ছবি সংগৃহীত

জাতীয় পতাকা ব্যবহারের আগে জেনে নিন নিয়ম-কানুন

আফসানা সুমী
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ০৩:৩৭
আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ০৩:৩৭

প্রাণের পতাকা আমাদের, অসম্মান না হোক কোনদিন। ছবি: প্রিয়.কম
 
(প্রিয়.কম): আপনি কি আপনার দেশকে ভালোবাসেন? এই প্রশ্নের উত্তরে একবাক্যে 'হ্যাঁ' বলবেন সকলেই। কিন্তু আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশের জন্য কতটা আত্মত্যাগ আপনি করতে পারেন, তখন? আপনি নিশ্চয়ই বলবেন, এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে একমাত্র সময়। সত্যিই তাই। তবে এই বর্তমান সময়েও অনেক ভুল জানা বা না জানার কারণে দেশকে অসম্মানের ঘটনা ঘটাই আমরা নিজেরাই। কঠিন আত্মত্যাগ, দেশের জন্য নিজেকে বিলীন করে দেওয়া না হয় না-ই হল। অন্তত প্রাপ্য সম্মানটা কিন্তু দিতেই পারি আমরা সবাই। এজন্য কিছুই নয়, প্রয়োজন কিছু তথ্য জানার। জানব জাতীয় পতাকা ব্যবহারের যত নিয়মকানুন, সাথে জানা-অজানা আরও কিছু তথ্য!
 
বিজয় দিবসে পতাকা টাঙানো হয় পাড়ায় মহল্লায়, অলিতে-গলিতে। অনেকে গাড়ির সামনে পতাকা ওড়ান। ভালবাসা থেকেই কাজটি করি আমরা। কিন্তু পতাকা ওড়ানোর কিছু নিয়ম আছে। যেমন:
 
