বেশ কিছুদিন থেকে বাংলাদেশের সব মানুষের মতো আমিও আটকা পড়েছি। প্রথমে হরতালে আটকা পড়েছিলাম, এখন অবরোধে আটকা পড়েছি। দুটোর মাঝে পার্থক্যটা আমার কাছে এখনও পরিষ্কার নয়। হরতাল শুরু হওয়ার আগেই গাড়ি পোড়ানোর সময় হতো, অবরোধের আগেও গাড়ি পোড়ানো হয়। হরতালে গাড়ি পোড়ানোর সময় ভেতরে অনেক সময় যাত্রীরা থাকে, অবরোধেও তাই। সিলেটে থাকি, আমার মা ঢাকা থাকেন। অন্য কোনো কাজ না থাকলেও শুধু মাকে দেখার জন্য ঢাকা যাই। এখন যেহেতু ঢাকা যেতে পারছি না, দেখাও করতে পারছি না। তাই টেলিফোনে কথা হয়। আমার মা জানেন আমার বাসায় টেলিভিশন নেই, তাই টেলিভিশনে কী কী দেখানো হয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাকে জানান। ইদানিং আমার মা টেলিভিশন না দেখার জন্য আমার উপর খুব বিরক্ত। মোটামুটি স্পষ্ট করে বললেন, ‘সারা দেশে কী তাণ্ডব হচ্ছে, কী নৃশংসতা হচ্ছে, নিজের চোখে দেখবি না, পালিয়ে বেড়াবি, এটা হয় না। তোকে দেখতে হবে- এই দেশে কী হচ্ছে নিজের চোখে তোকে দেখতে হবে ।’
তারপরেও আমি টেলিভিশনে সেই ভয়াবহ ঘটনা দেখি না। ইন্টারনেটে খবর পড়ি, খবরের কাগজে ছবিগুলো দেখে দ্রুত পৃষ্ঠা উল্টিয়ে ফেলি। গত কিছুদিন বাংলাদেশের খবরের কাগজে যে ছবি ছাপা হচ্ছে, তার থেকে হৃদয়হীন নৃশংস অমানুষিক বর্বরতার ঘটনা এই দেশের মানুষ এতো নিয়মিতভাবে দেখছে বলে আমার জানা নেই। কোনটা বেশি বড় নিষ্ঠুরতা, আমি এখনো নিশ্চিত নই। একেবারে সাধারণ মানুষকে, স্কুলের ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে পথচারী কিংবা মহিলাদের পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা। নাকি যারা এটা করছে তাদের বিরুদ্ধে একটা শব্দ উচ্চারণ না করে চুপচাপ এই ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে সমর্থন করা। রাজনৈতিক সহিংসতা বলে একটা শব্দ চালু আছে। আমরা জানতাম, সেটি এক রাজনৈতিক দল অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীকে করে থাকে। এখন যেটাকে রাজনৈতিক সহিংসতা বলা হচ্ছে, সেখানে রাজনৈতিক নেতাকর্মীর সংখ্যা খুব কম। বেশিরভাগ মানুষ সাধারণ মানুষ। আগুনে পুড়ে যাওয়ার মতো ভয়ংকর আর কী হতে পারে? যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের আপনজনের হাহাকার আর ক্ষোভের কথাটা আমি চিন্তাও করতে পারি না। যারা বেঁচে আছেন, তাদের সেই অমানুষিক কষ্টের কথা কী বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব? যারা রাজনীতি করেন, তারা সবকিছুকে পরিসংখ্যান দিয়ে বিশ্লেষণ করে ফেলতে পারেন। আমরা পারি না। একটা মাত্র মৃত্যু কিংবা একটা মাত্র নিষ্ঠুরতার কথা আমাদের পীড়ন করতে থাকে। এতগুলো আমরা কেমন করে সহ্য করবো?
