরে অবৈধভাবে ৬ কোটির বেশি টাকার সম্পদ অর্জনের মামলায় ১৩ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন তিনি। ২০১০ সালের অক্টোবরে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ কেবল আইনি প্রশ্নে ওই রায় বাতিল করেন। এর বিরুদ্ধে আপিল করে দুদক। চলতি বছরের ১৪ জুন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে হাইকোর্টে আপিলের পুনঃশুনানির নির্দেশ দেন।

আপিল বিভাগের এ রায়ের পর মায়ার মন্ত্রী ও সাংসদ পদে থাকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান মন্তব্য করেন, মায়ার মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য পদে থাকা সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। 

প্রবীর সিকদার গ্রেফতার ও ৫৭ ধারা 

গত ১৬ আগস্ট সন্ধ্যা সাতটার দিকে সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে রাজধানীর ফার্মগেটের নিজ কার্যালয় থেকে ধরে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশ। পরদিন সন্ধ্যায় পুলিশ তাকে আদালতে হাজির করলে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়। এর আগে ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন উল্লেখ করে এর জন্য দায়ী করেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনসহ আরও দু’জনকে। এতে মন্ত্রীর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়ার অভিযোগে সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনের ৫৭ (২) ধারায় কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন ফরিদপুরের আওয়ামী লীগ নেতা, জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের উপদেষ্টা এপিপি অ্যাডভোকেট স্বপন কুমার পাল। এ মামলায় ১৮ আগস্ট তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এরপর গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সহযোগিতায় পরদিনই রিমান্ড বাতিল হয়ে যায় এবং জামিনে মুক্ত হন এই সাংবাদিক।

এদিকে প্রবীর সিকদারের মুক্তির দাবি তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিলের দাবি জানায় দেশের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ও বিভিন্ন সংগঠন। এছাড়া সাংবাদিক ও শহীদ সন্তান প্রবীর সিকদারকে গ্রেফতার, হাতকড়া পড়িয়ে আদালতে তোলা এবং রিমান্ডে নেয়ার ঘটনায় ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তবে ৫৭ ধারা বাতিলের দাবি নাকচ করে দেন তথ্যমন্ত্রী। 

আরজু ‘হত্যা’

রাজধানীর হাজারীবাগে মোবাইল চুরির অপবাদে পিটিয়ে কিশোর হত্যার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত হাজারীবাগ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি নেতা মো. আরজু মিয়া র‍্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে গত ১৭ আগস্ট নিহত হয়। ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের এই নেতা তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনার জনমনে এক ধরনের চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। আরজু মিয়াকে হত্যার অভিযোগে র‌্যাবের এক সিনিয়র কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করার পর নিহতের ভাই বলছেন, ‘আগে আটক করে তারপর তাকে একটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। আরজুকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।’ পরে তিনি নালিশি মামলাটি করেন।

মায়ের পেটে শিশু গুলিবিদ্ধ

আওয়ামী লীগ সমর্থক দুই পক্ষের সংঘর্ষে গত ২৩ জুলাই মাগুরায় নাজমা বেগম নামের এক অন্তঃসত্ত্বা নারী গুলিবিদ্ধ হন। সেসময় তার গর্ভে থাকা শিশুটির গায়ে গুলি লাগে। শিশুটির স্বাভাবিকভাবে জন্মের সময় তখনও ৩ মাস বাকি ছিল। পিঠে গুলি লেগে তা শরীরের চারটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের প্রচেষ্টায় বেঁচে যায় শিশুটি। 

মাতৃগর্ভেও নিরাপত্তা নেই এমন ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন দেশবাসী। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় আরেক নিহত মমিনের ছেলে রুবেল ২৬ জুলাই মাগুরা সদর থানায় ১৬ জনের নামে হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা দায়ের করেন। এ মামলার অন্যতম আসামি মেহেদী হাসান আজিবর ওরফে অজিবর শেখ (৩৪) ১৭ আগস্ট দিবাগত রাতে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। সংঘর্ষের সময় তার ছোড়া গুলিতেই ওই ব্যক্তি নিহত হয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে বলে জানায় পুলিশ। 

সিটি করপোরেশন নির্বাচন 

দীর্ঘ  ১৩ বছর পর গত ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। একই দিনে পাঁচ বছর পর দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম নির্বাচন। তিন সিটি নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের ফলে বছরের শুরু থেকে চলা রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান ঘটবে এমন আশায় বুক বেঁধেছিলেন দেশবাসী। কিন্তু সে আশায় গুঁড়েবালি। ভোট গ্রহণের দিন মাত্র ২ ঘণ্টার মধ্যে নির্বাচনে চরম অনিয়ম-কারচুপি ও ভোট জালিয়াতির অভিযোগ এনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় রাজনীতিতে ঝড় তোলা এই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটের খেলায় গণতন্ত্র হেরেছে। সরকার-সমর্থকেরা বিরোধীদের বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রের কাছেই যেতে দেননি। অনেকটা ফাঁকা মাঠে পুলিশ ও প্রশাসনের সহযোগিতায় উন্মুক্ত কারচুপি করেছেন তারা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যায়, নির্বাচনী ভোটকক্ষে ভোট জালিয়াতির চিত্র। এমনও দেখা যে, একজনই ভোটকেন্দ্রের সব ভোট দিয়ে শেষ করেছেন! ওই দিন বাংলাবাজার সরকারি বালিকা বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে ভোটের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তারাদেরও ভোট দিতে দেখা গেছে।