
ছবি সংগৃহীত
রাঘববোয়ালরা ফেঁসে যাচ্ছেন: সমকাল
আপডেট: ২২ জুন ২০১৫, ২১:৪৭
(দৈনিক সমকাল, আলতাব হোসেন) ব্রাজিল থেকে পচা গম আমদানির দায়ে এবার ফেঁসে যাচ্ছেন খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের রাঘববোয়ালরা। গম কেলেঙ্কারির নেপথ্যের আট কুশীলবকে চিহ্নিত করেছে সরকারের দুটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, পচা গম আমদানির সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের এক মন্ত্রীর দুই নিকটাত্মীয়, বিএনপি সরকারের আমলের চট্টগ্রামের এক সাবেক মন্ত্রীর ভাগ্নে এবং মন্ত্রণালয়ের এক কর্তাব্যক্তির পরিবারের এক সদস্য জড়িত। গোয়েন্দাদের এই তদন্ত প্রতিবেদন গতকাল জমা দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সরকারের দায়িত্বশীল সূত্রে এ খবর জানা গেছে। প্রায় সোয়া চারশ' কোটি টাকার গম আমদানিতে কমিশন বাণিজ্য কত হয়েছে, কারা কত নিয়েছেন এবং কোন ধরনের প্রেক্ষাপট তৈরি করে খাবার অনুপযোগী পোকায় খাওয়া পচা গম নিতে বাধ্য করা হয় তার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ রিপোর্ট নিয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। খাদ্য মন্ত্রণালয় এ ঘটনায় খাদ্য অধিদপ্তরের গম আমদানিকালীন মহাপরিচালক (ডিজি) মো. সারওয়ার খানকে ওএসডি করে তাৎক্ষণিক ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও এ ক্ষেত্রে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। পচা গম আমদানির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ওএসডি হওয়া সাবেক মহাপরিচালক সারওয়ার খানসহ খাদ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ তিন পরিচালককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুটি গোয়েন্দা সংস্থা। এর মধ্যে খাদ্য অধিদপ্তরের দুই কর্মকর্তা ৩৭ কোটি টাকার কমিশন বাণিজ্য করেছেন বলেও তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। তারা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা ছাড়াও এ ঘটনায় যাদের নাম এসেছে তাদের সঙ্গেও কথা বলেছেন বলে জানা গেছে। ওএসডি হওয়া খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গোয়েন্দা সংস্থার কাছে সব তথ্য ফাঁস করে দিয়েছেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। কাদের চাপে পচা গম খালাসের অনুমতি দিয়েছিলেন_ তাদের নাম ও রাজনৈতিক পরিচয়ও তিনি প্রকাশ করেছেন। একটি সিন্ডিকেটের কারণে গত সেপ্টেম্বর থেকে খাদ্য অধিদপ্তর গম আমদানি প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেনি বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ সিন্ডিকেটই খাদ্য অধিপ্তরের সব টেন্ডার ও খাদ্যশস্য আমদানি ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। মাসে এক লাখ টন গম প্রয়োজন হয় খাদ্য অধিদপ্তরের। গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারের গমের মজুদ তলানিতে নেমে যায়। এ কারণে নীতিনির্ধারকরা বাধ্য হয়ে গম খালাসের পক্ষে অবস্থান নেন। গমের এ সংকট কৃত্রিম বলেও তদন্ত বেরিয়ে এসেছে। প্রায় সোয়া চারশ' কোটি টাকা দামের দুই লাখ টন গম আমদানির কার্যাদেশ পায় ইমপেক্স ইন্টারন্যাশনাল এবং ওলাম ইন্টারন্যাশনাল নামের দুটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ইমপেক্স দেড় লাখ এবং ওলাম ইন্টারন্যাশনাল পায় ৫০ হাজার টন গম সরবরাহের দায়িত্ব পায়। ইমপেক্স ইন্টারন্যাশনাল নেদারল্যান্ডসের গ্যালকো কোম্পানির বাংলাদেশি এজেন্ট। ইমপেক্সের