ছবি সংগৃহীত

মুন্সিগঞ্জে হারিয়ে যাচ্ছে পাটি শিল্প

priyo.com
লেখক
প্রকাশিত: ৩১ আগস্ট ২০১৬, ০৭:১১
আপডেট: ৩১ আগস্ট ২০১৬, ০৭:১১

(মোঃ রুবেল ইসলাম, মুন্সিগঞ্জ) কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের পাটি শিল্প। পাটি শিল্প বাংলাদেশের লোকাচারে জীবন ঘনিষ্ঠ ও ঐতিহ্যবাহী লৌকিক উপাদান। এক সময় ছিল গ্রামের বাড়িতে অতিথিরা এলে প্রথমেই বসতে দেওয়া হতো পাটিতে। গৃহকর্তার বসার জন্যও ছিল বিশেষ ধরনের পাটি। বর্তমানে হিন্দুদের বিয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ শীতলপাটি। গরমকালে শীতলপাটির কদর একটু বেশিই। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের দুপুরে এই পাটি দেহ-মনে শীতলতা আনে।

কিছুদিন আগেও দেখা যেত সিরাজদিখান উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে পাটিকরদের নান্দনিক কারুকার্য। এখন হারিয়েছে তাদের জৌলুস। এখন শুধু বাপ-দাদার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্যই এই শিল্পটিতে অনেকে রয়েছে।

বর্তমানে সিরাজদিখান উপজেলার ১৪৪টি পরিবার পাটি শিল্পকে তাদের বাঁচার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে আকড়ে ধরে রয়েছে। গৃহবধূদের হাতের ছোঁয়ায় নানা নকশায় উপজেলার ইছাপুরা ইউনিয়নের পশ্চিম রাজদিয়া, জৈনসার ইউনিয়নের ভাটিমভোগ, মালখানগর ইউনিয়নের আরমহল ও বয়রাগাদি ইউনিয়নের পাউলদিয়া গ্রামে তৈরি করা হয় শীতল পাটি, পাটি, বড় চট, ছোট চট প্রভৃতি। রফতানি পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি না পেলেও শৌখিন ব্যবসায়ী, বেড়াতে আসা অতিথিদের মাধ্যমে শীতলপাটি যাচ্ছে কলকাতা, মধ্যপ্রাচ্য, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে। অনেকে আবার নকশা করা শীতলপাটি দেয়ালে টাঙিয়ে রাখেন বসার ঘরের শোভা বাড়াতে। পাটি তৈরি শিল্পীরা নিজেদের স্বপ্নের পাশাপাশি গ্রামের অন্য নারীদের পাটি তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাঘ-ফাল্গুন হচ্ছে পাটি বুনার উত্তম সময়। আর বৈশাখে সেই পাটির চাহিদা থাকে ব্যাপক। বছরে ২-৩ বার সিলেট থেকে পাটির কাঁচামাল বর্ষজীবী উদ্ভিদ ‘মোতরা’ বা ‘পাইত্রা’ আসে। সারা বছরের জন্য পাটির কাচামাল পাইত্রা/মোতরা কিনে নেয়া হয়। সেখান থেকে প্রক্রিয়াজাত করে আনতে সময় লেগে যায় ২-৩ মাস। এ ছাড়া মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর, টঙ্গিবাড়ি, লৌহজং উপজেলাসহ সিরাজদিখান উপজেলার ইছাপুরা, কুসুমপুর, চন্দনধূল, আবিরপাড়া গ্রাম ও সিরাজদিখানের হাট থেকে কিনে আনা হয়। গ্রাম থেকে এক পোজা পাইত্রা/মোতরা ৫০-১০০ টাকা আর হাট থেকে ৩০০-৩৫০ টাকায় কেনা হয়। একটা পাটি বানাতে তিনভাগে টাকা খরচ হয়। পাইত্রা/মোতরা কেনা, বেতি বের করা ও পাটি বুনানোর জন্য। এক পোজা পাইত্রা/মোতরাকে প্রক্রিয়াজাত করলে তিন ভাগ হয়। যার মধ্যে একভাগ বেতি যা পাটি তৈরিতে ব্যবহার হয়, একভাগ আতি যা ধানের মোটা ও পানের বিড়া বাধার কাজে ব্যবহার করা হয় এবং একভাগ জালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এক পোজা পাইত্রা/মোতরা থেকে দুই কেজি ৫০০ গ্রাম আতি বের হয়।

