
ছবি সংগৃহীত
মৃত্যু শুধুই বেদনার নয়
আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৩, ১৩:৪৮
মাত্র জানা হলো, মৃত্যুও আনন্দের। খুবই জানা কথা, মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্ক শোকের। সে শোকের পিঠে সওয়ার হয়ে সুখ, স্বস্তি, আশা আর ভরসাও হাজির হয়ে যেতে পারে, জানা ছিল না। রেফারির বাঁশিতে যেমন খেলা থামে, তেমনি একজন ভালো মানুষের মৃত্যু রোজকার অসহিষ্ণু, সৌজন্যহীন আচরণকে থামিয়ে দিয়েছে। ঘটেছে পরিচিত ভাব ও ভাষার বদল। জীবিত বা মৃত যা-ই হোক, ভালো মানুষের ক্ষমতা অসীম। সে অসীমতায় ভিন্ন থেকে অভিন্ন হতে দেখা গেল দেশের মানুষকে। একজন অতি ভালো মানুষের মৃত্যু রোজকার চিৎকার-চেঁচামেচি, কলহ, কূটতর্ক ইত্যাদির নিপীড়ন থেকে রেহাই দিয়েছে অসহায় সাধারণদের। বহু মানুষের স্বৈরস্বভাব খণ্ডকালীন অবসর গ্রহণে বাধ্য হয়েছে। মুখস্থ মানুষগুলোর চেনা চরিত্র, রুটিন আচার-আচরণ বদলে দিয়েছে এই মৃত্যু। দাপুটেদের নম্র, ভদ্র ও বিনয়ী চেহারা দর্শনের বিরল সুযোগ মিলেছে ভাগ্যে। একজন সম্মানিত মানুষের প্রয়াণে যে স্বল্পায়ু পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়েছে, তা আশা সঞ্চারকারী। আশার সঙ্গে রয়েছে আনন্দের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাই মৃত্যু শুধু শোকের হয়ে থাকেনি। মৃত্যু এখন গা-সওয়া। ডাল-ভাতের মতো প্রাত্যহিক। চারদিকে রোজ এত মৃত্যু এবং আশঙ্কা, কায়দাকানুন ছাড়া সুস্থতা টিকিয়ে রাখার উপায় নেই। মানুষ ঠিক করে নিয়েছে সব মৃত্যুতে শোক নয়, বুদ্ধিমানের পরিচয় হচ্ছে চোখ-কান খোলা রেখে হিসাবমতো শোক খরচ করা। হিসাব কষেই শোকার্ত হওয়ার চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে মানুষ। কোনো মৃত্যুই তাই এখন অধিক শোকের, কোনো কোনো মৃত্যু প্রতিবাদের। মৃত্যু নয়, মানুষ নয়, মৃতের বিশেষ কোনো পরিচয় নির্ধারণ করে দেয় চোখ-কান বুজে থাকতে হবে নাকি শোকে মুহ্যমান হতে হবে। নির্মমতা ও স্খলন মুখ বুজে মেনে নেওয়া চলেছে, এর নাম টিকে থাকা বা বেঁচে থাকা। সামান্য সময়ের জন্য হলেও এই মিথ্যা দশা থেকে মুক্ত হতে পেরেছে মানুষ। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, টুকরো টুকরো মানুষের এক হতে দেখা গেছে। যেকোনো মানুষের মৃত্যুই দুঃখের, বেদনার। এ স্বাভাবিকতা যখন বদলে যায়, সেও কম দুঃখের নয়। যুক্তির চেয়ে গায়ের জোর, গলার জোর মোক্ষম হয়ে দাঁড়ালে নিরীহ ব্যক্তিদের ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে দেখা ছাড়া উপায় থাকে না। ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা একাকার হয়ে সাধারণের অবস্থা লেজে-গোবরে। এ করুণ দশা থেকে স্বল্পকালীন রেহাই পাওয়া গেল। এক শ্রদ্ধাভাজনের মৃত্যু এই রেহাইয়ের কারণ। মৃত্যু সংবাদে যেকোনো পরিচয়ের মানুষ শোকার্ত হয়েছে। মন খারাপ করেছে, কষ্ট পেয়েছে, নিকটের সঙ্গে দূরের মানুষেরাও ফেলেছে দীর্ঘশ্বাস। চেনার সঙ্গে অচেনারাও অনুভব করেছে স্বজন হারানোর বেদনা। কেন এই বেদনা, শোক, দীর্ঘশ্বাস? কেন গোষ্ঠী ছাড়িয়ে বিশাল জনগোষ্ঠীকে আক্রান্ত করেছে একটি মৃত্যু? প্রতিনিয়ত দেশে আমার-তোমারের ঠোকাঠুকি চলছে। দেশের ভালোর চেয়ে আপন ভালো প্রতিষ্ঠার প্রাণান্ত চেষ্টা যেখানে অহরহ, ভালো সেখানে অসহায়, অতি করুণ দশায়। তবু বিভক্ত মানুষের একাত্ম হওয়ার সুযোগ জলে ভেসে যায়নি। ভালোকে চিনে নেওয়ার জন্য উপায় কম, তবে মানুষের ভালো চিনে নেওয়ার সাধ্য আছে। একজন ভালো মানুষের মৃত্যুতে সর্বস্তরের মানুষের গভীর শোকার্ততা সে কথাই প্রমাণ করে। বেঁচে থাকাকালে ভালো মানুষের গুণাবলি নিয়ে চর্চা হোক বা না হোক, ভালোর নিজস্ব শক্তি আছে, তার প্রমাণ মিলল। প্রয়াত জিল্লুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন বলে তিনি যেকোনো পরিচয়ের অনেক