
ছবি সংগৃহীত
কারা ছিলেন হারুত মারুত, কী ছিলো তাদের অপরাধ!
আপডেট: ১৯ আগস্ট ২০১৫, ০৩:৩৫
হারুত এবং মারুত দুজন ফেরেশতার নাম। যাদেরকে বিশেষ কারণে পৃথিবীর কিছু বিষয় নিরীক্ষণের জন্য আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তারা তাদের নিরীক্ষায় অপরিণামদর্শিতার পরিচয় দেয় এবং শাস্তির মুখোমুখি হয়। ঘটনাটি এরকম- হজরত আদম [আ.] এবং বেশ কিছু নবি-রাসুলের পরলোক গমনের পর ধীরে ধীরে মানুষের মাঝে যখন পাপাচার এবং অবাধ্যতা ছড়িয়ে পড়ে তখন ফেরেশতারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলো, দেখো, মানুষগুলো কেমন অবাধ্য। তারা আল্লাহর আনুগত্য ছেড়ে পাপাচার এবং বিশৃংখলায় লিপ্ত হয়ে গেছে। আমরা যদি হতাম তবে কখনোই এমনটি করতাম না। আল্লাহ তাআলা তাদের কথা শুনে বললেন, ঠিক আছে, তবে তোমাদের মধ্য থেকে দুজনকে পৃথিবীতে পাঠাও পরীক্ষার জন্য। দেখা যাক তারা পৃথিবীতে কীভাবে নিজেদের পরিচালনা করে। এরপর আল্লাহ তাআলা হারুত-মারুত নামের দুজন ফেরেশতাকে মানুষের আকৃতি ও মানুষের স্বাভাবিক চরিত্র দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। পাঠানোর আগে আল্লাহ তাদের বলে দেন, আমি মানুষকে বিভিন্ন নবি-রাসুল বা কিতাবের মাধ্যমে পাপকাজ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিয়েছি, কিন্তু তোমাদেরকে সরাসরি উপদেশ দিচ্ছি- কখনো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না, কখনো কোনো নারীর সঙ্গে অসৎসঙ্গমে লিপ্ত হবে না, কখনো মদ্যপান করবে না। তাদেরকে তৎকালীন বাবেল (ইরাক) শহরে পাঠানো হয় এবং এই ঘটনা হজরত সোলায়মান [আ.].-এর সময়কার। পৃথিবীতে আসার কয়েকদিন পরই এ ফেরেশতাদ্বয় জোহরা নামের এক অতুল্য রূপসী নারীর রূপ দেখে পাগল হয়ে যায় এবং তাকে একান্তে কামনা করে। ওই নারী শর্ত দেয়, তোমরা যদি আল্লাহর সঙ্গে শিরক করো তবে আমি তোমাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ করবো। তারা বলে, এ কাজ আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। ওই নারী একজন লোককে দেখিয়ে আবার বলে, তাহলে ওই লোকটাকে হত্যা করো। তারা বললো, এ কাজও আমরা করতে পারবো না। অতঃপর জোহরা বললো, তাহলে একটু মদ্যপান করো তাহলে আমি তোমাদের সঙ্গে একান্তে মিলিত হবো। তারা মদ্যপানকে ছোট পাপ ভেবে জোহরার সঙ্গলাভের কামনায় বেশ কিছুটা মদ পান করে। মদপানের পর মাতাল অবস্থায় তারা ওই নারীর সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হয় এবং অচৈতন্য অবস্থায় ওই লোককেও হত্যা করে ফেলে। হুঁশ ফেরার পর তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে এবং কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করতে থাকে। তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ বলেন, তোমরা শাস্তির উপযুক্ত হয়েছো। এখন সেই শাস্তি তোমরা পৃথিবীতেও ভোগ করতে পারো আবার আখেরাতেও ভোগ করতে পারো। তারা বললো, আমরা দুনিয়াতেই শাস্তি ভোগ করতে চাই। তাদের সেই সুযোগই দেয়া হয়। তাফসিরে ইবনে কাসিরে হজরত আলি [রা.], হজরত ইবনে আব্বাস [রা.], হজরত ইবনে মাসউদ [রা.], হজরত ইবনে উমর [রা.], হজরত কাব আহবার [রা.],হজরত সুদ্দি [রহ.] এবং হজরত কালবি [রহ.]