
মাশরাফি বিন মুর্তজা। ছবি: প্রিয়.কম
‘এই ক্রিকেটই একটা সময় শূন্য হয়ে যাবে’
আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৭, ২০:৩৬
(প্রিয়.কম) ‘ক্রিকেট মানেই জীবন নয়’- বহুবার এমনটি বলতে দেখা গেছে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে। কিন্তু তার মাঠের লড়াই আর বারবার ইনজুরি থেকে ফিরে আসার যে অদম্য ইচ্ছা, সেটা প্রমাণ করে ক্রিকেট মাশরাফির কাছে জীবনের চেয়েও বেশি কিছু। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ১৭ বছরে ক্রিকেট নিয়ে যতোটা ভেবেছেন, তার চেয়ে বেশি ভাবতে হয়েছে ইনজুরি নিয়ে। দুই হাঁটুতে সাতটি অস্ত্রোপচার।
এখনও ঘুম ভাঙলে আগে নজর দিতে হয় হাঁটুর দিকে। উপর-নিচ করে একটু স্বাভাবিক করে নিতে হয় হাঁটু। কিন্তু সবুজ মাঠ আর মাঠের ২২ গজ সব ব্যথা ভুলিয়ে দেয় মাশরাফিকে। নি গার্ডটা হয়ে উঠেছে নিত্যসঙ্গী। ডাক্তার বলেছিলেন এত অস্ত্রোপচার করালে একটা সময় গিয়ে পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন। তবুও আটকানো যায়নি তাকে। বারবার ফিরে এসেছেন ২২ গজে। উজাড় করে দিয়েছেন নিজের সবটা।
ক্রিকেটের শুরু, ক্রিকেট দর্শন, মাশরাফির মাশরাফি হয়ে ওঠা, ইনজুরির কারণ, পরিবার, বন্ধু, অনুপ্রেরণা, শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তার কোচ, ভক্তদের থেকে পাওয়া ভালবাসা, এমনও অনেক বিষয় নিয়ে প্রিয়.কমের সাথে দীর্ঘ আলাপচারিতা হল বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়কের। তাকে নিয়ে বই বেরিয়েছে, ছাপা হয়েছে অনেক সাক্ষাৎকার। তবুও নতুন কোনও তথ্যের সন্ধান মিলতে পারে এই সাক্ষাৎকারে। প্রিয়.কমের পাঠকদের জন্য পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শান্ত মাহমুদ-
- সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে দুটি প্রশ্ন। দ্বিতীয় দফায় অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর এটাই আপনার জন্য সবচেয়ে হতাশার সিরিজ কি না?
মাশরাফি বিন মুর্তজা: হ্যাঁ, রেজাল্টে তাই বলে। রেজাল্টে নিউজিল্যান্ড সিরিজও আসে। কিন্তু ভাল ক্রিকেট খেলার কথা বললে এটাই আসে। আর রেজাল্টের হিসাবে নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা দুটিই আসে।
- পুরো সিরিজে সমস্যাটা আসলে কোথায় ছিল? মানসিক নাকি কৌশলগত?
মাশরাফি: কৌশলগত বেশি। মানসিক আরও বেশি। আমি বলব মানসিকভাবে বেশি সমস্যা ছিল আমাদের।
- আপনার ক্রিকেটে আসার গল্পটা কেমন ছিল?
মাশরাফি: ক্রিকেটে আসার গল্প তো আসলে অনেক বড়। সিজনাল খেলোয়াড় ছিলাম। টেনিস, টেপ টেনিস এসব খেলতাম। বড় ভাইরা খেলতেন, উনারা পুশ করতেন ক্রিকেট বলে আসার জন্য। তারপর অনূর্ধ্ব-১৭ খেলি। প্রথমবারের মতো খুলনা মোহামেডানের হয়ে একটা ম্যাচ খেলতে যাই। আমার নানা সেক্রেটারি ছিলেন তখন। উনাদের খেলোয়াড়স্বল্পতা ছিল। তো আমাকে নিয়ে যান। আর ওই ম্যাচে আমি ছয় উইকেট পাই। তারপর থেকে শুরু হয়ে গেল। ওটা সম্ভবত ১৯৯৯ অথবা ২০০০ সাল ছিল। যে বছর আমি অনূর্ধ্ব-১৭ খেলি ওই বছরই।
- ছোট বেলা থেকেই ব্যাপারটি এমন ছিল যে, ক্রিকেটার হবেন?
মাশরাফি: না, আসলে তা না। বলতে গেলে আমার কোনও লক্ষ্য ছিল না। লক্ষ্য ধরে ধরে এগোনো এমন কোনও কিছু ছিল না আমার বেলায়।
- মাশরাফি যে মাশরাফি হয়ে উঠল, এখানে কার অবদান সবচেয়ে বেশি। স্বাভাবিকভাবে অনেকেই আছেন। কিন্তু একজনের কথা বলতে বলা হলে কার কথা বলবেন?
মাশরাফি: আমার ক্ষেত্রে একজনের অবদান বলা কঠিন। তবে সেভাবে বলতেই হলে আমার নানির কথা বলব।
- অনেকেই যে আপনার নানার কথা বলেন?
মাশরাফি: ডিসিশনটাই ঠিক করে দিয়েছেন আমার নানী। তারপর অনেকে সাহায্য করেছেন। তবে তারা আগে পিছিয়ে ছিল, ক্রিকেট খেলতে দিতে চাইতেন না। কিন্তু নানীর কথার ওপর কেউ কথা বলতো না বলেই আমার ক্রিকেট খেলা হয়েছে।
- আপনার লক্ষ্য ছিল না, কিন্তু যখন ক্রিকেটার হয়ে গেলেন, তখন ক্রিকেটাই আপনার সবকিছুতে পরিণত হয় কি না?
