
ছবি সংগৃহীত
নামাজের পূর্ববর্তী শর্তসমূহ কী কী?
আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৫, ০৪:৩৯
মুসল্লীর জন্য যাবতীয় হাদাছ ও নাজাসাত থেকে প্রাক-পবিত্রতা অর্জন ওয়াজিব। সে পদ্ধতিতে, যা ইতোপূর্বে আমরা বলে এসেছি। আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন- তুমি তোমার কাপড় পাক রাখো। আল্লাহ তা’আলা আরো বলেছেন- যদি তোমরা জুনুবী হও তাহলে উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করো। আর ছতর ঢাকবে। কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেছেন- অর্থাত্ প্রত্যেক সালাতের সময় তোমরা এমন পোশাক পরিধান করো, যাতে তোমাদের সতর ঢাকে। এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- পুরুষের সতর হলো নাভি থেকে হাঁটুর মধ্যবর্তী অংশ। অন্য বর্ণনায় আছে- তার নাভির নীচ থেকে তার হাঁটু অতিক্রম করে যাওয়া পর্যন্ত । এ থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, নাভি সতরের অন্তর্ভূক্ত নয়। ইমাম শাফিঈ (র.) ভিন্নমত পোষণ করেন। হাটু সতরের অন্তর্ভূক্ত। এ সম্পর্কেও ইমাম শাফিঈ (র.) ভিন্নমত পোষণ করেন। হাদীছের কে আমরা সহ এর অর্থে গ্রহণ করেছি। দ্বিতীয় হাদীছের শব্দের উপর আমল করার প্রেক্ষিতে এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা.) নিম্নোক্ত হাদীছের উপর আমল করার উদ্দেশ্যে-হাটু সতরের অন্তর্ভূক্ত। স্বাধীন নারীর মুখমন্ডল ও হাতের কবজি ছাড়া সমস্ত শরীর সতর। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা.)বলেছেন- স্ত্রীলোক আওরত, যা ঢেকে রাখা কর্তব্য। দু’টি অংগকে ব্যতিক্রম করার কারণ হলো তা প্রকাশ করা অনিবার্য। হিদায়া গ্রন্থকার বলেন, এ ব্যতিক্রম স্পষ্ট নির্দেশ করে যে, পায়ের পাতা সতর আর এক বর্ণনায় আছে যে, তা সতর নয়। এ-ই বিশুদ্ধ মত। যদি কোন স্ত্রীলোক পায়ের গোছার এক-চতুর্থাংশ বা এক-তৃতীয়াংশ খোলা অবস্থায় সালাত আদায় করে তাহলে সে তার সালাত দোহরাবে। এ হল ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম মুহাম্মদ (র.) এর মত। আর যদি তা এক-চতুর্থাংশের কম হয়, তাহলে সালাত দোহরাবে না। ইমাম আবূ ইউসূফ (র.) বলেন, অর্ধেকের কম হলে দোহরাবে না। যেহেতু কোন কিছুকে তখনই অধিক বলে আখ্যায়িত করা হয়, যখন তার বিপরীত বস্তুটি পরিমাণে তার চেয়ে কম হয়। কেননা, কম ও বেশী শব্দ দু’টি তুলনামূলক। ‘অর্ধেক’ সম্পর্কে তার পক্ষ হতে দু’টি বর্ণনা রয়েছে- এক বর্ণনায় ‘কম’ এর গণ্ডি বহির্ভূত হওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করেছেন। অপর বর্ণনায় ‘বেশী’ এর গণ্ডিভূক্ত না হওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম মুহাম্মদ (র.) এর যুক্তি এই যে, চতুর্থাংশে সম্পূর্ণের স্থলবর্তী হয়ে থাকে। যেমন ‘মাথা মাসহের ক্ষেত্রে এবং ইহরামে ‘মাথা মুড়ানোর’ ক্ষেত্রে। এবং যে ব্যক্তি কারো চেহারা দেখে সে ঐ ব্যক্তিকে দেখেছে বলে খবর দেয়। যদিও সে উক্ত ব্যক্তির চারপাশের একপাশ মাত্র দেখেছে। চুল, পেট ও উরুও অনুরূপ অর্থাত্ এতেও উক্ত মতভেদ রয়েছে। কেননা প্রতিটাই আলাদা অংগ। চুল দ্বারা এখানে মাথা থেকে ঝুলে থাকা অংশ উদ্দেশ্য। এ-ই বিশুদ্ধ মত। তবে জানাবাতের গোসলে এটা ধোয়া মা’ফ হওয়ার কারণ হল কষ্ট আরোপ হওয়া। লজ্জাস্থান দু’টিতেও অংশ সতর, দাসীরও তাই সতর। আর তার পেট ও পিঠও সতর। এছাড়া তার শরীরের অন্যান্য অংগ সতর নয়। কেননা, উমর (রা.) (জনৈকা দাসীকে লক্ষ করে) বলেছিলেন, এই ছেমড়ি! মাথা থেকে ওড়না সরিয়ে নে, স্বাধীন স্ত্রী লোকদের মত হতে চাস বুঝি! তাছাড়া তাকে তার মনিবের প্রয়োজনে কাজের পোশাকে বাইরে বের হতে হয়। সুতরাং অসুবিধা লাঘবের উদ্দেশ্যে অন্যান্য পুরুষের ক্ষেত্রে তাকে মাহরেমের ন্যায় গণ্য করা হবে। যদি নাজাসাত দূর করার মতো কিছু না পায়, তাহলে তা সহই সালাত আদায় করবে। এবং সালাত দোহরাতে হবে না। এর দু’ই সুরত। যদি কাপড়ের এক-চতুথাংশ বা তার চাইতে বেশী অংশ পাক হয়, তাহলে ঐ কাপড় পরেই সালাত আদায় করবে যদি বিবস্ত্র হয়ে সালাত আদায় করে, তাহলে জাইয হবে না। কেননা এক-চতুর্থাংশ সম্পূর্ণের স্থলবর্তী হয়। যদি এক-চতুর্থাংশ কম পাক হয় তাহলে ইমাম মুহাম্মদ (র.) এর মতে একই হুকুম। আর এটা ইমাম শাফিঈ (র.) ও দু’টি মতের একটি। কেননা ঐ কাপড়ে সালাত আদায়ে একটি ফরজ তরক হয়। পক্ষান্তরে উলংগ হয়ে সালাত আদায়ে একাধিক ফরজ তরক হয়। ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম আবূ ইউসূফ (র.) এর মতে সে ইচ্ছাধীন। ইচ্ছা হলে উলংগ হয়ে সালাত আদায় করুক, কিংবা নাপাক কাপড়ে সালাত আদায় করুক। তবে দ্বিতীয়টাই উত্তম। কেননা, সক্ষম অবস্থায় প্রতিটি সালাতের প্রতিবন্ধক। এবং (মা’ফ হওয়ার) পরিমাণের ক্ষেত্রে দুটোই সমান। সুতরাং সালাতের হুকুম ও দুটোই সমান হবে। তাছাড়া কোন কিছুকে তার স্থলবর্তী রেখে তরক করায় গণ্য হয় না। (কাপড়ে পরে সালাত আদায়) উত্তম হওয়ার কারণ এই যে, সতর সালাতের সাথে খাস নয়। পক্ষান্তরে তাহারাত সালাতের সাথে খাস। কেউ যদি সতর ঢাকার কাপড় না পায় তাহলে উলংগ অবস্থায় বসে ইশারায় রুকু সাজদা করে সালাত আদায় করে, তাহলেও তার জন্য জাইয হবে। কেননা বসার মধ্যে লজ্জাস্থানের সতর হয়। আর দাড়িয়ে পড়লে উল্লেখিত রকনগুলো আদায় হয়। সুতরাং দুটোর যে কোন একটি