স্থানীয় হাটে ৫০ টাকা কেজি দরে ২৫০ টাক বিক্রি হয় এ আতি। দুই পোজা পাইত্রা/মোতরা দিয়ে একটি পাটি হয়। ওই পাটিটি ৫০০-৫৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়। পাটির সাইজ অনুযায়ী বুননি মজুরি হয়ে থাকে। তিন হাত বাই তিন হাত ৯০ টাকা, সাড়ে তিন বাই সাড়ে চার হাত ১২০ টাকা ও চার হাত বাই পাঁচ হাত ১৪০ টাকা। মান অনুযায়ী প্রতিটি পাটি বুনতে ২-৬ দিন লেগে যায়। উন্নত মানের পাটিকে ডালার বলা হয়। এটি বুনতে ৯-১০ দিন লেগে যায়। একটি পাটিতে বুননি খরচ হয় ৬০০ টাকা। পাইকারি বাজারে এর মূল্য ২৫০০-৩০০০ টাকা। এ জেলার পাটি বিক্রির অন্যতম বাজার টঙ্গিবাড়ি উপজেলার বেতকা ও আব্দুল্লাপুর। এ হাটে ঢাকা, ফরিদপুর, চাঁদপুর, নারায়নগঞ্জ ও নরসিংদি থেকে পাইকাররা পাটি কিনতে আসে।

এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে ও সিরাজদিখান বাজারেও বিক্রি করা হয়। শীতল পাটির কারু পল্লীগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, তিন-চার জন গ্রুপ করে রং-বেরংয়ের বেত দিয়ে তৈরি করছে বিভিন্ন রকমের ফুল করা পাটি। আবার কেউ অন্যদের নতুন পাটির জো তুলে দিচ্ছে। শৈল্পিক উপস্থাপনায় এবং নির্মাণ কুশলতার কারণে দক্ষ ও সুনিপুণ একজন পাটিকর নারীর কদরও রয়েছে সর্বত্র। হাতে বুনা পাটির মধ্যে আড়াই থেকে তিনহাত পাইকারি বাজারে ২৫০ টাকা, ৩-৪ হাত ৪০০ টাকা, ৪-৫ হাত ৫০০ টাকা এবং ৫-৬ হাত ৯০০-১২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে।

সিরাজদিখান উপজেলার ভাটিম ভোগ গ্রামের পাটিকর অতুল দে (৬০) জানান, আমি ছোট থেকেই এ কাজ করে আসছি। আমার এক ছেলে দুই মেয়ে নিয়ে খুব একটা ভালো নেই।

পশ্চিম রাজদিয়া গ্রামের মনিন্দ্র চন্দ্র দে বলেন, আমরা চার ভাইয়ের মধ্যে তিন ভাই-ই এ কাজে জড়িত। বুঝ জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এ কাজ করে আসছি। আমাদের সংসার এ দিয়ে কোনভাবে চলছে। গ্রামের বিয়েতে পাটির খুব চাহিদা। বাড়িতে এসেই তারা নিয়ে যায়। সরকার আমাদের সহযোগিতা করলে আমাদের মতো লোকেরা এ শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে।

পশ্চিম রাজদিয়ার মায়ারাণী দে, ইতি, শোভা দে, অর্চনা দের মতো সিরাজদিখানের বিভিন্ন এলাকায় কয়েকশ নারী রয়েছে যারা পাটি বিক্রি করে সংসারের বাড়তি খরচের যোগান দেন। তারা নিজেদের পাশাপাশি এলাকার বেকার অন্য নারীদেরও স্বাবলম্বী হবার স্বপ্ন দেখান পাটি শিল্পের বিকাশে বড় সমস্যা হলো অর্থনৈতিক সমস্যা। শীতলপাটি তৈরির জন্য পাটি শিল্পীদের সরকারি, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কোনো ঋণ দেয় না। সরকার শীতলপাটি রফতানির উদ্যোগ নিলে পাটি শিল্পীদের দিন ঘুরে যেত।