মাশরাফি: না, পুরোপুরি না। আমাদের সময় অর্থাৎ আমরা যখন শুরু করি অত প্রোফেশনালিজম ছিল না। আমরা ২০০০ সালে টেস্ট ক্রিকেট খেলতে পারি, কিন্তু এখনকার মতো পেশাদারিত্ব ছিল না। সুযোগ-সুবিধা বা যাই বলেন এমন ছিল না। ডে বাই ডে, আস্তে আস্তে এটা হয়েছে। তবে সেটা অনেক পরে এসে। ঠিক করে বলতে পারব না কবে, তবে অনেক পরে এসে হয়েছে।
- ক্রিকেট তাহলে আপনার কাছে কেমন?
মাশরাফি: ক্রিকেট আমার কাছে অবশ্যই অনেক বড় ব্যাপার। ছোট করে উত্তর দেওয়া তো কঠিন। ক্রিকেট খেলেই তো সব হয়েছে আমার। আর ক্রিকেট থেকেই সব পেয়েছি। তবে একটা জায়গায় থামতে হবে জানি। ওই সময়ের পরে এই ক্রিকেটই আবার শূন্য হয়ে যাবে। ১৭ বছর টেনে আসছি, একটা জায়গায় গিয়ে থামতে হবে। তখন এই পার্টটাই শূন্য হয়ে যাবে। তো মাথায় ওটাও সব সময় কাজ করে যে দিনশেষে এটাই জীবন না। আবার এটাই আমাকে সবকিছু দিয়েছে এটাও ঠিক।
- ক্রিকেট খেলতে হলে একজন ক্রিকেটারের মধ্যে কোন ব্যাপারটা থাকা ভীষণভাবে জরুরি?
মাশরাফি: ডিসিপ্লিন এবং ফিটনেস। দুটিই খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনেকরি ব্যক্তিগত জীবনের শৃংখলা খুব বেশি জরুরি। আমার মনেহয় বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় বা তাদের গ্রেড থেকে নেমে এসে যদি এভারেজ খেলোয়াড়ের গ্রেডেও আপনি চিন্তা করেন, দেখবেন দুই-একজন ছাড়া বাকিরা তাদের ব্যক্তিগত জীবনে অনেক গোছালো। তারা মাঠ এবং মাঠের বাইরে সংযত। তাদের ডিসিপ্লিন, অ্যাক্টিভিটিস বা অনুশীলনের শিডিউল যদি দেখেন, দেখবেন একটা রুটিন নিয়ে চলে তারা। এই কম্বিনেশনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- ১৭ বছর পার করে দিলেন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের। এর মধ্যে অনেকবার ইনজুরিতে পড়েছেন। এই সময়ে এসে কী মনেহয়, এত ইনজুরির কী কারণ?
মাশরাফি: ওই তো আগেই বললাম, আমরা এত প্রফেশনাল ছিলাম না। ম্যাচ খেলতাম, আর খেলেই ট্রাভেল করে বাড়ি চলে যেতাম। যে বিশ্রাম নেওয়ার দরকার ছিল, সেটা নেওয়া হয়নি। আমাদের সময় আমরা ছয় বছর পর, ২০০৬ সালে এসে প্রথম জিমনেশিয়াম পাই মিরপুর স্টেডিয়ামে। তার আগে আমাদের সোনাওগাঁও হোটেলে নিয়ে যাওয়া হতো জিম করানোর জন্য। কিন্তু সেটাও মাঝেমধ্যে। ২০০৬ সালে যখন স্টুয়ার্ট কার্পেনিন আসেন, প্রথম আমাদের আর্মি স্টেডিয়ামের জিমে নিয়ে যান। তো বোঝাই যায় ক্যারিয়ার শুরু ২০০১ সালে আর জিম করার ধারণা শুরু হয় ২০০৬ সালে এসে। এর মধ্যে অর্থাৎ, ২০০৬ সালের মধ্যে আমার কয়েকটা ইনজুরি হয়ে গেছে। তবু ২০০৩ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত এই পাঁচ বছর আমি খুব ফিট ছিলাম। হয়তো বয়সের কারণে ফিট ছিলাম, সেটা হতে পারে। এরপর ২০০৮, ০৯, ১০ ও ২০১১ এই চার বছর পরপর আমার তিনটা অপারেশন হয়। এখান থেকে আমার বলের পেস কমে, আরও অনেক কিছু হয়। তবে ২০১১ থেকে আমি আবার গোছোনো শুরু করি। কিন্তু এটা দেরি হয়ে গেছে তত দিনে। সব মিলিয়ে আমার মনেহয় প্রফেশনালিজম ছিল না। কিন্তু এখন অনূর্ধ্ব-১৬ থেকে ওদের গাইডলাইন থাকে, ওদের ফিজিও, কোচ, ট্রেনার সবকিছু আছে। আমার কাছে মনেহয় আমার ইনজুরির একটা বিরাট কারণ ছিল ট্রাভেলিং করা। খেলা বা অনুশীলন শেষ করে বাড়ি চলে যাওয়া বা দুইদিনের ছুটি পেয়েছি বাড়ি চলে গিয়েছি। এতে যে শারিরিক ঘাটতি হতো ওটা একটা বড় কারণ। আর ভাগ্যের ব্যাপার তো আছেই। এমন তো অনেকেই করছে, কিন্তু ওদের হচ্ছে না।
দুই সতীর্থের কাঁধে ভর দিয়ে মাঠ ছাড়ছেন মাশরাফি। ছবি: সংগৃহীত
- বারবার ইনজুরি থেকে ফিরে এসেছেন। এ পথে আপনার অনুপ্রেরণা কী? বা কোনও অনুপ্রেরণা আছে কি না?