সে গ্রহণ করতে পারে। তবে প্রথমটিই উত্তম। কেননা, সতর ঢাকা ফরজ হয়েছে সালাতের হক হিসাবে এবং মানুষের হক হিসাবে। তাছাড়া এর কোন স্থলবর্তী নেই। আর ইশারা হয়েছে রকনের স্থলবর্তী। ইমাম কুদূরী (র.) বলেন, যে সালাত শুরু করতে যাচ্ছে, সে এমনভাবে নিয়্যত করবে যে, নিয়্যত ও তাহরীমার মাঝে কোন কম দ্বারা ব্যবধানে সৃষ্টি করবে না। এ শর্তটির মূল হলো রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এর হাদীছ (যাবতীয় আমল নিয়্যতের উপর নির্ভরশীল)। তাছাড়া সালাতের শুরু হয় কিয়াম বা দাড়ানো অবস্থা দ্বারা। আরা তা অভ্যাস ও ইবাদত উভয়ের মধ্যে দোদুল্যমান। সুতরাং নিয়্যত ছাড়া এতে পার্থক্য সৃষ্টি হবে না। আর যে নিয়্যত তাকবীরের পূর্বে করা হয়, তা তাকবীরের সময়ও বিদ্যমান আছে বলে গণ্য। যদি তাকে বিচ্ছিন্নকারী কোন কিছু না পাওয়া যায়। অর্থাত্ এমন কোন কাজ, যা সালাতের উপযোগী নয়। আর তাকবীরের পরবর্তী নিয়্যত গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা নিয়্যতের পূর্বে যা বিগত হয়েছে, তা নিয়্যতহীনতার কারণে ইবাদত হবে না। সিয়ামের ক্ষেত্রে অবশ্য প্রয়োজনের কারণে তা কায়েম রাখা হয়েছে। নিয়্যত অর্থ ইচ্ছা, তবে শর্ত এই যে, নিজে অন্তরে জ্ঞাত হতে হবে যে, কোন সালাত সে আদায় করছে। মুখে উচ্চারণ করা ধর্তব্য নয়। তবে উচ্চারণ করা উত্তম। কেননা, তা ইচ্ছাকে সংহত করে। উল্লেখ্য যে, সালাত যদি নফল হয় তাহলে সাধারণ নিয়্যতই যথেষ্ট। বিশুদ্ধ। বিশুদ্ধ মতে সুন্নত সালাতেরও এ হুকুম। আর যদি ফরজ সালাত হয় তবে ফরজ নির্ধারিত হওয়া জরুরী। উদাহরণ স্বরূপ, যেমন, যুহর। কেননা ফরজ বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। আর যদি অন্য কারো মুকতাদী হয়, তাহলে সালাতের এবং ইমামের অনুগমনের নিয়্যত করবে। কেননা, ইমামের দিক থেকে তার সালাতে ফাসাদ আরোপিত হয়ে থাকে। সুতরাং তার পক্ষ থেকে এই বাধ্যবাধকতা গ্রহণ আবশ্যক। গ্রন্থকার বলেন- আর কিবলামুখী হবে। কেননা আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন- তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল মুসজিদুল হারাম অভিমুখী কর। তবে যে ব্যক্তি মক্কায় অবস্থান করছে, তার জন্য স্বয়ং কা’বামুখী হওয়া ফরজ। আর মক্কায় অনুপস্থিত ব্যক্তির জন্য ফরজ হলো কা’বার দিকের প্রতি মুখ করা। এ-ই বিশুদ্ধমত। কেননা, দায়িত্ব অর্পিত হয় সাধ্য অনুসারে। যে ব্যক্তি ভীতিগ্রস্ত হয়, সে যে দিকেই সক্ষম হয় সেদিকেই মুখ করে সালাত আদায় করবে। কেননা, ওযর বিদ্যমান থাকার কারণে। সুতরাং কিবলা অজ্ঞাত হওয়ার অনুরূপ হবে। যদি কারো জন্য কিবলা অজ্ঞাত (ও সন্দেহপূর্ণ) হয়ে পড়ে এবং তার কাছে এমন কেউ না থাকে, যাকে কেবলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে পারে। তাহলে সাধ্যানুযায়ী চিন্তা করে কিবলা স্থির করে নেবে। কেননা সাহাবায়ে কিরাম চিন্তা করে (কিবলা নির্ধারণ পূর্বক) সালাত আদায় করেছেন। আর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাদেঁর কাজ প্রত্যাখ্যান করেননি। তাছাড়া অধিকতর শক্তিশালী দলীলের অবর্তমানে প্রকাশ্য প্রমাণের উপর আমল করাই ওয়াজিব। আর সংবাদ জিজ্ঞাসা চিন্তা-ভাবনার চেয়ে অগ্রাধিকার রাখে। সালাত আদায়ের পর যদি সে জানতে পারে যে, সে ভুল করেছিলো, তাহলে সালাত দোহরাতে হবে না। ইমাম শাফিঈ (র.) বলেন, যদি কিবলার দিকে পিঠ দিয়ে থাকে, তাহলে ভুল নিশ্চিত হওয়ার কারণে সালাত দোহরাবে। আর আমাদের দলীল হল, চিন্তা-ভাবনা দ্বারা নির্ধারিত দিকের অভিমুখী হওয়া ছাড়া অন্য কিছু তার সাধ্যে ছিল না। আর দায়িত্ব অর্পন সাধ্যের উপর নির্ভরশীল। আর যদি সে সালাতের মধ্যেই তা জানতে পারে, তাহলে কিবলার দিকে ঘুরে যাবে। কেননা, কুবাবাসীরা যখন কিবলা পরিবর্তনের খবর শুনতে পেলেন তখন তাঁরা সালাতের অবস্থাতেই ঘুরে গেলেন এবং নবী করীম (সা.) তা পসন্দ করেছিলেন। তদ্রূপ যদি তার সিদ্ধান্ত অন্যদিকে পরিবর্তিত হয়ে যায় তাহলে সে সেদিকের অভিমুখী হবে। কেননা, পরবর্তী ক্ষেত্রে নতুন ইজতিহাদের উপর আমল করা আবশ্যক; তবে তাতে ইতোপূর্বে আদায়কৃত অংশ ভংগ হবে না। যে ব্যক্তি অন্ধকার রাতে কোন জামা’আতের ইমামতি করল এবং চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে কিবলা নির্ধারণ করে পূর্বমুখী হয়ে সালাত আদায় করল, আর তার পিছনে যারা রয়েছে তারাও চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে প্রত্যেক একেক দিকে সালাত আদায় করল, এমন অবস্থায় যে, প্রত্যেক ইমামের পশ্চাতে আছে এবং ইমাম কী করছেন তা তাদের জানা নেই, তাহলে তা সবার জন্য জাইয হবে। কেননা, চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে নির্ধারিত দিকে অভিমুখী হওয়া তো পাওয়া গেছে। আর ইমামের সাথে এই বিরোধ বাধা সৃষ্টি করে না। যেমন কা’বার অভ্যন্তরের মাসআলা। কিন্তু তাদের মধ্যে যে ইমামের বিপরীত অবস্থা জানতে পারে, তার সালাত ফাসিদ হয়ে যাবে। কেননা আপন ইমাম ভুলের উপর আছে বলে সে বিশ্বাস করছে। আর এ হুকুম সে ইমামের সম্মুখে হলেও। কেননা সে তার স্থানগত ফরজ তরক করেছে। মূল- শায়খুল ইসলাম বুরহান উদ্দীন আবুল হাসান আলী ইবন আবূ বকর আল-ফারগানী [রহ.] অনুবাদ- মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ গ্রন্থনা ও সম্পাদনা- মাওলানা মিরাজ রহমান