ছবি সংগৃহীত

রাসুল (সা.) -এর দেশপ্রেম

priyo.Islam
লেখক
প্রকাশিত: ০১ ডিসেম্বর ২০১৫, ০২:৪৯
আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৫, ০২:৪৯

মানুষের মধ্যে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে যতগুলো সৎ গুণাবলি বিরাজমান, তন্মধ্যে দেশপ্রেম অন্যতম। স্বদেশপ্রেম হচ্ছে নিজ জন্মস্থানের প্রতি ভালোবাসা। প্রকৃতপক্ষে স্বদেশপ্রেম মানবজীবনের মূল্যবান সম্পদ এবং সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষমাত্রই তার পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন সর্বোপরি তার স্বদেশকে জন্মগতভাবেই ভালোবাসে। জীবন-জীবিকার প্রয়োজন ও কর্তব্যের টানে বিদেশে বসবাস করলেও মানুষ জন্মভূমি তথা মাতৃভূমির মায়া-মমতা ভুলতে পারে না। এসবের প্রভাব প্রতিটি মানুষের দেহ, মন ও প্রাণে বিদ্যমান থাকে। মাতৃভূমি ও জন্মস্থানের প্রতি মানুষের এ দুর্নিবার আকর্ষণ বা ভালোবাসা, ভালোলাগা, গভীর আবেগ-অনুভূতি ও মমত্ববোধকে বলে স্বদেশপ্রেম। দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে হলে স্বদেশপ্রেম অত্যাবশ্যক। দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ : দেশের প্রতি ভালোবাসা মানব চরিত্রের একটি মহৎ গুণ। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারলে মান-সম্মান, ঈমান-আমল রক্ষা করা যায়। ঈমানপ্রেমের মতো দেশপ্রেমও মোমিনের অস্তিত্বের অংশ। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে স্বদেশপ্রেমের কথা বলা হয়েছে। ইসলামে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার জোরালো দিকনির্দেশনা রয়েছে। স্বদেশপ্রেম ও মাতৃভূমিকে ভালোবাসা এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা ঈমানের দাবি। তাই বহুল প্রচারিত আরবি প্রবাদে বলা হয়, 'হুব্বুল ওয়াতানি মিনাল ঈমান' অর্থাৎ 'স্বদেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ'। ধর্মপ্রাণ মানুষের হৃদয়মন জুড়ে আরবি প্রবাদ বাক্যটি স্বদেশপ্রেমে বিরাট প্রভাব ফেলেছে। রাসুল (সা.) এর মদিনায় হিজরত : প্রিয় রাসুল মুহাম্মদ (সা.) এর সুমহান জীবনাদর্শে ও স্বভাবচরিত্রে দেশপ্রেমের অনন্য নজির উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে। সায়্যিদুল মুরসালিন (সা.) তাঁর জন্মভূমি মক্কার পবিত্র ভূমিকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন। স্বদেশের জনগণকে শান্তির ধর্ম ইসলামের মর্মবাণী সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার আহ্বান জানিয়ে তাদের হেদায়েতের জন্য তিনি অনেক কঠিন অত্যাচার সহ্য করেছেন। ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে রাসুলুল্লাহ (সা.) কাফেরদের নির্মম অত্যাচারে তাঁর সাহাবিদের আবিসিনিয়ায় হিজরত তথা দেশত্যাগের অনুমতি দিলেও তিনি প্রাণপ্রিয় স্বদেশে অবস্থান করেন। পরিশেষে কাফেরদের গভীর ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও নির্মম নির্যাতনে স্বজাতি কর্তৃক বিতাড়িত অবস্থায় আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে রাসুলে করিম (সা.) প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করতে মনস্থ করেছিলেন। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় হিজরতকালে তিনি মক্কার দিকে বারবার ফিরে তাকান, আর কাতর কণ্ঠে আফসোস করে বলেন, 'হে আমার স্বদেশ! তুমি কতই না সুন্দর! আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার আপন গোত্রের লোকেরা যদি ষড়যন্ত্র না করত, আমি কখনও তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।' রাসুল (সা.) ও সাহাবিদের স্বদেশপ্রেম : রাসুল (সা.) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামও মাতৃভূমিকে খুব ভালোবাসতেন। সুদীর্ঘ ১৩ বছর রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবিরা মাক্কায় ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হয়েছেন এবং অন্যায়-অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত তারা মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। হিজরতের পর মদিনায় বিশিষ্ট সাহাবি আবু বাকর (রা.) ও বেলাল (রা.) জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন, অসুস্থ অবস্থায় তাদের মনে-প্রাণে স্বদেশ মাক্কার স্মৃতিচিহ্ন জেগে উঠেছিল। তারা জন্মভূমি মক্কার দৃশ্যাবলি স্মরণ করে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। এ অবস্থায় হুজুরে করিম (সা.) সাহাবিদের মনের এমন দুরবস্থা দেখে প্রাণভরে দোয়া করলেন, 'হে আল্লাহ! আমরা মক্কাকে যেমন ভালোবাসি তেমনি তার চেয়েও বেশি মদিনার ভালোবাসা আমাদের অন্তরে দান করুন।' (বোখারি)। শান্তিশৃঙ্খলা স্থাপনে স্বদেশপ্রেম : রাসুল (সা.) যুদ্ধ-বিগ্রহ, কলহ-বিবাদ, রক্তপাত, অরাজকতা ইত্যাদি দূরীভূত করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সৌহার্দ-সম্প্রীতির ভিত্তিতে একটি অনুপম আদর্শ কল্যাণমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। দেশে সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় আম্বিয়াকুল শিরোমণি (সা.) এর ভূমিকা অতুলনীয়। প্রখ্যাত দার্শনিক 'জর্জ বার্নাডশ' দেশপ্রেমিক হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে মানবতার ত্রাণকর্তা বলে আখ্যায়িত করেছেন। দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষায় 'মদিনা সনদ' প্রণয়ন : রাসুল (সা.) আরব দেশে আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য মদিনায় বসবাসরত নাগরিকদের মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি বজায় রাখাসহ নানা দিক বিশেষভাবে বিবেচনা করে 'মদিনা সনদ' প্রণয়ন করেন- এতে মদিনায় বসবাসরত সব ধর্মাবলম্বীর স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের যথোপযুক্ত স্বীকৃতি ছিল। জাতি-ধর্ম-বর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে দেশের সব মানুষের ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সুনিশ্চিত হয়েছিল। ফলে আরব দেশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হয়। মদিনা রাষ্ট্র পৃথিবীর ইতিহাসে যে কোনো সময়ের, যে কোনো কালের জন্য সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা, মানবতা ও উদারতার প্রতীক হয়ে থাকবে। একটি স্বাধীন জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এটিই প্রথিবীর প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র বা সংবিধান। এছাড়াও চিন্তা ও মতামত প্রকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ প্রদান করে হুজুর (সা.) ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বতোরূপে প্রতিষ্ঠা করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক এ উদ্যোগ গ্রহণ নিঃসন্দেহে দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষায় জাতিগত ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়। জাতীয় ঐক্যের ফলে অভ্যন্তরীণ বিরোধী শক্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সাহস পায়নি। রাসূল (সা.) এর জন্মভূমি 'মক্কা বিজয়' : রাসুল (সা.) এর স্বদেশ তথা জন্মভূমি 'মক্কা বিজয়' মানব ইতিহাসের এক চমকপ্রদ অধ্যায়। নবুয়ত লাভের পর সুদীর্ঘ ১৩ বছর রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবিরা স্বদেশ মক্কায় ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হয়েছেন এবং নির্মম অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত তারা দেশত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অতঃপর হুদাইবিয়ার সন্ধির শর্তাবলি কোরাইশরা একের পর এক লঙ্ঘন করতে থাকলে হুজুর (সা.) অষ্টম হিজরি মোতাবেক ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ১০ মতান্তরে ১২ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হন। প্রত্যুষে রাসুল (সা.) স্বদেশ প্রত্যাবর্তন তথা মক্কা নগরীতে প্রবেশের আয়োজন করলেন। বিভিন্ন দলপতিকে মক্কার বিভিন্ন রাস্তায় প্রবেশের আদেশ প্রদানকালে এই বলে সতর্ক করে দিলেন যে, 'সাবধান, কাউকে আক্রমণ করো না। কেউ আক্রমণ করলে আত্মরক্ষা করবে।' রাসুল (সা.) অবশেষে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত-আক্রমণ প্রতিহত করে কার্যত বিনাযুদ্ধে, বিনা রক্তপাতে, বিনা ধ্বংসে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে জালেম, সন্ত্রাসী ও পৌত্তলিকতার পঞ্জিকা থেকে মক্কাকে স্বাধীন করলেন। স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে পারা গৌরবের বিষয়, রাসুল (সা.) এ মহান শিক্ষাই মানব জাতিকে উপহার দিয়ে গেছেন। মুহাম্মাদ মাসউদুর রহমান লেখক : ইবাইস ইউনিভার্সিটির খন্ডকালীন শিক্ষক সৌজন্যে : দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