মাশরাফি: না, আসলে এত কিছু ভাবিনি। যখন কিছু ভাববেন না তখন কাজ সহজ। ইনজুরি হয়েছে তো হয়েছে। সুস্থ হতে হবে, এটাই কাজ। যা প্রসেস সেটাই করেছি। এর বাইরে কীভাবে কামব্যাক করব, কী হবে না হবে এসব নিয়ে ভাবিনি। ওই যে বললাম, জীবন নিয়ে বেশি ভাবলে জটিল হয়ে যাবে। আমি জানি না, আমার কাছে এমন মনেহয়। একেক জনের স্টাইল হয়তো একেক রকম। অনেকে মনে করে কাল কী আছে ভাবলে সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু আমার কাছে কঠিন মনেহয়। আমার মনেহয় হয় কাল যেটা আছে সেটা কালই বোঝা যাবে। তবে প্রস্তুতি থাকাটা জরুরি। সবকিছুর জন্যই প্রস্তুতিটা জরুরি।
- এত ইনজুরি, এত বাধা- কখনও কি মনে হয়েছে আর ক্রিকেটই খেলব না?
মাশরাফি: না, কখনোই এমন মনে হয়নি। যেটা বললাম ক্রিকেট আমার কাছে অনেক বড় একটি জায়গা। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় জায়গা নিয়েই ক্রিকেট। হওয়াটাই স্বাভাবিক। ক্রিকেট খেলে যাওয়ার ইচ্ছাটা শুরুতে যতটুকু ছিল এখনও ততটুকুই আছে।
- আপনাকে প্রায়ই একটা কথা বলতে দেখা যায়, ক্রিকেট মানেই জীবন নয়। কিন্তু আপনার লড়াই, বারবার ইনজুরি থেকে ফিরে আসা দেখে মনেহয় কখনও কখনও ক্রিকেট আপনার কাছে জীবনের চেয়েও বেশি। এটা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মাশরাফি: ওটা তো আলাদা জিনিস। ওটা আমার প্রফেশন, আমার ভাল লাগা। ক্রিকেট তো একটা জায়গায় থাকেই, এটা আমার জীবনের অংশ। আমি এই জন্য বলি ক্রিকেটটা জীবন না, কারণ আল্লাহ যদি আপনাকে ৭০ বছর বাঁচিয়ে রাখেন, আপনি নির্দিষ্টভাবে ক্রিকেট খেলছেন কত বছর। যদি সিরিয়াসভাবে ক্রিকেট খেলেন তাও ১৫ বছর। কারও ক্ষেত্রে হয় ১৮ বছর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৫, ৭ বা ১০ বছরের ক্যারিয়ার হয়। এ জন্যই বলি একজন মানুষ যদি ৬০-৭০ বছর বাঁচে তার তো ওই ১৭ বছরই জীবন না। আমার জন্ম হয়েছে, আমি বোঝা শুরু করেছি, আমার বাবা-মার সাথে আমার যে মুহূর্তগুলো, আমার পরিবারের সাথে যে মুহূর্তগুলো- এসব তো স্পেশাল। একটা মানুষকে যদি আপনি প্রশ্ন করেন আপনার জীবনের সেরা মুহূর্ত কী, এই মুহূর্তগুলো কিন্তু সে বলবে। আর যদি বলা হয় ক্রিকেটের সেরা মুহূর্ত কী, তখন আপনি ক্রিকেট থেকে বলবেন। জীবনের সেরা মুহূর্ত কখনও ক্রিকেটের মধ্য থেকে আসবে না। আমার কাছে মনে হয় না। এটা যদি আসে তাহলে বলব তার কাছে জীবনটা মানে ক্রিকেটই ছিল, তার জীবনে আর কিছু ছিল না।
চোখ সব সময় মাঠের দিকেই থাকে তার। ছবি: সংগৃহীত
- ক্রিকেট ক্যারিয়ারে এমন কোনও কষ্ট বা ব্যথা আছে, যা ইনজুরির চাইতেও বেশি?
মাশরাফি: ক্রিকেটই জীবন না, একটু আগে এমন বলছিলেন। আপনি যদি মানজারুল ইসলাম রানার পরিবার বা ওর জীবন দেখেন ক্রিকেট জীবন হয় কীভাবে। আপনার সামনে অসংখ্য উদাহরণ আছে এমন। ক্রিকেট জীবন হতেই পারে না। ২৪ বছরের ছেলেটা মারা গেল। সে ৬-৭-৮ বছর ক্রিকেট খেলে গেছে। তার সামনে যদি অপশন থাকত যে জীবনের বাকি অংশ পঙ্গু হয়ে থাকবে কিন্তু ক্রিকেট খেলবে না, বেঁচে থাকবে, অবশ্যই ও এবং ওর পরিবার ওটাই মেনে নিত। তো এই জন্য আমি মনে করি ক্রিকেট জীবন না। ক্রিকেটীয় জীবনে মানজারুলের চলে যাওয়াটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় কষ্টের, বড় শোকের।
ভাল-মন্দ দুটোই দেখতে হয়েছে মাশরাফিকে। ছবি: সংগৃহীত
- ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে সময় ছিল কোনটা?
মাশরাফি: সবচেয়ে বড় বাজে সময়, একটা পার্ট গেল ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময়। আর ইনজুরির সময়গুলো সময় অবশ্যই। আর যদি দল, নিজের সবকিছু মিলিয়ে বলেন এখন যে সময়টা যাচ্ছে এটার কথা বলব। এই সময়টা খুবই কঠিন। কারণ, কোনও ফলই আমাদের পক্ষে না। ব্যক্তিগত, দলীয় যাই বলেন, কোনও কিছুই আমাদের পক্ষে না। তবে এই সময়টা অনেকটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো। এখান থেকে কীভাবে বের হয়ে আসা যায় এই যে এক্সাইটমেন্ট যাদের মধ্যে কাজ করে তারা কিন্তু অনেক আনন্দ পায়। এই সময়গুলো যারা ওভারকাম করে আসে তাদের মধ্যে একটা আলাদা আনন্দ কাজ করে। তো এটা যেমন কঠিন, এটার মধ্যে আনন্দও আছে। এটার মধ্য থেকে বের হয়ে আসতে পারলে আরও বেশি আনন্দ।
- সবচেয়ে ভাল সময়?