আমরা সবাই গণআন্দোলনের কথা জানি। যখন নিয়মতান্ত্রিকভাবে আর কিছু করা যায় না, তখন সাধারণ মানুষ পথে নেমে আসে। কিন্তু আন্দোলনের নামে এই নৃশংসতার কথা আমরা কী আগে কখনো দেখেছি? যারা মানুষকে পুড়িয়ে মারছে তারা যখন বাড়ি ফিরে যায়, টেলিভিশনে সেই ভয়াবহ ঘটনাগুলো দেখে, তখন কী তাদের চোখ-মুখে আনন্দে ঝলমল করে উঠে? সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ মানুষগুলো যখন যন্ত্রণায় ছটফট করে, তাদের আপনজন যখন হতাশায়, ক্ষোভে, দুঃখে, ক্রোধে নিজেকে সংবরণ করতে পারে না, তখন কী এই মানুষগুলো উল্লাসিত হয়ে ভাবে- তারা তাদের গন্তব্যে আরো একটু পৌঁছে গেছে? তাদের নেতাকর্মীরা কী ফোন করে তাদের অভিনন্দন জানান? যখন দেখা হয়, তাদের পিঠ চাপড়ে দেন? আমার বড় জানতে ইচ্ছে করে।
যখন থেকে দেশে এই নতুন ধরণের সন্ত্রাস শুরু হয়েছে, তখন আরও একটি বিচিত্র বিষয় আমার চোখে পড়তে শুরু করেছে। খবরের কাগজে প্রায়ই ছবি দেখতে শুরু করেছি, যেগুলো দেখে মনে হয়- আমরা বুঝি নাটকের দৃশ্য দেখছি। সন্ত্রাসী এই কাজকর্মের এত নিখুত ছবি দেখে আমরা মাঝে মাঝে হকচকিয়ে যাই। দেখে মনে হয়, সাংবাদিকেরা যেন ভালো করে ছবিগুলো তুলতে পারেন। সেজন্যেই তাদের সামনে অনেক যত্ম করে ঘটনাগুলো ঘটানো হচ্ছে। বিশ্বজিৎ নামের সেই ছেলেটিকে যখন ছাত্রলীগের ছেলেরা প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করে, তখন সাংবাদিকরা এই দৃশ্যটি ক্যামেরায় ধারণ করার জন্যে এতো সময় না দিয়ে, ছেলেটিকে যদি বাচাঁনোর চেষ্টা করতেন তাহলে সে বেঁচে যেত কী না এই চিন্তাটি মাঝে মাঝেই আমার মাথায় উঁকি দেয়।
কেভিন কার্টার নামে একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ফটোগ্রাফার ছিলেন, নব্বইয়ের দশকে এই ফটোগ্রাফার তার একটি ছবির জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন। ছবিটি ছিল আফ্রিকার দুর্ভিক্ষের সময়ের ছবি। একটি শীর্ণ শিশু নিজেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে খাবারের সন্ধানে, অদূরে তাকে অনুসরণ করছে একটি শকুন। দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার সেই ছবি জন্য কেভিন কার্টার পুলিৎজার পুরষ্কার পেয়েছিলেন সত্যি। কিন্তু একজন মানুষ হয়ে একটা শিশুকে রক্ষা না করে শকুনের সাথে ছবি তোলার জন্য সারা পৃথিবীতে তার বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল, সম্ভবত সে জন্যই তার কয়েক মাস পরে এই ফটোগ্রাফার আত্মহত্যা করেছিলেন।
একজন ফটোগ্রাফার চমকপ্রদ একটা ছবি তোলার জন্য সবসময় চোখ-কান খোলা রাখেন। কিন্তু ছবি তোলার সুযোগ করে দেওয়ার ফলে যদি সন্ত্রাসীদের গোষ্ঠী সেই ফটোগ্রাফার, সেই পত্রিকা, পত্রিকার সম্পাদক সবাইকে ব্যবহার করে নিজের উদ্দেশ্যে হাসিল করে ফেলে তাহলে তার দায়িত্ব কে নেবে? আমাদের দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো কী বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে, দুর্বৃত্ত, সন্ত্রাসী, হত্যাকারীদের তারা মানুষকে আতংকিত করে তোলার প্রক্রিয়াকে গায়ে পড়ে সাহায্য করছে না?
২.