দেশীয় প্রতিনিধির নাম শহীদ জাহাঙ্গীর। খাদ্য অধিদপ্তরের গম আমদানি প্রক্রিয়ায় ইমপেক্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইমপেক্স সম্প্রতি অধিদপ্তরের আরও দুই দফায় নিম্নমানের গম সরবরাহ করে বলেও অভিযোগ রয়েছে। আর ওলাম হচ্ছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের দেশীয় এজেন্ট কায়েদ আজম নামে এক ব্যক্তি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশীয় এজেন্ট হিসেবে যাদের নাম এসেছে এগুলো আসলে ছদ্মনাম। পর্দার আড়ালে থেকেই শীর্ষ ব্যক্তিরা এ গম আমদানি করেছেন। তুরস্ক থেকে গম এনে দেওয়ার কথা থাকলেও আইনি জটিলতার অজুহাতে ব্রাজিল থেকে তাড়াহুড়া করে কম দামে মানহীন ও খাওয়ার অনুপযুক্ত গম বাংলাদেশে আনা হয়। সরকার সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, বিজিবি, পুলিশ, আনসার, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সংস্থার সদস্যদের মধ্যে রেশন হিসেবে যে আটা সরবরাহ করে তা এ গম থেকে প্রস্তুত করা হয়। এ গম দিয়ে টিআর-কাবিখার প্রকল্পও চালানো হয়। প্রথমে পুলিশ ও পরে বিভিন্ন সংস্থা থেকে লিখিতভাবে এ আটা গ্রহণে অসম্মতি জানানো হয়। এ নিয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা বিষয়টি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। প্রধানমন্ত্রী খাদ্য সচিবকে ডেকে পোকায় খাওয়া গম দেখিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বলেও জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রী এ ঘটনায় কারা জড়িত তা তদন্ত করে বের করার নির্দেশ দেন। পুলিশ ও বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা এ গমের আটা না নিলেও টিআর/কাবিখা এবং ওএমএস কর্মসূচিতে নিম্নমানের এ আটা বিতরণ করা হচ্ছে। ব্রাজিল থেকে আমদানি করা নিম্নমানের গম দেশের বিভিন্ন উপজেলায় সরবরাহ করা হয়েছে। ওএমএস এবং টিআর প্রকল্পের জন্য এসব নিম্নমানের গম বরাদ্দ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট অনেকেই জানান, এর আগে কখনও এত নিম্নমানের গম বাংলাদেশে আসেনি। গম যা এসেছে তা পুরোপুরি খাওয়ার অনুপযোগী। গম ব্যবসায়ীরা বলেন, এ গম থেকে আটা তৈরি করা যাচ্ছে না। গমে পোকা ও দুর্গন্ধ রয়েছে। মানুষ খেলে রোগাক্রান্ত হতে পারে। এ গম পশুপাখিদেরও খাওয়ার উপযোগী নয়। বিভিন্ন জেলার খাদ্য গুদাম থেকে নিম্নমানের এসব গমই ছাড় দিচ্ছে খাদ্য বিভাগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সব জেলা প্রশাসককে গমের নমুনা পাঠাতে চিঠি দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। চিঠিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে খাদ্য গুদাম থেকে গমের নমুনা সংগ্রহ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। গতকাল পর্যন্ত ৩৭ জেলা থেকে গমের নমুনা সংগ্রহ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামও এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেছেন, 'পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ডসহ যেসব সংস্থার সদস্যদের মধ্যে রেশন হিসেবে গম দেওয়া হয়, সেসব সংস্থায় ব্রাজিলের গম দিচ্ছি না। তাদের দেশি গম দিচ্ছি। তবে টিআর ও কাবিখা কর্মসূচিতে এ গম দেওয়া হচ্ছে।' তিনি বলেন, ব্রাজিলের গম নেওয়ার জন্য কোনো চাপ দেওয়া হচ্ছে না। তিন লাখ ১৪ হাজার টন গম মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে ব্রাজিলের গম বাদ দিলেও এক লাখ ৪২ হাজার টন দেশি গম রয়েছে।' সৌজন্যে: দৈনিক সমকাল