মাশরাফি: ভাল সময় অনেক আছে। বাংলাদেশ দলের সাম্প্রতিক ফর্ম যদি ধরেন। দুই-তিন বছরের পারফরম্যান্স, প্রথম টেস্ট ম্যাচ জেতা, ভারতকে হারানো, ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়া, নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমি ফাইনালে ওঠা বলতে পারেন। এমন আরও অনেক ভাল লাগার মতো সময় আছে।
- ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ১৭ বছর পার করার পর বলা যায় কি না, আপনি পুরোপুরি তৃপ্ত?
মাশরাফি: আমি আমার জীবন নিয়ে তৃপ্ত। আমার আসলে অভিযোগ নেই। কেন জানি একটা সময়ে বাস্তবতা মানা শুরু করেছি নিজের থেকে। খুব কঠিন, শুরুতে মানতে পারতাম না। এখনও কিছু কিছু বিষয়ে খুব জিদ লাগে। মানতে কষ্ট হয়। কিন্তু নিজে যখন স্থির থাকি, নিজেকে আলাদা করে একটু সময় দিই তখন মেনে নিই এটাই বাস্তবতা। প্রত্যেকটা মানুষ এমন ভাল-খারাপের মধ্যে দিয়েই চলে। আল্লাহ যা আমার কপালে রেখেছিলেন সেটাই হয়েছে। তাই আমার কোনও আফসোস নেই।
- যখন ক্রিকেট শুরু করলেন, আপনার তখনকার ক্রিকেট দর্শন আর এখনকার ক্রিকেট দর্শনের মধ্যে কোনও পার্থক্য খুঁজে পান?
মাশরাফি: না, কোনও পার্থক্য নেই। আগেও ক্রিকেট কম বুঝতে চাইতাম, এখনও কম বুঝি।
- আমাদের দেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে আপনাকে সবেচেয়ে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন কে?
মাশরাফি: অনেকেই আছেন। আমার যারা সিনিয়র ছিলেন সবার কথাই বলব। শুরু যখন করি আকরাম ভাই, মনি ভাই, মঞ্জু ভাই, শান্ত ভাইদের দেখেছি। দুর্জয় ভাই আমার প্রথম অধিনায়ক ছিলেন। সবার কথাই বলব। এটা ঠিক তখন আমরা জিততে পারতাম না, কিন্তু তারাই অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। যদি আলাদা করে বলি জাভেদ ভাইয়ের কথা বলব। জাভেদ ভাই আমাকে অনেক বোঝাতেন। উনি বোঝাতেন যে এভাবে বিশ্রামহীন থাকিস না, ছুটি পেলে বিশ্রাম নে। উনার কথা মনে পড়ে। আরেকজন হচ্ছে খালেদ মাসুদ পাইলট ভাই। পাইলট ভাইয়ের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। অন ফিল্ড উনি অনেক কাজ করতেন। সব সময় সিরিয়াস থাকতেন।
- আপনার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে জাহিদ রেজা বাবুর অবদানটা কীভাবে দেখেন?
মাশরাফি: উনাকে আমি ক্রিকেটীয় মানুষ হিসেবে দেখি না। ক্রিকেটে উনার অবদান এসব পুরনো কথা। এরচেয়ে বড় উনি আমার পরিবারের অংশ। আমার কাছে উনি ক্রিকেটের উর্ধ্বে। হয়তো ক্রিকেট দিয়েই উনার সাথে আমার পরিচয়, আমার জীবনের শুরুতে যে সব স্ট্রাগল ছিল, উনি দেখেছেন। কিন্তু সবকিছু ছেড়ে আমি মনেকরি উনি আমার পরিবারের অংশ।
- ক্রীড়া সাংবাদিকদের সহায়তা কেমন পেয়েছেন?
মাশরাফি: অনেক সাহায্য পেয়েছি। এটা বলতে হবে। যখন ইনজুরিতে থেকেছি আমাকে সাহায্য করেছেন। আগে এই বোলিং করেছি বা এই রেকর্ড, সাধারণত এসব দিয়ে সাংবাদিকদের সাথে পরিচয় হয়। আসলে সেটা না। আমাদের সময় যারা সাংবাদিক ছিলেন, মানে আমি যখন আসি তখন বাবু ভাই (আরিফুর রহমান বাবু) সাঈদ ভাই (সাইদুজ্জামান), উৎপল শুভ্র উনারা ছিলেন সিনিয়র। উনারা মাঠে আসতেন প্রতিদিন। এখন তো আইসিসির অনেক রুলস-রেগুলেশন আছে। আমার মনে পড়ে আমার যখন অভিষেক হয় তখন বাবু ভাই ড্রেসিং রুমে ছিলেন। ড্রেসিং রুমে বলতে, অনুশীলন ম্যাচ খেলছিলাম তখন বাবু ভাইরা ড্রেসিংরুমে বসে ছিলেন। সাংবাদিকের চেয়ে উনাদের সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছে বড় ভাই হিসেবে। বা ক্রিকেটের শুভাকাঙ্ক্ষী এমন হিসাবে। কেউ পরিচয় করিয়ে দিলে বলতেন, এরা কিন্তু আরও ১০ বছর আগে থেকে ক্রিকেট নিয়ে কাজ করেন। এরপর যারা ৮-১০ বছর ধরে সাংবাদিকতা করছে, আপনারা আছেন, পরিচয় আসলে চলছেই। কারও সাথেই আমার আলাদাভাবে বিশেষ সম্পর্ক নেই। সবার সাথে আমার ভাল সম্পর্ক। এবং যতদিন বেঁচে থাকি ইনশা আল্লাহ বজায় থাকবে।
- আপনার ক্যারিয়ারে অনেক উত্থান-পতন আছে। এরমাঝেও কি এমন কোনও সময় ছিল যেটা আপনার কাছে মনেহয় যে টার্নিং পয়েন্ট?