এই দেশ আজকাল মানুষের নিরাপত্তা নেই, যে কোনো মানুষ যে কোনো সময় আক্রান্ত হতে পারে। গত সপ্তাহে আমাদের ক্যাম্পাসে একসাথে অনেকগুলো ককটেল ফুটলো। একটা আমাদের বাসার বারান্দায়। যখন সেটি ফাটানো হয়েছে, তখন আমার স্ত্রী তার থেকে কয়েক ফুট দূরে। মাঝখানে দেয়াল, দরজা থাকার জন্য বড় ধরনের কিছু ঘটেনি। কিছুক্ষণের ভেতরেই সবাই বাসা থেকে বের হয়ে এলো। দেখতে দেখতে শত শত ছাত্র জড় হয়ে গেল। তাদের মাঝে ভয় কিংবা আতঙ্কের বদলে বরং একটা উৎসব উৎসব ভাব। খুব কাছেই মেয়েদের হল, ককটেলের শব্দ তারা খুব ভালোভাবে পেয়েছে। টেলিফোনে আমাদের জানানো হলো, তাদের কয়েকজন বের হতে চায়। প্রক্টর, রেজিষ্ট্রার, শিক্ষক সবাই আছেন, তারা ভাবলেন বরং আমরাই মেয়েদের সাহস দিয়ে আসি!
মেয়েদের হলের ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই সব মেয়েরা বের হয়ে আমাদের ঘিরে দাঁড়াল। একজন বলল, ‘স্যার খুব ভয় লাগছে।’ আমি বললাম, ‘ভয় লাগার কী আছে? এদেশে জম্মেছো একটু সহ্য করো।’ মেয়েরা তখন বাধা দিয়ে বলল, ‘না, না স্যার, আমাদের নিজেদের জন্য একটুও ভয় লাগছে না। আপনার আর ম্যাডামের জন্য ভয় লাগছে।’
যখন এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে একদিন যেতে হবে এই ছেলেমেয়েদের ভালোবাসা ছেড়ে কেমন করে যাব, আমি জানি না। এরা আমাদের নতুন প্রজন্ম। ডিসেম্বর মাস এলে আমার এই দেশের তরুণ প্রজম্মের কথা মনে পড়ে। এই দেশটি তরুণ প্রজন্মের দেশ, তরুণ প্রজন্ম তীব্র আবেগ আর ভালোবাসায় এই দেশটির জন্ম দিয়েছিল। আবার তীব্র আবেগ আর ভালোবাসা দিয়ে এই দেশটিকে রক্ষা করবে, এই দেশটিকে গড়ে তুলবে।
সেদিন ভোরবেলা একটা টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক আমার অফিসে চলে এসেছেন ইন্টারভিউ নিতে। ডিসেম্বর মাসে তারা মুক্তিযুদ্ধের ওপর অনুষ্ঠান করবেন। তাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার স্মৃতি জানতে চান, আমার কথা শুনতে চান।
আমি সেই টেলিভিশন চ্যানেলকে বলেছি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনেক বীরত্ব আর অনেক বড় অর্জনের ইতিহাস। কিন্তু সেটা একই সাথে বড় একটা আত্মত্যাগের ইতিহাস। আত্মত্যাগের এত বড় ইতিহাস পৃথিবীর অন্য কোথাও এভাবে আছে কী না, আমার জানা নেই। এই মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা বাংলাদেশে একটি পরিবারও ছিল না, যার কোনো একজন আপনজন কিংবা কাছাকাছি একজন মানুষ মারা যায়নি। দেশ যেদিন মুক্ত হয়েছিল, সেই অবিশ্বাস্য আনন্দের পাশাপাশি অনুভূতিটি ছিল স্বজন হারানো একটি গভীর বেদনার অনুভূতি।
আমি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিককে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম, আমাদের প্রজন্ম সম্ভবত সবচেয়ে সৌভাগ্যবান প্রজন্ম। ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে কীভাবে টিকে থাকতে হয় আমরা জানি। তার চাইতে বড় কথা, একাত্তরের সেই ভয়ংকর দুঃসময়ে এই দেশের মানুষের সবেচেয় সুন্দর রূপটি বের হয়ে এসেছিল। গভীর ভালোবাসায় মানুষ তখন একে অন্যের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের প্রজন্ম মানুষের সেই রূপটি দেখেছে, আমরা তাই কখনো মানুষের ওপর বিশ্বাস হারাই না। আমরা জানি, অতি সাধারণ অতিকিঞ্চিৎকর একজন মানুষের ভেতরে একজন অসাধারণ মানুষ লুকিয়ে থাকে। প্রয়োজনের সময় তাকে বের করে আনা যায়। আমি জানি, এটা আমাদের শক্তি। জ্ঞানী-গুণী অল্প কয়েকজন সুশীল সমাজ আমাদের শক্তি নয়, অসংখ্য সাধারণ মানুষ আমাদের শক্তি। এই দেশে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ থাকতে আমাদের ভয় কী?
