আতিক উজ জামান
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসায় কর্মরত বাংলাদেশি বিজ্ঞানী
বাংলাদেশের নরসিংদীর সন্তান বিজ্ঞানী আতিক উজ জামান কাজ করছেন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসায়। বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে মানুষের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। নানা পথ ঘুরে পাড়ি জমিয়েছিলেন গবেষণার তীর্থভূমি আমেরিকায়। একসময় তিনি সারা দুনিয়ার বিজ্ঞানীদের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান নাসার সঙ্গে যুক্ত হন। বাবা সরকারি কর্মকর্তা বলে নিজে পড়াশোনা করেছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। আবার নানান দেশে থাকার কারণে তাঁর সন্তানেরা একেক সময় একেক দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর জীবনে বৈচিত্র্যময় গল্প রয়েছে।
আতিকের বাবা বিচারক ছিলেন। ফলে শৈশবে তাঁর পড়াশোনা করতে হয়েছে নানান স্কুলে। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, 'আমি তো পড়াশোনা করেছি সেন্ট যোশেফ হাইস্কুলে মোহাম্মদপুর। আমরা থাকতাম তখন শেরেবাংলা নগরে। আমরা যখন ঢাকা ছিলাম আমার আব্বা ন্যাশনাল অ্যাসেম্বিলিতে অ্যাসিটেন্ট সেক্রেটারি ছিলেন। তারপর সেন্ট যোশেফে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ার পর ধানমন্ডি গভমেন্ট বয়েজ হাইস্কুলে, ছয় মাস নাইনে, তারপর আব্বা বদলি হয়ে যান ময়মনসিংহ। তারপর মেট্রিক পাস করি ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে। তারপর বাবা বদলি হয়ে যান সিলেটে। তারপর আমি ইন্টারমিডিয়েট পাস করি সিলেট গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে। সিলেট বোর্ডে চতুর্থ ছিলাম। মেট্রিকেও চতুর্থ ছিলাম, কুমিল্লা বোর্ডে। তারপর আব্বা বরিশালে বদলি হয়ে যান। আমি তখন বুয়েটে ভর্তি হই। বুয়েটে পাস করে বুয়েটে জয়েন করি।'
তিনি বুয়েটে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়াশোনা শেষ করেন ১৯৮২ সালে। এরপর বুয়েটের লেকচারার ছিলেন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে। এ সময় কমনওয়েলথ স্কলারশিপে পড়াশোনা করতে যান (মাস্টার্স আর পিএইচডি) ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারে। ওখান থেকে মাস্টার্স, পিএইচডি করে দেশে ফিরে এসে আবার বুয়েটে যোগ দেন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে। ছয় মাস বুয়েটে পড়ানোর পর শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে চলে যান সৌদি আরবের কিং ফাহাদ ইউনিভার্সিটিতে। ওখান থেকে ইমিগ্রেশন নিয়ে চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। ওখানে গিয়ে চাকরি পেয়ে যান মেলবোর্নের মনাশ ইউনিভার্সিটিতে। ওটাকে বলা যায়, ‘টপ এইট’ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। ওখানে পড়াতে পড়াতেই তিনি কিছু কিছু কাজ শুরু করেন কমিউনিকেশন নেটওয়ার্কিং নিয়ে।
কিন্তু নিজের ইচ্ছাতেই এখানে খুব বেশি দিন থাকা হয়নি তার। যার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, 'অস্ট্রেলিয়া এমন একটা দেশ যেখানে খুব বেশি রিসার্চ করার সুযোগ নেই, বেশিরভাগ বড় রিসার্চগুলো হয় মূলত ইউরোপ আর আমেরিকায়। তখনই আমি ঠিক করি রিয়েল কাজ করতে হলে যা সোসাইটির কাজে লাগবে, আমাকে আমেরিকা-ইউরোপের দিকে যেতে হবে, ন্যাচারালি, এসব কারণেই আমি আমেরিকাতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