মাশরাফি: আমরা অনেক সময় হতাশগ্রস্ত হয়ে পড়ি। আমাদের কালচারটাই এমন। আমাদের চারপাশ এমনই। খুব দ্রুত হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি, ধৈর্য হারিয়ে ফেলি। আমার আশে পাশে যেসব মানুষ আছে, যাদের সাথে আমি মিশি। তাদের মধ্য থেকে অনেকে ভাল জায়গায় আছে আবার অনেকে খারাপ জায়গায় আছে। আল্লাহ প্রত্যেকটা মানুষকে একটা সুযোগ দেন। কেউ সেট ধরতে পারে, আবার কেউ ধরতে পারে না। যারা ওই সুযোগটা ধরতে পারে তারা উপরে উঠে যায়। আর যারা নিজেকে নিয়ে কনফিউসড থাকে, হতাশ থাকে তারা সেটা ধরতে পারে না। কঠিন সময় এলেও ঝুলে থাকতে হবে। দেখবেন একটা রাস্তা পেয়ে যাবেন আর যেটা ধরে আপনি এগিয়ে যাবেন।
- বিশ্ব ক্রিকেট থেকে শুরু করে আমাদের অনেক সাবেক ক্রিকেটার মনে করেন আপনি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হতে পারতেন। কখনও কি আফসোস কাজ করে এ নিয়ে? কিংবা আপনার কি ওই বিশ্বাসটা ছিল যে আপনার দ্বারা সম্ভব ছিল?
মাশরাফি: হ্যাঁ, সেই বিশ্বাসটা ছিল। তবে এই পথে ইনজুরি একটা বড় কারণ। একটা বিষয় ছিল যখন আমার ইনজুরি হয়, তখন হিসাব হতে পারতো আমি শুধু ব্যাটিংয়ে মন দিয়ে বোলিংটা কোনভাবে করে যাব। কিন্তু আমি বোলিং নিয়ে ছাড় দিইনি। ইনজুরির পর বোলিং নিয়ে আমাকে দ্বিগুণ খাটতে হয়েছে। একটা ক্রিকেটার যখন খেলবে না, ওটা ভুলে যাওয়ার মতো হবে। কারণ ক্রিকেটই এমন। আর আমি এক বছর- আট মাস ধরে বসে থেকেছি। আমাকে অনেক সময় দিয়ে বোলিংয়ের ওই রিদমে ফিরতে হয়েছে। আলাদা করে ব্যাটিংয়ের সুযোগও হয়নি। আর আমরা জন্ম থেকেই এক্সকিউজ দিয়ে আসি। এ কারণে এক্সকিউজও দিই না। তবে এর মধ্যে থেকেই আমি আরও ভাল করতে পারতাম। এই ভুলটা আমারই। এটা স্বীকার করতে হবে।
- জীবনে বন্ধু ব্যাপারটা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ?
মাশরাফি: বন্ধু অনেক কিছু ম্যাটার করে। কঠিন সময়ে বন্ধু খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে কঠিন সময়ের কথা বলছি এই কারণে আমি আমার লাইফ থেকে যা দেখেছি সেটা বলছি। তবে অবশ্যই সেটা ভাল বন্ধু। এটা আপনাকে বুঝতে হবে কার সাথে মিশছেন বা চলছেন। অনেকে চিন্তা করে আমার স্ট্যান্ডার্ডেই আমার বন্ধু হওয়া উচিত। এটা আসলে ভুল। অনেক নিচের সারির কেউও আপনার বন্ধু হতে পারে আবার অনেক উঁচু সারির কেউ আপনার বন্ধু হতে পারে। এটা নির্ভর করে তার মানসিকতা ও চলাফেরার ওপর। তবে বন্ধু খুব গুরুত্বপূর্ণ।
- আপনি তো প্রচণ্ড আড্ডাবাজ! এটাকে কীভাবে দেখেন বা মেইন্টেইন করেন কীভাবে?
মাশরাফি: বলতে পারেন। এটা আমার কাছে ফুয়েলের মতো। মানুষ বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছু করে, তেমনি আড্ডাটা আমার কাছে ইঞ্জিনের তেলের মতো। যত মানুষের সাথে মিশি, গল্প করি আমি তত চাঙ্গা হই। আড্ডা আমার ভাল লাগে। আমি উপভোগ করি। যদিও এখন গল্প করার ব্যাপারটা কমে গেছে। এখন চেনাজানা মানুষও ছবি, সেলফি নিয়ে থাকে। কথা বলা আর নেই। তবে পাঁচ ছয় বছর আগেও একটা মানুষের সাথে কত কথা বলতাম, বসে আড্ডা দিতাম। এখন ওই মানুষগুলোই কেমন যেন হয়ে গেছে। সবকিছু যেন মোবাইলের মধ্যে আটকে গেছে। এই জিনিসটা খুব বিরক্ত লাগে। তবে আমি বসে আড্ডা বা গল্প করা পছন্দ করি।
- বন্ধুদের কাছে মাশরাফি মানুষ হিসেবে কেমন?
মাশরাফি: এটা নির্ভর করে বন্ধুরা কীভাবে দেখে তার ওপর। আমি যেমন তেমনই। এক্সট্রা অর্ডিনারি কিছু করা আমার দিয়ে হয় না। আমি করিও না। আমি কেমন এটা ওরাই ভাল বলতে পারবে। তবে আমার চলাফেরা স্বাভাবিক।
- ক্রিকেটীয় জীবনে বন্ধুদের কাছ থেকে কেমন সহায়তা পেয়েছেন?
মাশরাফি: প্রতিটা ইনজুরিতে বন্ধুদের সহায়তা অনেক। ইনজুরি হলে ক্রিকেট নিয়ে না ভাবা, ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছে ওগুলো দেখতে না দেওয়া এসব করে ওরা। দেখলে কষ্ট পেতে পারি। অন্য কোনও কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে ওরা।
- একেবারে নিচের পর্যায় থেকে উপর পর্যন্ত আপনার অনেক বন্ধু। এটা কীভাবে মেইন্টেইন করেন? তারকা খ্যাতি কাজ করে কি না?