-এর বরাতে এ ঘটনা বর্ণনা করেন। বাবেল শহরে তখন জাদুবিদ্যার খুব প্রচলন ছিলো। দুষ্টু জাদুকররা নানাভাবে জাদুর মাধ্যমে মানুষকে হয়রানি করতো। ওই ফেরেশতাদ্বয় পৃথিবীতে কিছুদিন থাকার পর তারাও মানুষের মাঝে জাদুবিদ্যা শেখানো শুরু করে এবং দুষ্টু জাদুর প্রচলন ঘটায়। যে জাদুর মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিবাদ লাগতো এবং তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যেতো। হজরত সোলায়মান [আ.] নিজস্ব জ্বিনদের মাধ্যমে এই দুই ফেরেশতার সংবাদ অবগত হয়ে তাদেরকে একটি অন্ধকার কূপে বন্দি করেন। যদিও কোনো কোনো দুর্বল রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, কেয়ামত পর্যন্ত তাদের বন্দি করে রাখা হবে। সহিহ ইবনে হিব্বান, মুসনাদে আহমদ, ইবনে মারদুয়্যাহ, ইবনে জারির, আবদুর রাজ্জাক গ্রন্থে কিছু পার্থক্য ছাড়া মূল হাদিসের ঘটনা এমনই বর্ণনা করা হয়েছে। আল কুরআনের সুরা বাকারায় আল্লাহ তাআলা এই দুই ফেরেশতার ব্যাপারে আলোচনা করেছেন- وَمَا أُنْزِلَ عَلَى الْمَلَكَيْنِ بِبَابِلَ هَارُوتَ وَمَارُوتَ وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنْ أَحَدٍ حَتَّى يَقُولَا إِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلَا تَكْفُرْ فَيَتَعَلَّمُونَ مِنْهُمَا مَا يُفَرِّقُونَ بِهِ بَيْنَ الْمَرْءِ وَزَوْجِهِ وَمَا هُمْ بِضَارِّينَ بِهِ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ وَيَتَعَلَّمُونَ مَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَلَقَدْ عَلِمُوا لَمَنِ اشْتَرَاهُ مَا لَهُ فِي الْآَخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ وَلَبِئْسَ مَا شَرَوْا بِهِ أَنْفُسَهُمْ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ আর তারা অনুসরণ করেছে, যা শয়তানরা সুলাইমানের রাজত্বে পাঠ করত। আর সুলাইমান কুফরী করেনি; বরং শয়তানরা কুফরী করেছে। তারা মানুষকে যাদু শেখাত এবং (তারা অনুসরণ করেছে) যা নাযিল করা হয়েছিল বাবেলের দুই ফেরেশতা হারূত ও মারূতের উপর। আর তারা কাউকে শেখাত না যে পর্যন্ত না বলত যে, ‘আমরা তো পরীক্ষা, সুতরাং তোমরা কুফরী করো না।' এরপরও তারা এদের কাছ থেকে শিখত, যার মাধ্যমে তারা পুরুষ ও তার স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাত। অথচ তারা তার মাধ্যমে কারো কোন ক্ষতি করতে পারত না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া। আর তারা শিখত যা তাদের ক্ষতি করত, তাদের উপকার করত না এবং তারা নিশ্চয় জানত যে, যে ব্যক্তি তা ক্রয় করবে, আখিরাতে তার কোন অংশ থাকবে না। আর তা নিশ্চিতরূপে কতই-না মন্দ, যার বিনিময়ে তারা নিজদেরকে বিক্রয় করেছে। যদি তারা বুঝত। [সুরা বাকারা, আয়াত ১০২] হাফেজ মাওলানা সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর [হাফেজ মাওলানা সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর অনুসন্ধানী তরুণ লেখক। ধর্মদর্শন, ইতিহাস, ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় মিথ, ইতিহাসের আড়ালের ইতিহাস নিয়ে কাজ করে থাকেন। ইতোমধ্যেই ইতিহাসভিত্তিক তার লেখা বেশকিছু বই প্রকাশ হয়েছে। প্রকাশের অপেক্ষায় আছে আরও কিছু গ্রন্থ। ইতিহাসের জানালা তার রচিত একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ। সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর ২০০৮ সালে জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া থেকে দাওরা হাদিস সম্পন্ন করেন। ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স সম্পন্ন করেছেন দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কর্মজীবনে সহযোগী সম্পাদক ছিলেন সাপ্তাহিক লিখনীতে। বর্তমানে তিনি ফ্রিল্যান্সিং লেখালেখিতেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন।]