এই সাধারণ মানুষদের পথ দেখাবে নতুন প্রজন্ম। তাই আমি সবসময়ে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, তারা কখনো আমাকে নিরাশ করে না। অল্প একটু সুযোগ দিলে তারা ম্যাজিক করে ফেলতে পারে, আমি সবিস্ময়ে সেটি দেখি। এই নতুন প্রজন্মকে আমি বারবার মনে করিয়ে দিতে চাই, কখনো যেন তারা হতোদ্যম না হয়। কোনো কিছু নিয়ে তারা যেন হতাশ না হয়। একাত্তরে অবিশ্বাস্য দানবের বিরুদ্ধে এই দেশের মানুষ বিজয় লাভ করেছিল শুধু একটি কারণে, তারা তাদের মনে জোর হারায়নি। এখনও তরুণদের মনের জোর হারালে চলবে না। আমাদের চারপাশে আমরা যেটি দেখছি সবকিছু সাময়িক। আমাদের তরুণদের ভেতরে যে শক্তি আছে, তারা সবকিছু খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিতে পারবে আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি।
ডিসেম্বর মাস এলে আমার সেই তরুণদের কথা, কিশোরদের কথা মনে পড়ে। আমার সেই কিশোর বন্ধুরা, যারা অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধ করে মারা গিয়েছিল। তারা এখনও কিশোর, এখনও তরুণ। তারা কোনদিন বড় হবে না, আজীবন কিশোর থেকে যাবে। আমরা যারা বেঁচে আছি আমাদের বয়স বাড়ছে। আমাদের চুল পাকছে। কিন্তু সারাটি জীবন পরিশ্রম করেও আমরা কী সেই কিশোর তরুণদের এক ফোটা রক্তের ঋন শোধ করতে পারব?
আমাদের নতুন প্রজন্ম পারবে। শত বাধা-বিপত্তি, হরতাল-অবরোধ, সন্ত্রাস, অরাজকতা, সহিংসতার মাঝেও কিন্তু বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। যে পাকিন্তানের অংশ হিসেবে রেখে দেওয়ার জন্য একাত্তরে এই যুদ্ধপরাধীরা এই দেশে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল, সেই পাকিস্তানের এখন বাংলাদেশের সাথে তুলনা করার সুযোগ নেই! অর্মত্য সেন স্পষ্ট করে বলেছেন, মানুষের জীবনের কথা চিন্তা করলে অর্থতৈনিকভাবে শক্তিশালী দেশ ভারত থেকেও বাংলাদেশের মানুষ অনেক ভালো আছে। খাদ্য-শস্য, স্বাস্থ্যসেবার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থানকে পৃথিবীর মানুষ এখন একটা বিস্ময় হিসেবে দেখে। সবচেয়ে বড় কথা এই দেশের স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন হয়েছে। এই প্রজন্ম যখন দেশের দায়িত্ব নেবে, তখন আমাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে কার সেই ক্ষ���তা আছে?
এই মূহুর্তে খবরের কাগজ খুলে যখন একটি যন্ত্রণাকাতর শিশুর মুখ দেখি, একজন মায়ের মুখের কান্না দেখি, অগ্নিদদ্ধ একজন মানুষের হাহাকার দেখি, তখন মনটা ভারী হয়ে যায়। এটি ডিসেম্বর মাস, এই মাসে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক, সব দুঃখ কষ্ট দূর করে আমাদের তরুণ কিশোর মুক্তিযোদ্ধার রক্তের ঋন শোধ করব।
আমাদের তরুণ প্রজন্ম নিশ্চয়ই করবে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।