মাশরাফি: উপরের সারির বন্ধু নাই বললেই চলে। উপরে সারিতে মেশাই হয় না। নড়াইলে গেলে আমার বন্ধু সার্কেল যারা আহামরি খুব উপরের অবস্থায় নেই। এখানে যারা আছে তারাও উপরের অবস্থায় নেই। সেটা অনেকেই জানে। কেন জানি এদের মধ্যেই আটকে গেছি। বন্ধুত্ব তৈরি হওয়ার যা এখানেই হয়।
- পরিবারকে কতটা সময় দিতে পেরেছেন বলে মনেহয়?
মাশরাফি: খেলা ছাড়া বাকি সময়ের পুরোটাই দিই। বাচ্চা হওয়ার পর যতটা পারি বাসায় থাকার চেষ্টা করি। আর এখন তো সময় আরও বেশি পাই। কারণ এখন শুধু ওয়ানডে খেলি, সব ফরম্যাট তো খেলি না। এখন আরও বেশি সময় দিতে পারি।
- এমন কোনও ব্যাপার আছে যা পরিবারের জন্য করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু এখনও করতে পারেননি?
মাশরাফি: তাহলে তো আফসোস থেকে যাবে। না, এমন কিছু নেই। আগেও বলেছি যতটুকু পেরেছি ততটুকু ক্ষমতাই আল্লাহ আমাকে দিয়েছিলেন। যতটুকু পারব ততটুকু ক্ষমতা ভবিষ্যতের জন্য দিয়ে রেখেছেন। আর যেটুকু পারিনি ওটা আমার কপালে ছিল না। ওটা করার ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দেন নাই। আর এটাই সত্যি, একজন সবার মন রক্ষা করতে পারে না। কিন্তু আমার যতটুকু সম্ভব আমি সাধ্যমত চেষ্টা করেছি।
সন্তানদের সঙ্গে মাশরাফি। ছবি: সংগৃহীত
- সন্তানদের নিয়ে কী ভাবনা বা ওদের জন্য কিছু করে যাওয়ার কোনও ইচ্ছা?
মাশরাফি: ভাবনা বলতে মানুষের মতো মানুষ হোক। দুর্জন বিদ্যান হলেও পরিত্যাজ্য- এটা আমি বিশ্বাস করি। ওদের জন্য আহামরি কিছু করে যাওয়ার আমার কোনও ইচ্ছা নেই। ওদের যদি মানুষ করে দিতে পারি তাহলে সবকিছুই করে দিয়ে গেলাম। বাকিটা ওরা ওদেরটা করে নেবে। ওরা আহামরি কিছু হোক সেটাও চাই না। আমরা তো চাইলেই ওয়াস্টার্ন লাইফ লিড করতে পারব না, আমাদের যে সামাজিকতা সেটার মধ্যে থেকে ভাল মানুষ হয়ে চলুক এটাই আমার চাওয়া।
- আপনি কারও কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নেননি। কিন্তু আপনি অনেকের কাছে অনুপ্রেরণার নাম। একজন মাশরাফি মানে তাদের কাছে পথ প্রদর্শক। এটা দেখতে পারাটা কতটা তৃপ্তির?
মাশরাফি: এটা অবশ্যই অনেক বড় পাওয়া। কিন্তু আমি এরকম কিছু হতে চাইনি। তবে আমাকে কেউ যদি ফলো করে এটা অনেক বড় পাওয়া। এটার দায়িত্বও অনেক। এটা এমন একটা পর্যায়ে এসে গেছে যে আমি বুঝতে পারছি এটা অন্যায় হতে পারে আবার নাও হতে পারে, এমন কনফিউশন থাকলে সেই কাজটা আমি এখন করতে পারি না। যাদের কাছে আমি অনুপ্রেরণা, তাদের কারণেই আমি করতে পারি না। অন্যায় কিছু আমি কখনোই করার চেষ্টাও করি না, কিন্তু যেটাতে সন্দেহ আছে সেই কাজটাও এখন আর করতে পারি না। সেখান থেকে আমি ফিরে আসি। এটা আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার। এবং এটাতে আমার অনেক ভাল হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলিঙ্গনে আটকা পড়েন মাশরাফি। ছবি: সংগৃহীত
- কেউ কেউ আপনাকে এ যুগের মুক্তিযোদ্ধাও বলেন। এটাকে বাড়াবাড়ি বলে মনেহয় কি না?
মাশরাফি: এটা নিয়ে আমি এরআগেও কথা বলেছি। এটা অতিরিক্ত মাত্রায় বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছুই না। কারণ তুলনাটা কেমন হওয়া উচিত সেই বুদ্ধি আমাদের থাকা দরকার।
- জীবনে তো অনেক কোচের সাথে কাজ করেছেন। ক্যারিয়ারের এতগুলো বছর পার করে আসার পর কোন কোচের কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে?
