ছবি সংগৃহীত

মোরেলগঞ্জে পরিত্যাক্ত অবস্থায় ইংরেজ শাসকদের কুঠিবাড়ি

priyo.com
লেখক
প্রকাশিত: ১৫ নভেম্বর ২০১৫, ১৫:৪৭
আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৫, ১৫:৪৭

(এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির, বাগেরহাট) বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে ১৮৪৯সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি মি. মোরেলের মৃত্যু হলে স্ত্রী মিসেস মোড়েল তার দুই ছেলে রবার্ট মোরেল ও হেনরী মোরেলকে নিয়ে বসতি গড়েন পানগুছি নদীর পশ্চিম পাড়ে। সুন্দরবন বন্দবস্ত নিয়ে শুরু করেন নীল চাষ। বাগেরহাট তখন মহকুমাও হয়নি। খুলনা জেলাও ছিল যশোর জেলার অন্তর্গত। আর এর বড় অংশ জুড়ে ছিল সুন্দরবন। বরিশাল থেকে শ্রমিক সংগ্রহ করে বন আবাদ করে গড়ে তোলেন বিশাল আবাসস্থল ‘কুঠিবাড়ী’।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবকে দমন করে ইংরেজ শাসকরা এদেশে তাদের শাসন দৃঢ় করার লক্ষ্যে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার মধ্যে এই কুঠিভিত্তিক শাসনব্যবস্থা অন্যতম। কুঠিবাড়ির তলদেশে নির্মীত হয় অশ্বশালা। গোপন সুড়ঙ্গসিড়ি দিয়ে সরাসরি নামা যেতো অশ্বশালায়। এছাড়াও কুঠিবাড়ির অভ্যান্তরে আনন্দ কক্ষ বা নাচঘর, গুদামঘর, নির্যাতন কক্ষ ও লাঠিয়াল বাহিনীর জন্য পৃথক কক্ষ ছিলো। মূল এই ভবনটির পাশে নির্মিত ছিলো কাচারিঘর, অবাধ্য শ্রমিকদের বেধে রাখার ঘর ও কৃষিকাজে ব্যবহৃত মালামাল রাখার ঘর। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বন্য প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা পেতে কুঠিবাড়ীর চতুর্দিকে উচু প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। তার নাম লেখা হতো দ্বিতীয় এডমন্টন রয়েল মিডেলসেক্স মিলিশিয়া রাইফল পল্টনের কাপ্তান রবার্ট মোরেল’।


মোড়েল পরিবার পানগুছি নদীর পূর্বতীরে নারকেল সুপারির বাগান করেন এবং বাজার বসান। ক্রমে তাদের নামানুসারে এ বাজারের নাম হয়ে যায় মোরেলগঞ্জ। পরে ইংরেজ সরকার এ বাজারকে বন্দর হিসেবে ঘোষণা করে। বন্দরটি ব্যবসাসফল হওয়ায় পরিচিতি পায় ‘লিটেল কোলকাতা’ নামে। পরে নদীতে চর পড়ে যাওয়ায় ধিরে ধিরে এ বন্ধর বন্দ হয়ে যায়।নীল, নীলকর নিয়ে এই মোরেল পরিবারের সাথে মিশে আছে অনেক কাহিনী। শাসক রবার্ট মোরেল ছোট ভাই হেনরি ও ম্যানেজার হেইলির সহযোগিতায় স্থানীয় অধিবাসী ও শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার নিপীড়ন চালাতেন। এ অত্যাচরের খবর শুনে পার্শ্ববর্তী বারইখালী গ্রামের কৃষক নেতা জাহাঙ্গীরের ছেলে রহিমুল্লাহ্ ইংরেজি শেখার ইচ্ছা ত্যাগ করে কোলকাতা থেকে গ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামে ফিরে তার আট ভাই ও সঙ্গীদের নিয়ে সুন্দরবন আবাদ করে ১৪শ’ বিঘা জমি চাষের উপযোগী করে তোলেন।

