মলয় ভৌমিক
নাট্যকার
মলয় ভৌমিক একাধারে একজন বাংলাদেশী নাট্যকার, অভিনেতা, নির্দেশক, ও শিক্ষাবিদ। তিনি ১৯৫৬ সালের ১ মে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার কানসোনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা প্রয়াত শিবেন্দ্রনাথ ভৌমিক ছিলেন একজন কলেজ অধ্যক্ষ ও মাতা নিয়তি ভৌমিক গৃহিণী। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তার অবস্থান তৃতীয়।
মলয় ভৌমিক একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ১৯৭১ সালে ৭ নং সেক্টরের অধীনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়াও ১৯৯০ ও ১৯৯৬-এর গণআন্দোলনে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল।
১৯৯৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন। ১৯৯৬ সালে তার নেতৃত্বে রাজশাহীতে অনুশীলন নাট্যদল, উদীচী রাজশাহী জেলা সংসদ ও রাজশাহী থিয়েটার সম্মিলিতভাবে গড়ে তুলেছিলো জনতার মঞ্চ। সেখানে তিনি তৎকালীন সরকারের ভোট কারচুপি ও প্রহসনের নির্বাচনকে উপজীব্য করে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যঙ্গাত্বক স্ক্রিপ্ট লিখেন এবং তা জনতার মঞ্চে অভিনীত হত।
সরকারের মানবাধিকার পরিপন্থি কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় ২৪ আগস্ট ২০০৭, সরকারের বিশেষ বাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কয়েকজনের সাথে তাকে গ্রেফতার করে। এরপর তাকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন শেষে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১০ ডিসেম্বর ২০০৭, তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং পরে তিনি আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হন।
এছাড়াও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে টি. এস. সি. সি. নির্মাণ এবং নাট্যতত্ত্ব ও সঙ্গীত বিভাগ খোলার পিছনেও তার অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। ১৯৮৩ সালে স্কুলশিক্ষক স্বপ্না ব্যানার্জীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। তাদের একমাত্র কন্যা বর্ণনা ভৌমিক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন।
মলয় ভৌমিক ১৯৭২ সালে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার সলপ উচ্চ বিদ্যালয় হতে এস. এস. সি এবং ১৯৭৪ সালে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি কলেজ হতে এইচ. এস. সি সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগ হতে ১৯৭৭ সালে বি. কম. ও ১৯৭৮ সালে এম. কম. সম্পন্ন করেন।
মলয় ভৌমিক ম্যানেজমেন্ট বিভাগ হতে এম. কম. সম্পন্ন করার পরে ১৯৮২ সালে উক্ত বিভাগেই শিক্ষকতা শুরু করেন। ২০০৩-২০০৬ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সভাপতির দায়িত্বও তিনি পালন করেন।ছোটবেলা থেকেই তিনি পড়াশুনার পাশাপাশি সৃজনশীল অনেক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন।
মলয় ভৌমিক মূলত নাটকের মানুষ হিসেবে বেশি পরিচিত হলেও সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি দৈনিক সংবাদ এ সাংবাদিক (অবৈতনিক) হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ৯০ এর দশকে দৈনিক সংবাদে ‘উত্তরের উলুখাগড়া’ নামে ও বর্তমানে দৈনিক যুগান্তরে ‘বহে প্রান্তজন’ নামে এবং দৈনিক প্রথম আলোতে কলাম লিখেন।
মলয় ভৌমিকের নেতৃত্বে ১৯৮৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক জোট প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দীর্ঘ সাত বছর (১৯৮৪-১৯৯৩) তিনি জোটের আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত মুক্ত নাটক দলের জাতীয় কমিটির সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। তিনি বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। আই. টি. আই (ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট) বাংলাদেশ কেন্দ্রের অন্যতম নির্বাহী সদস্য তিনি।
২০১০ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্য। এছাড়াও তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল মেম্বার। তিনি ২০০০-২০০২ সাল পর্যন্ত উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এর বোর্ড অব গভরনর্স এর সদস্য ছিলেন। নাটক, সাংবাদিকতা, শিক্ষার উপরে তার উচ্চতর প্রশিক্ষণ রয়েছে এবং তিনি এ সম্পর্কিত অনেক কর্মশালা বা সেমিনার পরিচালনা করছেন।
১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত অনুশীলন নাট্যদলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মলয় ভৌমিক। তিনি ইন্সটিটিউট অব কালচার এ্যান্ড থিয়েটার ফর ডেভেলপমেন্ট-এর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তিনি ভিয়েতনাম, হংকং, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, ভারত, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, অষ্ট্রিয়া, গ্রিস, তুরস্ক সহ প্রায় ১৪ টি দেশ সফর করেন।
মলয় ভৌমিক এখন পর্যন্ত ৩৫ টির বেশি নাটকে অভিনয় করেছেন। তিনি ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বেতারে নিয়মিত নাট্যশিল্পী ছিলেন। তিনি বিটিভি ও বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনে নাট্যকার ও নাট্য শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন। তার রচিত টিভি নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আট প্রহরের গল্প, ক্ষরণ, ফেরা ইত্যাদি। আট প্রহরের গল্প, ধারাবাহিক নাটক সুন্দরি, মামুনুর রশীদ এর প্যাকেজ নাটক বিশ্বাস তার অভিনীত টিভি নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম।
তার রচিত মৌলিক নাটকের সংখ্যা ২৪ টি। এছাড়াও তিনি ৩৮ টি নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি অনুশীলন নাট্যদল এর প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম এবং বর্তমানে তিনি এর দলপ্রধান। ঐতিহ্য প্রকাশনা সংস্থা তার নাটকগুলো নিয়ে ২০১০ সালের একুশে বই মেলায় মলয় ভৌমিকের নাটকসংগ্রহ নামক গ্রন্থ প্রকাশ করে। এতে তার ১২ টি মৌলিক নাটক ছাপা হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্টাডিজ জার্নাল, ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ জার্নাল ও আল্লামা ইকবাল ওপেন ইউনিভার্সিটি জার্নালসহ অন্যান্য বিভিন্ন দেশি-বিদেশি পত্র পত্র-পত্রিকায় তার গবেষণামূলক প্রবন্ধ এবং নানা বিষয়ে অসংখ্য নিবন্ধাদি ও সৃজনশীল লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
নাটকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০১৭ পেয়েছেন মলয় ভৌমিক। এ ছাড়াও ১৯৯২ সালে ঢাকার লোক নাট্যদল নাট্যকর্মী পদক, ২০০৮ সালে মুনির চৌধুরী সম্মাননা, ২০০৯ সালে আরণ্যক নাট্যদল কর্তৃক আরণ্যক দীপু স্মৃতি পদক সহ আরও অনেক সম্মাননা প্রাপ্ত হন।