মাশরাফি: আমার সব সময় আইডল ছিলেন যারা আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরুর কোচ ছিলেন। আমার ক্যারিয়ারের শুরুর যে কোচ তাদের কথাই আমি স্মরণ করব। মাগুড়ায় যখন একটা ক্যাম্প করি, তখন আমার বয়স ১৬। বিকেএসপির একটা হান্ট ছিল, যেটা এক মাসের ক্যাম্প। বাপ্পি স্যার ছিলেন, এখন হয়তো মিয়ানমারের কোচ। বিসিবিতে গেম ডেভেলপম্যান্টে অনেক দিন চাকরিও করেছেন। আশফাকুল বাপ্পি নাম ছিল উনার। উনার কাছেই আমার ক্রিকেটের হাতেখড়ি বলতে পারেন। তারও আগে যদি বলেন নড়াইলে আলী নূর ভাই ছিলেন, চুন্নু ভাই ছিলেন। আমরা যারা ক্রিকেট খেলতাম তাদের পেছনে অনেক সময় দিয়েছেন এ দুজন। তাদের অনেক অবদান। ছোট বেলায় এই সেই কত কি করতাম। কিন্তু উনারা আমাদের মেরেধরে খারাপ কাজ থেকে বিরত রেখে মাঠে নিয়ে আসতে বাধ্য করতেন। উনাদের অনেক অবদান। এরপর উনারা ব্যক্তিগত জীবনে ব্যস্ত হয়ে গেলেন, আমরাও বড় হতে লাগলাম। কিন্তু প্রপার ক্রিকেটে যখন এলাম তখন আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন বাপ্পি স্যার। উনার অবদান অনেক। আলী নূর ভাই ব্যবস্যা করেন নড়াইলে। ওখানেই উনার বাড়ি। আর চুন্নু ভাই নড়াইল থেকে চলে গেছেন। অনেকদিন দেখা সাক্ষাত হয় না। অনেক মিস করি উনাকে। আরেকজন আছেন মোহাম্মদ ভাই। মাঠে যে ক্রিকেট বলে খেলতে হবে সেটার সাথে উনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এটা উনিই শিখিয়েছেন আমাকে। উনি ছিলেন অনেকটা কো-অর্ডিনেটর। ক্লাবে খেলোয়াড় নিয়ে এসে দিতেন। বলতেন, তোদের খেলতে হবে। ব্যাট-বল আমি দিচ্ছি, তোদের খেলতে হবে। উনার অনেক অবদান আমার ক্যারিয়ারে।
- অনেকেই বলেন জেমি সিডন্সের সাথে আপনার সম্পর্ক ভাল ছিল না। আপনাকে পছন্দ করতেন না তিনি। এটা একজন ক্রিকেটারের জন্য কতটা ক্ষতিকর?
মাশরাফি: এটা একটা ভুল ধারণা। আপনারা যে ভিডিও দেখেছেন সেটা ছিল ২০১১ বিশ্বকাপের। ও আমাকে ব্যাখ্যা করতে চাচ্ছিল কেন তুমি দলে নেই। কিন্তু আমি ব্যাখ্যাটা শুনতে চাচ্ছিলাম না। আমাকে নিয়ে কেন মাথা ব্যথা, আমি তো দলেই নেই। এটা ভুলে যাওয়াই ভাল। আমি এটা ওকে বোঝাতে চাচ্ছিলাম। ওই ভিডিওতে এমনই ব্যাপার ছিল। ও আপসেট হয়ে গিয়েছিল। আমিও আপসেট ছিলাম। আমরা তখন ওই কালচারে যাইনি যে কোচের সাথে দ্বদ্বে জড়িয়ে যাব। বাংলাদেশ এখনও ওই কালচারে আসেনি। অতি মাত্রায় অনেকেই অনেক কিছু বলতে পারে। আসলে সেটা ঠিক না। ওই ভিডিওতে আমি বলছিলাম, আমাকে নিয়ে কেন এত চিন্তা করছ। যেসব বিতর্কের জন্ম নিয়েছে সেই রকম কিছুই ওর আর আমার মধ্যে ছিল না। ও আমাকে বোলার হিসেবে সব সময় হাইলাইট করত ড্রেসিংরুমে। এটা অনেক বড় সত্যি কথা। ওর সময় আমি অনেক ভাল ভাল পারফরম্যান্স করেছি। বোলার হিসেবে ও আমাকে কখনও ছোট করত না। আমার ইনজুরি নিয়ে ও অনেক আপসেট থাকত। আমার ইনজুরি হলে ও রেগে যেত। ওর সাথে তর্কে জড়ানোর সাহস আমার ছিল না। বাংলাদেশের ক্রিকেটের আজকের এই পর্যায়ে আসার পেছনে ওর অবদান অনেক বেশি। অনেক বেশি বলতে ওর অবদানই সবচেয়ে বেশি।
- কোন ব্যাটসম্যানকে সবচেয়ে কঠিন মনে হতো। কাকে বল করতে এখনও ভয় হয়?
মাশরাফি: সব সময় হাশিম আমলা। অনেকেই আছেন। অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, ম্যাথু হেইডেন ছিল। গৌতম গম্ভীরকে কেন জানি বল করতে খুব ডিস্টার্ব ফিল করতাম। অন্যরা কীভাবে দেখত জানি না, আমার জন্য ডিস্টার্বিং ছিল। সনাৎ জয়সুরিয়া ছিল। আর অত ড্যামেজ না হলেও টেকনিক্যালি ড্যামেজ মনে হতো কুমার সাঙ্গাকারার সামনে গেলে। শুরুর সময়ে আমাকে ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে হিংস্র ওপেনারদের মোকাবেলা করতে হয়েছে। ভারতের বীরেন্দর শেবাগ-গৌতম গম্ভীর, শ্রীলঙ্কার মারভান আতাপাত্তু-সনাৎ জয়সুরিয়া, অস্ট্রেলিয়ার ম্যাথু হেইডেন-অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, দক্ষিণ আফ্রিকার হার্শেল গিবস-গ্রায়েম স্মিথ, নিউজিল্যান্ডের নাথান অ্যাস্টেল-লুই ভিনসেন্ট এদেরকে মোকাবেলা করতে হয়েছে আমাকে। এরপর যারা টেকটিক্যাল ছিল তাদের সামনে বেশি কষ্ট হয়েছে। ক্রিকেট কিন্তু পুরোটাই মনস্তাত্ত্বিক। যখন দেখবে বাংলাদেশের কেউ তখন ওরা বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতো। দল একটা ব্যাপার এখানে। আর মানসিকভাবে এগিয়ে গেলে ভাল বলও খেলা সম্ভব। তখন এই ব্যাপারটা আরও বেশি ছিল। ওরা আরও বেশি ডমিনেট করতো। এদিক সেদিক হলেই বাউন্ডারি মারত। ভাল বলেও মারত। তখন আবার পাওয়ার প্লেও ছিল ১৫ ওভার। সব মিলিয়ে যাদের নাম বললাম ওরা ভয়ঙ্কর ছিল।
- বোলারের কাছে প্রতিটা উইকেটই দামি। কিন্তু কাকে আউট করতে পারলে বেশি ভাল লাগা কাজ করত?