১। এমন কোন স্থানে পতাকা টানানো যাবে না যেখানে পতাকার সম্মানহানি হতে পারে।
২। পতাকা দিয়ে মোটরযান, রেলগাড়ি অথবা নৌযানের খোল, সম্মুখভাগ অথবা পেছনের অংশ কোন অবস্থাতেই ঢেকে দেওয়া যাবে না।
৩। যেক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের পতাকা অথবা রঙিন পতাকার সাথে ‘বাংলাদেশের পতাকা’ উত্তোলন করা হয়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পতাকাকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য স্থান সংরক্ষিত থাকবে।
৪। যেক্ষেত্রে কেবলমাত্র দুইটি পতাকা অথবা রঙিন পতাকা উত্তোলন করা হয়, সেক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশের পতাকা’ ভবনের ডানদিকে উত্তোলন করা হবে।
৫। যেক্ষেত্রে পতাকার সংখ্যা দুইয়ের অধিক হয়, সেক্ষেত্রে অযুগ্ম সংখ্যক পতাকার ক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশের পতাকা’ মধ্যখানে এবং যুগ্ম সংখ্যক পতাকার ক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশের পতাকা’ মধ্যভাগের ডানদিকে উত্তোলন করা হবে।
৬। যেক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশের পতাকা’ অন্য পতাকার সাথে আড়াআড়িভাবে কোন দণ্ডে দেয়ালের বিপরীতে উত্তোলন করা হয়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পতাকা অন্য পতাকার ডানদিকে আড়াআড়িভাবে থাকবে (আড়াআড়িভাবে যুক্ত পতাকা দুইটির দিকে মুখ করে দণ্ডায়মান ব্যক্তির বামদিকে) এবং পতাকা দণ্ডটি অন্য পতাকা দণ্ড থেকে কিছুটা সামনে স্থাপিত হবে।
৭। ‘বাংলাদেশের পতাকা’র উপরে অন্য কোন পতাকা বা রঙিন পতাকা উত্তোলন করা যাবে না।
৮। ‘বাংলাদেশের পতাকা’ শোভাযাত্রার মধ্যভাগে বহন করা যাবে অথবা সৈন্য দলের অগ্রগমন পথে (Line of March) শোভাযাত্রার ডানদিকে বহন করতে হবে।
৯। মর্যাদার প্রতীক সম্বলিত ঢালে (escutcheons) অযুগ্ম সংখ্যক পতাকার ক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশের পতাকা’ মধ্যভাগে এবং সর্বোচ্চ কেন্দ্রে থাকবে এবং যুগ্ম সংখ্যক পতাকার ক্ষেত্রে ঢালের ডানদিকে শীর্ষে (ঢালের দিকে মুখ করে দণ্ডায়মান ব্যক্তির বামদিকে) বাংলাদেশের পতাকা স্থাপন করা হবে।
১০। যেক্ষেত্রে অন্য কোন দেশের সহিত ‘বাংলাদেশের পতাকা’ একত্রে উত্তোলন করা হয়, সেক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশের পতাকা’ প্রথমে উত্তোলন করতে হবে এবং নামানোর সময় সবশেষে নামাতে হবে।
১১। যেক্ষেত্রে দুই বা ততোধিক দেশের পতাকা প্রদর্শিত হয়, সেক্ষেত্রে প্রতিটি পতাকা পৃথক পৃথক দণ্ডে উত্তোলন করা হবে এবং পতাকাসমূহ প্রায় সমান আয়তনের হবে।
১২। যেক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশের পতাকা’ অর্ধনমিত থাকে, সেক্ষেত্রে প্রথমে সর্বোচ্চ চূড়া পর্যন্ত উত্তোলন করা হবে এবং অতঃপর নামিয়ে অর্ধনমিত অবস্থায় আনা হবে। ঐ দিবসে পতাকা নামানোর সময় পুনরায় উপরিভাগ পর্যন্ত উত্তোলন করা হবে, অতঃপর নামাতে হবে।
১৩। যেক্ষেত্রে দণ্ডের উপর ব্যতীত অন্যভাবে কোন দেয়ালের উপর ‘পতাকা’ প্রদর্শিত হয়, সেক্ষেত্রে তা দেয়ালের সমতলে প্রদর্শিত হবে। কোন পাবলিক অডিটোরিয়াম বা সভায় ‘পতাকা’ প্রদর্শন করতে হলে তা বক্তার পশ্চাতে উপরের দিকে প্রদর্শিত হবে। যেক্ষেত্রে রাস্তার মধ্যখানে পতাকা প্রদর্শিত হয়, সেক্ষেত্রে তা খাড়াভাবে প্রদর্শিত হবে।
১৪। কবরস্থানে ‘জাতীয় পতাকা’ নিচু করা যাবে না বা ভূমি স্পর্শ করানো যাবে না।
১৫। ‘পতাকা’ কোন ব্যক্তি বা জড় বস্তুর দিকে নিম্নমুখী করা যাবে না।
১৬। ‘পতাকা’ কখনই তাঁর নিচের কোন বস্তু যেমন: মেঝে, পানি বা পণ্যদ্রব্য স্পর্শ করবে না।
১৭। ‘পতাকা’ কখনোই আনুভূমিকভাবে বা সমতলে বহন করা যাবে না, সর্বদাই ঊর্ধ্বে এবং মুক্তভাবে থাকিবে।
১৮। ‘বাংলাদেশের পতাকা’ কোন কিছুর আচ্ছাদন হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না, তবে শর্ত থাকে যে, কোন বিশিষ্ট ব্যক্তি যাঁকে পূর্ণ সামরিক মর্যাদা বা পূর্ণ আনুষ্ঠানিকতাসহ সমাধিস্থ করা হয়, তাঁর শবযানে পতাকা আচ্ছাদনের অনুমোদন প্রদান করা যেতে পারে।
১৯। ‘পতাকা’ এমনভাবে উত্তোলন, প্রদর্শন, ব্যবহার বা সংরক্ষণ করা যাবে না, যাতে  সহজেই ছেঁড়া যেতে পারে বা যে কোনভাবে ময়লা বা নষ্ট হতে পারে।
২০। কোন কিছু গ্রহণ, ধারণ, বহন বা বিলি করার জন্য ‘পতাকা’ ব্যবহার করা যাবে না।
২১। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আরোপিত কোন শর্তাবলী (যদি থাকে) এবং লিখিত অনুমোদন ব্যতীত, কোন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য, সম্বোধন, পেশা বা অন্য যে কোন উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের ‘পতাকা’ কোন ট্রেড মার্ক, ডিজাইন, শিরোনাম অথবা কোন প্যাটেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
২২। যেক্ষেত্রে ‘পতাকা’র অবস্থা এমন হয় যে, তা আর ব্যবহার করা যাবে না, নষ্ট হয়ে গেছে, সেক্ষেত্রে তা মর্যাদপূর্ণভাবে, বিশেষ করে সমাধিস্থ করে নিষ্পত্তি করতে হবে।
২৩। ‘পতাকা’ দ্রুত উত্তোলন করতে হবে এবং সসম্মানে নামাতে হবে।
২৪। ‘পতাকা’ উত্তোলন ও নামানোর সময় এবং প্যারেড পরিক্রমণ ও পরিদর্শনের সময় উপস্থিত সকলে ‘পতাকা’র দিকে মুখ করে সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে।
২৫। যেক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পতাকা’ উত্তোলন করা হয়, সেক্ষেত্রে একই সাথে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে হবে। যখন জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয় এবং ‘জাতীয় পতাকা’ প্রদর্শিত হয়, তখন উপস্থিত সকলে ‘পতাকা’র দিকে মুখ করে দাঁড়াবেন। ইউনিফর্ম-ধারীরা স্যালুট-রত থাকবেন। ‘পতাকা’ প্রদর্শন না করা হলে, উপস্থিত সকলে বাদ্য যন্ত্রের দিকে মুখ করে দাঁড়াবেন, ইউনিফর্ম-ধারীরা জাতীয় সঙ্গীতের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত স্যালুট-রত থাকবেন।
২৬। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি ব্যতীত, ‘জাতীয় পতাকা’ অর্ধনমিত করা যাবে না, তবে শর্ত থাকে যে, বিদেশস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান (যে দেশের নিকট তিনি আস্থাভাজন) ইচ্ছা করলে ঐ সকল দিবসে ‘পতাকা’ অর্ধনমিত রাখতে পারবেন, যে সকল দিবসে উক্ত দেশে, সরকারীভাবে ‘পতাকা’ অর্ধনমিত রাখা হয়।
 
