
মাদক নিরাময় কেন্দ্রে কিছু তরুণ। সংগৃহীত ছবি
যে কারণে ভয়াবহভাবে বাড়ছে ইয়াবা আসক্ত তরুণ-তরুণীর সংখ্যা
আপডেট: ০৬ আগস্ট ২০১৭, ১৮:২৭
(প্রিয়.কম) ২০১৩ সালে ঐশীর বয়স ১৭ বছর। বাড়ন্ত বয়সে ইয়াবায় আসক্ত হয় সে। এ সময় তার চালচলনে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করেন বাবা-মা। তারা ঐশীর কাছ থেকে তার মোবাইল কেড়ে নেন। এতে রেগে গিয়ে সে তার বাবা-মার কফিতে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়। এর পরের ঘটনা সবার জানা...
শুধু ঐশী নয়, তার মতো দেশের অনেক তরুণ-তরুণী দিন দিন আসক্ত হয়ে পড়ছে মরণনেশা ইয়াবাতে। আর এই সংখ্যা ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে চলছে যা ভবিষ্যতে বন্ধ করা দুষ্কর হয়ে পড়বে, এমনটাই বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন'র এক প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি জরিপের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে, দেশে ইয়াবায় আশক্ত হওয়ার হার দিন দিন ভয়াবহভাবে বেড়ে চলছে। জরিপে দেখা গেছে, ২০০২ সালে কক্সবাজারে ২০ হাজার মানুষ মাদকে আসক্ত ছিল। তবে তারা কেউ ইয়াবা সেবন করত না। তারা সেই সময়ে গাঁজা এবং হেরোইন সেবন করত। কিন্তু ২০০৭ সালে দেশের সবখানে ছড়িয়ে পড়ে ইয়াবা। ২০১৬ সালে আবার ওই জরিপ চালানো হয়। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ ওই একই জেলায় মাদক সেবনকারীর সংখ্যা ৮০ হাজারে পৌঁছে যায় এবং এদের ৮০ শতাংশই ইয়াবা সেবন করে থাকে।
দেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ২০১৪ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশের মাদক সেবনকারীদের ৮৮ শতাংশের বয়স ৪০ বছরের নিচে। এ ছাড়া চলতি বছরে সিলেটে শহরে চালানো এক জরিপ অনুযায়ী, ৫৫ শতাংশ মাদক সেবনকারীর বয়স ২২-২৯ বছর।
মাদক নিরাময় কেন্দ্রে থাকা রাফি নামে এক তরুণ বলেন, ভেনিলা ঘ্রাণের ইয়াবার স্বাদ ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এটি পানে বুকে গরম লাগে এবং পরে সাড়া শরীরে ছড়িয়ে যায়।
রাফি জানান, তিনি যখন একটি ডিজে পার্টিতে অংশ নেওয়ার সময় প্রথম ইয়াবা সেবন করেন। এটি তাকে সাড়া রাত জেগে থাকতে সাহায্য করেছিল। পরে ধীরে ধীরে তিনি এতে আসক্ত হয়ে পড়েন।
তিনি বলেন, সারা দিনের কাজ শেষে সন্ধ্যায় আমি আমার বন্ধুসহ তার বাসায় যেতাম। যিনি ইয়াবা বিক্রি করতেন তিনি আমার বন্ধুর বাসায় ইয়াবা পৌঁছে দিতেন। এ সময় আমরা ইয়াবা পান করতাম এবং দুজনে বসে বসে প্লে-স্টেশনে ফিফা গেম খেলতাম। এইভাবেই আমার কয়েক বছর কেটেছে।
কাশেম নামে অপর একজন জানান, ১৯৯০ সালের দিকে মাদক বলতে আমরা গাঁজা বা হেরোইনকে বুঝতাম। সেই সময়ে আমার চেনা-জানার মধ্যে ৫-১০ শতাংশ মাদক গ্রহণ করত। তবে বর্তমানে তরুণদের অর্ধকেই ইয়াবায় আসক্ত।
তিনি বলেন, যখন কোনো নতুন মাদক দেশে প্রবেশ করে অনেক মানুষই তা গ্রহণে আগ্রহী হয়। ইয়াবা হেরোইনের চেয়ে ভালো। কারণ হেরোইন শরীর দুর্বল করে আর ইয়াবা সিংহের মতো শরীর শক্তিশালী করে।