মাশরাফি: ব্রায়ান লারার উইকেট পেয়েছি একবার। গিলক্রিস্টের উইকেট অনেকবার পেয়েছি। গেইলের উইকেটও পেয়েছি। বেশিরভাগ সময় শেবাগের উইকেট আমিই নিতাম। ফেবারিট বলতে পারেন শেবাগ। কারণ বিশ্ব ক্রিকেটে এমন কোনও বোলার ছিল না ওকে ভয় পেত না। তাই ওকে আউট করাটা একটা শান্তির বিষয় ছিল। শেবাগ এমন একজন ব্যাটসম্যান, পেস বল থেকেই শট খেলা শুরু করত। গিলক্রিস্টও তাই। আর গিলক্রিস্টের উইকেটও অনেকবার নিয়েছি। কিন্তু শেবাগকে আউট করতে পারলে বেশি ভাল লাগত।
- ব্যাটসম্যান হিসেবে কোন বোলারকে সবচেয়ে কঠিন মনে হত?
মাশরাফি: অনেক বোলার। এক এক করে বলা কঠিন। তবে অনেক বোলার ছিল।
- ২০১৯ বিশ্বকাপ নিয়ে কী ভাবনা?
মাশরাফি: এখনই বলা খুব কঠিন। আমি জীবনে কোনও কিছু টার্গেট করিনি, এখনও করি না। টার্গেট করার সুযোগও নেই আমার। খেলছি, উপভোগ করছি। উপভোগ না করলে ছেড়ে দেব। পারফর্ম করতে থাকলে খেলতে থাকব। এর ভেতরে কোনও কিছু হলে সেটা আলাদা বিষয়। তবে নির্দিষ্ট কোনও টার্গেট নেই। তবে একটা পরিস্কার ধারণা থাকার দরকার। যেন ওই সময়ে সরে যেতে কষ্ট না হয়, সম্মান নিয়ে সরে যাওয়া যায়। কিন্তু আমি আবার একটু অন্যভাবে ভাবি। টি-টোয়েন্টি থেকে কোনও কিছু না ভেবেই সরে দাঁড়িয়েছি। মনে হলে ছেড়ে দেব। এর জন্য আলাদা করে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে সময় নষ্ট করার কোনও মানে নেই। কারণ আপনি যখন টার্গেট সেট করবেন তখন টার্গেটের আশাতেই থাকবেন। যে কারণে আমি এসব করি না। কখনও করি নাই। খেলাধুলা নিয়ে টার্গেট করার কোনও কারণ দেখি না।
- ঠিক পথেই আছে কি না বাংলাদেশের ক্রিকেট? ১০ বছর পর বাংলাদেশকে কোথায় দেখতে চান?
মাশরাফি: অবশ্যই ঠিক পথে আছে। তবে এই সফরটা (দক্ষিণ আফ্রিকা) নিয়ে সবাই বিচলিত। আমরা বিচলিত নই, তা নয়। তবে আমার ক্রিকেটীয় অভিজ্ঞতা যা বলে এটা একটা শিক্ষা। এটা একটা বড় শিক্ষা। যদি মানুষ মনে করে এটাই শেষ তাহলে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট তো এখানে থেমে থাকবে না। আবার চিন্তা করেন যারা খেলছে এই সেট সরিয়ে বা এখন থেকে চার-পাঁচজন সরিয়ে নতুন পাঁচজন আনলে কি আপনি ম্যাচ জিততে পারবেন? যদি পারত বাংলাদেশের ক্রিকেট অনেক আগেই দাঁড়িয়ে যেত। কিছু খেলোয়াড় থিতু হয়েছে বলেই বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এটা এমন না যে রাতারাতি পরিবর্তন হবে। এখানেই খুঁজতে হবে ভুল কী হয়েছে এবং সেই জায়গাগুলো নিয়ে কাজ করে আপনার এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। এটা খেলোয়াড়দেরই দায়িত্ব। এটা মানতে হবে। আর এখন যে আলোচনা বা সমালোচনা হচ্ছে সেটা খেলোয়াড়দের মেনে নিতে হবে। জীবনটাই এমন। বলেছিলাম এই সফরটা হুমকিস্বরুপ। তবে এটাই শেষ নয়। সামনের বছর চারটা সফর আছে। সবচেয়ে বড় যেটা বিশ্বকাপ (২০১৯) আছে। এই সফরটা এসবের জন্য অ্যালার্মিং। যে কারণে এই সিরিজ নিয়ে আমি আপসেট। তবে এই দল ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না, আমি সেটা মনে করি না। সময় দিতে হবে। এরাই ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে পথ দেখাবে। অনেকে আছে যাদের ক্যারিয়ার ৮-১০ বছর হয়ে গেছে, নতুনদেরও তিন-চার বছর হয়ে গেছে। একটা সময়ে গিয়ে ফল মিলবে। এই দলটা পাঁচ-সাত বছর পর আরও অনেক উপরে উঠবে।
মাঠে ঢুকে এভাবেই মাশরাফিকে জড়িয়ে ধরেন এই ভক্ত। ছবি: প্রিয়.কম
- ভক্তদের অনেক ভালবাসা পেয়েছেন। তাদেরকে প্রতিদান দেওয়া বা তাদের উদ্দেশে কিছু বলার আছে?
মাশরাফি: মানুষের ভালবাসা পাওয়াটা সত্যিই অনেক বড় ভাগ্যের ব্যাপার। আমি যেটা পেয়েছি সেটা আমার অর্জনগুলোর মধ্যে অন্যতম। তবে ভালবাসার প্রতিদান দেওয়া যায় বলে আমি মনে করি না। প্রতিদান দিতেও চাই না। ভালবাসার প্রতিদান কোনকিছুতেই দেওয়া সম্ভব না। বলব এভাবেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাথে থাকুন সব সময়। কারণ বাংলাদেশের এই পর্যায়ে আসার পথে আপনাদের অবদান অনেক।