রবার্ট মোরেল এই খবর জানতে পেরে রহিমুল্লাহর কাছে তার আবাদ করা ১৪শ’ বিঘা জমির খাজনা দাবি করেন। এতে রাজি হননি রহিমুল্লাহ। পরে আবারো খাজনা চেয়ে পেয়াদা পাঠালে রহিমুল্লাহ্ এর জবাবে একটি কাঠের বাক্সে মহিলাদের ছেঁড়া জুতা পাঠিয়ে কর প্রদানের দাবি পুনরায় প্রত্যাখ্যান করেন। এভাবে কাজ হবে না ভেবে কূটকৌশলের আশ্রয় নেন রবার্ট মোরেল। রহিমুল্লাহর প্রতিবেশী ও সহযোগী গুনী মামুনকে রহিমুল্লাহ্’র আবাদ করা এক খন্ড জমি পত্তনি দিয়ে দলে ভেড়ান মোড়েল। ওই জমি দখলের নামে ১৮৬১ সালের ২১ নভেম্বর শেষ রাতে রামধন মালোর নেতৃত্বে হেনরি মোরেল ও তার ম্যানেজার হেইলি শতাধিক লাঠিয়াল নিয়ে রহিমুল্লাহ্কে আক্রমন করেন। রহিমুল্লাহ্ও সঙ্গীদের নিয়ে পাল্টা আক্রমন করেন। এতে মোরেল বাহিনীর প্রধান রামধন মালোসহ ৭/৮ জন নিহত হন। হেনরি ও হেইলি ধরা পড়েন রহিমুল্লাহর হাতে। জীবনে এমন কাজ আর করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিলে হেনরি ও হেইলিকে ছেড়ে দেন রহিমুল্লাহ্।এ ঘটনার ৩দিন পরে শক্তিশালী অস্ত্রধারী বাহিনী সংগ্রহ করে ২৫ নভেম্বর রাতে রহিমুল্লাহর বাড়িতে আক্রমণ করে মোড়েল বাহিনী। রহিমুল্লাহ্ তার দুই স্ত্রীর সহায়তায় সারা রাত ধরে দুটি গাঁদা বন্দুকের সাহায্যে লড়াই করেন মোরেল বাহিনীর বিরুদ্ধে। ভোররাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন রহিমুল্লাহ্। এ খবর শুনে রহিমুল্লাহ্’র সহপাঠী তৎকালীন এ এলাকার ম্যাজিস্ট্রেট সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র সরেজমিনে এই ঘটনার তদন্তে আসেন।


হেনরি, হেইলি ও দুর্গাচরণ আত্মগোপন করেন। আসামিদের অনেককে আটক করে কোলকাতায় নিয়ে যান ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিম চন্দ্র। তাদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়। হেনরি বোম্বে ও দুর্গাচরণ বৃন্দাবন থেকে গ্রেপ্তার হন। অসুস্থ হয়ে বরিশালে চিকিৎসাধীন থাকেন রবার্ট মোরেল। চিকিসাধীন অবস্থায় ১৮৬৮ সালের ১৩মে বরিশালেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এরপরে আর বেশিদিন টেকেনি মোরেল পরিবারের শাসন। কৃষক নেতা রহিমুল্লাহ হত্যার জের ধরেই মোরেলগঞ্জ থেকে ১৮৭৮ সালে শাসন গুটাতে হয় তাদের। কিন্তু শুধু কালের স্বাক্ষী হয়ে এখনও রয়ে গেছে ‘কুঠিবাড়ি’ নামে পরিচিত মোরেলদের নীলকুঠি’র ধ্বংসাবশেষ।

ইংরেজ শাসক রবার্ট মোরেল এর মৃত্যু ও মোরেল পরিবারের বিদায়ের শেষ দিকে মোড়েল এর ভক্ত ও অনুসারীরা কুঠিবাড়ির অদূরে নির্মান করেন মোরেলের স্মৃতিস্তম্ভ। স্মৃতিস্তম্ভটি এখনো আছে। স্তম্ভটিতে বাংলা ভাষায় স্বেত পাথরে লেখা রয়েছে, “দ্বিতীয় এডমন্টন রয়ল মিডেলসেক্স মিলিশিয়া রাইফল পল্টনের কাপ্তান রবট মোড়েল সাহেব ৪২ বছর বয়স প্রাপ্ত হইয়া ১৮৬৮ সালের মে মাসের ১৩ তারিখে বরিশালে মৃত হওয়াতে তদীয় মহালের আমলা তালুকদার হাওয়ালদার ও রায়তেরা তাঁহার স্মরণার্থ এই স্তম্ভ নির্মান করিলেন” ফলকটির নিচে লেখা রয়েছে ‘লিওলিন এবং কোং, কলিকাতা’। মোড়েলগঞ্জ পৌরসভায় অবস্থিত মোরেলদের এই ‘কুঠিবাড়ি’ ভবনের পুরানো আমলের সেই দরজা, জানালা, গ্রীল, সিন্দুক, সিড়িসহ বহু মূল্যবান মালামাল ধীরে ধীরে বেহাত হয়ে গেছে।

স্মৃতিস্তম্ভ থেকেও চুরি হয়ে গেছে অনেক মালামাল। প্রায় দেড়শ’ বছর ধরেই পুরানো ও ঐতিহাসিক এই ভবনটি পরিত্যাক্ত অবস্থায় আছে। দীর্ঘ এই সময়ে ভবন বা এর মালামাল রক্ষণাবেক্ষনের জন্য কেউই কোন দায়িত্ব নেয়নি, উদ্যোগও গ্রহন করেনি।