'প্রথমে চাকরি নিলাম ওহাইয়োতে ইউনিভার্সিটি অব ডেটন। ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। ওখানে থেকেই আমার সঙ্গে নাসার যোগাযোগ তৈরি হয়। ক্লিভল্যান্ডের নাসার একটা সেন্টার আছে, যার নাম গ্লেন রিসার্চ সেন্টার , ওই সেন্টারে নাসা কমিউনিকেশনের কাজটা করে, অর্থাৎ আমি যে ধরনের নেটওয়ার্কিংয়ের কাজ করি, এরকম আরও অনেক সেন্টার আছে নাসার, যেখানে নাসার স্পেস কার নিয়ে গবেষণা হয়, অমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্লেন সেন্টারের দূরত্ব ছিল তিন-চার ঘণ্টা, আমার পক্ষে বড় সুবিধা ছিল আমি চাইলেই গাড়ি ড্রাইভ করে হাজির হয়ে যেতে পারতাম ওদের ওখানে এবং সরাসরি কথা বলতে পারতাম ওদের সঙ্গে। খোঁজখবর করতাম ‘কী ধরনের কাজকর্ম তোমরা করছো, আমি কীভাবে তোমাদের হেল্প করতে পারি এসব আরকি।’ দ্যাটস হাউ আই স্টারটেড।'
নাসাতে আতিকের প্রথম প্রকল্প
নিজের প্রথম প্রকল্প নিয়ে আতিক বলেন, 'ইন্টারনেটে মহাশূণ্য যানের সঙ্গে কিভাবে কমিউনিকেট করা যায়, খুব ইম্পরটেন্ট কাজ। সহজভাবে বলি, আপনি যখন স্কাইপে কথা বলেন, তখন কথা স্পষ্ট হতে হবে অর্থাৎ কথা বলার সময় ডিলেটা কম হতে হবে, ডিলে বেশি হলে তো হবে না, আপনি একটা বললেন অনেকক্ষণ লাগল অন্যপ্রান্তে যেতে। আপনি হ্যাঁ হুঁ করছেন, কথা ভেঙে যাচ্ছে, কাজেই এই ডিলেটা খুব ইম্পরটেন্ট, এর সঙ্গে আরেকটা ব্যাপার হলো যে ব্যান্ডউইথ, ব্যান্ডউইথ হলো ডিলে না কিন্তু কথা ভেঙে যাচ্ছে। আরেকটা হলো যে, আপনার ডাটাটা লস হয়ে যায় কিনা, ওই লস হয়ে গেলে কথা থেকে যায়, এই তিনটি জিনিস ইম্পরটেন্ট, এই তিনটিকে বলে কোয়ালিটি অব সার্ভিস। আপনি যদি কারও সঙ্গে কথা বলেন, ডিলে কম হতে হবে, আর এনাফ ব্যান্ডউইথ থাকতে হবে মানে ক্যাপাসিটি থাকতে হবে; আর আপনার কথাবার্তা যেন ড্রপ হয়ে না যায়, লস না হয়।
তো আমাদের প্রথম কাজ শুরু হয়, ইন্টারনেটে যদি কানেক্ট করতে হয় স্পেসে, তাহলে এই কোয়ালিটি অব সার্ভিসটা কেমন করে নিশ্চিত করা যেতে পারে। প্রথমে এই ব্যাপারটা নিয়েই কাজ শুরু করি। তো ওই প্রজেক্ট শেষ হওয়ার পর এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরেকটা প্রজেক্ট এসে যায়।'
নাসাতে আতিকের দ্বিতীয় প্রকল্প
'প্রথম প্রজেক্টে আমরা ছিলাম চারজন। সবাই আমেরিকান। সেকেন্ড পার্টে আমরা যেটা করি একজেক্টলি এর কন্টিনিশন না, এক এর রিলেটেড বলা যায়। এটা ছিল উড়োজাহাজের কমিনিউকেশন, ককপিটের সঙ্গে যে এন্টেনা থাকে, সেটা কমিউনিকেট করে বাইরে থেকে আসা ডাটা ডাউনলোডের মাধ্যমে, এটা কমিনিউকেট করে স্যাটেলাইটের সঙ্গে । এই কমিনিউকেশন হয় কোয়ার্সেল ফাইবার দিয়ে।
কোয়ার্সেল ফাইবার আপনারা চেনেন, টিভির ডিস সংযোগ দেওয়া হয় যে তার দিয়ে। ওটাই কোয়ার্সেল কেবল। এখন আপনি যদি অনেকগুলো এন্টেনা বসান টিভিতে, আরও নতুন নতুন এন্টেনা বা সেন্সর বসান। আজকাল তো খুব সেন্সর বসাচ্ছে চারিদিকে। তাহলে কিন্তু অনেক তার টানতে হবে। এই কোয়ার্সেল ফাইবারগুলো খুব মোটা মোটা হয়।