মানুষের কাছে বিশেষ আগ্রহের ব্যক্তি হতেই পারেন। বহুকাল ধরে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ততা, তিনি অন্য আর দশজনের মতো ছিলেন না বলে রাজনৈতিক বলয়ের মানুষেরা তাঁকে বিশেষ চোখে দেখবেন কিন্তু সর্বসাধারণ এই মানুষকে অসাধারণ বলে চিনলেন কীভাবে? কে কাকে কবে বুঝিয়েছে তিনি ব্যতিক্রম ছিলেন? সাধারণকে সাধারণ বলা হয়, তবে তাদের মধ্যেও রয়েছে অসাধারণত্ব। নিভৃতের মানুষকে সঠিক চিনে, নীরবে সমীহ করে যাওয়া তেমন এক অসাধারণত্ব। আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল না। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি দেশের সবচেয়ে উঁচু পদে থেকেও কতটা সাধারণ ছিলেন তা সবই লোকমুখে শোনা। নিজে জানার সুযোগ হয়েছে মাত্র একবার। গত ডিসেম্বর মাসে একটা অনুষ্ঠানে তিনি দূর থেকে আমাকে দেখতে পেয়ে ডেকেছিলেন। কাছে গেলে হাত ধরে প্রশ্ন করে বসেন, তুমি আর অভিনয় করো না কেন? তিনি মহামান্য রাষ্ট্রপতি, চারদিকে কড়া প্রহরা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তাকিয়ে রয়েছেন। স্থান-কাল-পাত্রের প্রভাব বিন্দুমাত্র নেই, তিনি শক্তভাবে ধরে রেখেছেন হাত। বললেন, আমি তোমার ভক্ত। অতি সাধারণের স্বীকারোক্তি। শিশুর সরল হাসি তাঁর মুখে। কতজন পারেন এতটা সহজ হতে? যে দেশে মানুষ হাবভাবে নিজেদের বড় প্রমাণ করে খুশি হয়, সন্তুষ্ট থাকে, তিনি ছিলেন সে দেশেরই অতি সাধারণ, মহামান্য রাষ্ট্রপতি। ভালোমানুষির দেখা পাওয়া এখন দুষ্কর, তবে এখনো তার অস্তিত্ব নিখোঁজ নয়। এখন কাল হালুম-হুলুমের। গলার জোর, গায়ের জোর বিনা আত্মপ্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় পথ নেই। ধীর-স্থির, বিনয়ী, মৃদুভাষী এসবকে চরিত্রের দুর্বলতা ধরে নেওয়া হয়ে থাকে। এমন ভুল বিবেচনায় ভুল পথে হেঁটে চলেছে মানুষ। ক্রমাগত ভুল চর্চায় ডুবছে অন্ধকারে, গাঢ় হতাশায়। নিমজ্জমান সাধারণের সামনে হাজির হয়ে একটা মৃত্যু জানান দিয়ে গেল ভরসা না হারাতে। মানুষ কি চায়? যদি মৃত্যু-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ পুনরায় চোখের সামনে হাজির করা যায়, দেখা যাবে প্রয়াত রাষ্ট্রপতির অনেক গুণের কথা বিশেষভাবে উল্লিখিত হয়েছে। যাঁরা সেসব গুণ, অসাধারণত্বের কথা বলেছেন, মিলিয়ে দেখেছেন কি নিজেদের সঙ্গে? নিজ নিজ চরিত্রে ওই সব গুণের সংযোজন অসম্ভব কি? সততা রক্ষা কি কঠিন? নিয়মনিষ্ঠ থাকা, আদর্শে অটুট থাকা, নিঃস্বার্থ হওয়া খুব কি কঠিন? সাধারণ মানুষ দেখেছে একটা সময়ে রাজনীতি তীরহারা ঢেউয়ের সাগরে পড়েছিল, দেখেছে অস্ত্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আদর্শ নত হয়নি। দেখা হয়েছে, জোরের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে গলার রগ ফেলানোর প্রয়োজন পড়েনি। বিশ্বাস থেকে যে শক্তির উদ্ভব সে শক্তি শোরগোল ছাড়াই বিজয় ছিনিয়ে নিতে পারে। এমন উদাহরণ অনুপ্রাণিত করে। তবে তা উল্লেখ করা পর্যন্তই, নিজেদের সঙ্গে সেসব বিশেষ যোগ্যতাকে যুক্ত করার প্রবণতা চোখে পড়ে না। বলা সোজা, করে দেখানো কঠিন, তাই বলার সংস্কৃতিতেই আটকা পড়ে থাকা কপালে রয়েছে। যা-ই হোক, ভালো হওয়ার চেষ্টা না থাক, ভালোকে ভালো বলার দায়িত্ব মাত্র দুই দিনের জন্য জেগেছিল, সেটা সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট থাকা যাক। মাননীয় রাষ্ট্রপতি, আপনি নেই, তবু আপনি রয়েছেন। বেঁচে থাকাদের যা যা নেই মৃত আপনার কাছ থেকে সেসব ধার নিয়ে, বলে সুখ পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা আপনার প্রতি। আপনার মৃত্যু শোকের, একই সঙ্গে জীবনে অনুপস্থিত যে সৌন্দর্যসমূহের উত্থান ঘটিয়ে দিয়েছেন, হোক স্বল্প সময়ের জন্য, তা আনন্দেরও। লিখেছেন আফজাল হোসেন লেখক, অভিনেতা ও নির্দেশক। সৌজন্যেঃ প্রথম আলো
- ট্যাগ:
- রাজনীতি