কাশেম বলেন, আমি এখন আমার সন্তানকে নিয়ে নিজেই চিন্তিত। আমি আমার বড় ছেলেকে কাজের জন্য সৌদি পাঠিয়েছি। কারণ সেখানে মাদক পাওয়া সম্ভব নয় এবং সে আমার মতো নেশাগ্রস্ত হবে না।
সিএনএন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের এলিট পরিবারের বিভিন্ন সদস্যরা প্রথমে এই ইয়াবাকে বেছে নেয়। এর পর থেকে এটির বিস্তার লাভ করতে থাকে।
মাদক অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের তরুণ-তরুণীরা ইয়াবাকে স্মার্টনেস, ফ্যাশন, আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে মনে করে। এ ছাড়া দেশের অনেক মডেল, চলিচ্চিত্র অঙ্গনের নায়িকারা, গায়করা এই ইয়াবা গ্রহণ করে থাকে।
গত বছর সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশের সময় ২৯ মিলিয়ন ইয়াবা আটক করেছে দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যরা। ভয়ঙ্কর তথ্য হলো এই সংখ্যা ২০১০ সালে বাজেয়াপ্ত ইয়াবার সংখ্যার চেয়ে ৩৫গুণ বেশি।
১৯৯০ সালে মিয়ানমারের মাদক সম্রাটেরা হেরোইন বানানো থেকে সরে আসেন। তারা ইয়াবা বানানোর দিকে মনোনিবেশ করেন। কারণ ইয়াবা আকারে ছোট ছিল এবং সহজেই এটি বহন করা যায়।
যারা এই ইয়াবা ব্যবসা শুরু করেন তারা এর কিছু ভিন্ন নাম দেন। বাংলাদেশে ইয়াবার মধ্যে আর সেভেন খুব জনপ্রিয়। জানা যায়, একটি 'আর সেভেন' ইয়াবা বড়ির দাম বাংলাদেশি টাকায় ৯০০ টাকা। এর চেয়ে কম মূল্যে পাওয়া যায় পিংক চম্পা। এর মূল্য বাংলাদেশি টাকায় ৩০০ টাকা। 'কন্ট্রোলার' নামে ইয়াবা বড়িটির দাম সবচেয়ে বেশি, এর এক একটির মূল্য ২ হাজার টাকা।
চীন এবং থাইল্যান্ড সীমান্তে কড়া নিরাপত্তা জারি করা হয় মিয়ানমারের ইয়াবা ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশকে তাদের আদর্শ মার্কেট হিসেবে বেছে নেয়। এজন্য তারা দেশের সমুদ্র বন্দরগুলোকে বেছে নেয়।
দেশে ইয়াবা বিস্তারে দেশের সীমান্তরক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য জড়িত রয়েছে বলে মনে করেন কক্সবাজার জেলার আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সরওয়ার কবরী।
তিনি বলেন, আমাদের সরকার ইয়াবা ঠেকাতে বদ্ধ পরিকর, তবে সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু জুনিয়র কর্মকর্তা এইসব কাজে জড়িত। কিছু বর্ডার গার্ড সদস্য মাদক পারাপারের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ কিছু অর্থ নিয়ে থাকেন। ওইসব সদস্যদের খুঁজে বের করা খুব কঠিন।
তবে নাজনীনের এই বক্তব্যকে নাকচ করেছেন কক্সবাজার মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তা সুমন মন্ডল। তিনি বলেন, আমি এখন পর্যন এই ধরনের কোনো অভিযোগ পাইনি।
কবরী বলেন, ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান করলে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। একই সঙ্গে মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্র বাড়ানো উচিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বেসরকারি ভাবে ৬৮টি মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্র থাকলেও সরকারিভাবে চলে মাত্র ৫টি কেন্দ্র।
প্রিয় সংবাদ/রিমন