প্লেনে কী হয়? বেশি তার হলে প্লেনের ওজন বেড়ে যায়। প্লেনের জন্য এটা একটা প্রবলেম, আরেকটা বিষয় আছে কেবলগুলো যদি সব একসঙ্গে করে দেন তাহলে আবার একটার সঙ্গে আরেকটার সিগনাল ইন্টারফেয়ার করবে, সিগনাল ইন্টারফেয়ার করলে সিগনাল লস হয়ে যাবে, ইনফরমেশন নষ্ট হবে। আর প্লেনের ভেতরে সিগনাল লস হওয়া মানে ডেনজারাস সমস্যা, বিশাল বিপদ হয়ে যাবে, জেনারেলি ইনফরমেশন লস হলে খুব একটা সমস্যা নেই কিন্তু প্লেনে তো বিপদ ঘটতে পারে। তবে যোগাযোগের শক্তি বাড়াতে হলে কোয়ার্সেল ফাইবার একটা বাধা। তাই নাসা চিন্তা করেছে যে ওই কোয়ার্সেল কেবল ফেলে দিয়ে একে কীভাবে অপটিক্যাল ফাইবার করা যায়।'
নাসাতে আতিকের তৃতীয় প্রকল্প
'তৃতীয় প্রজেক্ট ছিল ইন্টারনেট যদি স্পেসশীপের সঙ্গে কানেক্ট করি, তাহলে সেটা কীভাবে কানেক্ট করবো? মহকাশে স্যাটেলাইটগুলোতে সব সময় মুভ করছে। এই মুভমেন্টে থাকলে স্যাটেলাইট কানেক্টিভিটি কীভাবে অটুট রাখা যাবে। এটা বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ। কারণ স্যাটেলাইট কমিনিউকেট করে নিচের গ্রাউন্ড স্টেশনের সঙ্গে। যখন মুভ করে তখন কন্টাক্ট থাকে না। তখন যা হয় নিচে ডাটাগুলো স্টোর হতে শুরু করে। তারপর ঘুরতে ঘুরতে যখন আবার সংযোগ স্থাপন হয় আবার ডাটা স্টোর হতে শুরু করে। এই স্টোরিংয়ের কাজে প্রচুর টাইম লেগে যায়। এখন এমন যদি হয়, ডাটা যদি হয় রিয়েল টাইম, মানে সঙ্গে সঙ্গে জানাল। তাহলে বিরাট ব্যাপার হয়। এটা করার জন্য কী করতে হবে সব গ্রাউন্ড স্টেশন কাছাকাছি রাখতে হবে। কিন্তু এটা তো প্রায় অসম্ভব। এবং খুব এক্সপেনসিভও। তো ডাটা সরবরাহ কিভাবে কন্টিনিউ রাখা যায় সেটা নিয়েই আমরা অনেক বছর কাজ করছি। প্রায় ছয়-সাত বছর। আমরা এ সময়ে কিছু কিছু টেকনিক বের করেছি, কন্টিনিউয়াসলি যাতে কানেক্টিভিটি রাখা যায়। সেসবের কিছু কিছু আর্কিটেকচার করে আমরা নাসাকে দেখিয়েছি। আরও প্রপোজ করেছি। ওদের যখন প্রপোজ করা হয়, ওরা তখন বলে টেস্ট করে দেখাও, সম্ভব কিনা, একে বলে প্রোটোটাইপিং। এগুলো আমরা অনেক করেছি। আমরা সাকসেস। কিন্তু এটা এখনকার টেকনোলজিতে পারা যাবে না। কারণ এখনকার স্যাটেলাইটগুলো একদিকে মুখ করে থাকে। মুভ করে না।
নিজের পরিবার সম্পর্কে আতিক বলেন, 'আমি বিবাহিত। আমার মেয়ে চাকরি করে আমেরিকাতে, ছেলে ইউনিভার্সিটিতে তৃতীয় বর্ষে, আমার মেয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পাস করেছে জর্জিয়াটেক থেকে, আটলান্টাতে এখন কাজ করে একটা কোম্পানিতে, ডেক্সটন বলে। আমার স্ত্রীও বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পাস করেছে। আমার ছেলে কম্পিউটার সাইন্সে পড়াশোনা করছে আমাদের ইউনিভার্সিটিতে। আমরা চারজনই ইঞ্জিনিয়ার।'
আতিকের মেয়ের জন্ম হয়েছে সৌদি আরবে, ছেলের জন্ম হয়েছে অস্ট্রেলিয়াতে। ওরা বাংলাদেশের সঙ্গে কতটা পরিচিত এমন প্রশ্নের উত্তরে আতিক বলেন, 'আমরা বাসায় সব সময় বাংলা বলি। বাসায় সব সময় বাঙালি খাবার-দাবার খাই। ওরা বাংলা লিখতে পারে না, পড়তে পারে একটু একটু বড় হেড লাইন। কিন্তু বাংলায় কথা বলে। মানে আমরা পুরোই বাঙালি বলতে পারেন। বাংলাদেশ ওদের খুব পছন্দ। ওরা খুব ইন্টারেস্টিং মনে করে, এনজয় করে দুয়েকটা জিনিস ছাড়া: ট্রাফিক আর মশার কামড় এগুলো ওরা সহ্য করতে পারে না। এছাড়া খাবার-দাবার তারপর এখানে কাজের লোক আছে লাইফ কমফোরটেবল, দাদা-দাদি আছে খুব আদর করে। এসব খুব পছন্দ করে, ওখানে তো এসব পায় না'।