 
বিজয়ের মাসে পতাকা টাঙানোর আগে খেয়াল করুন:
 
১। পতাকার আদর্শ মাপ ১০:৬। সঠিক মাপ ও সঠিক রঙ এর পতাকা তৈরি করে সোজা দন্ডের চূড়ায় উড়াতে হবে।
২। মোটর গাড়ী, নৌযান এবং উড়োজাহাজ ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত ‘পতাকা’ উত্তোলিত থাকবে। সুর্যাস্তের পূর্বে পতাকা নামাতে হবে।
৩। যেক্ষেত্রে মোটর গাড়ীতে ‘পতাকা’ প্রদর্শন করা হয়, সেইক্ষেত্রে গাড়ীর চেসিস অথবা রেডিয়েটর ক্যাপের ক্ল্যাম্পের সাথে পতাকা দন্ড দৃঢ়ভাবে আটকাতে হবে।
৪। পতাকায় কোন কিছু লিখে বা অঙ্কন করে উড়ানো যাবে না।
৫। ভবনে ব্যবহারের জন্য পতাকার বিভিন্ন মাপ হলো—১০ ফুট/৬ ফুট, ৫ ফুট/৩ ফুট, ২.৫ ফুট /১.৫ ফুট। মোটরগাড়িতে ব্যবহারের জন্য পতাকার বিভিন্ন মাপ হলো—১৫ ইঞ্চি/৯ ইঞ্চি, ১০ ইঞ্চি/৬ ইঞ্চি।
 
অবমাননার শাস্তি:
২০১০ সালের জুলাই মাসে এই আইন সংশোধিত হয়। এই সংশোধনীতে সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত শাস্তি এবং ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ডে বিধান রাখা হয়।
 
আমরা খুব আবেগপ্রবণ জাতি। আর এজন্যেই স্বাধীন দেশের পতাকা পেতে জীবন বিসর্জন দিতে বাঁধে নি আমাদের। সেই আবেগের ইতিবাচক প্রয়োগ হোক বিজয় দিবস সহ অন্যান্য দিবসে। প্রয়োগ হোক পতাকার ব্যবহারে, জাতীয় সঙ্গীত চর্চায়। যেখানেই আমরা যাই না কেন দেশ থাকুক সবার উপরে, জ্বলজ্বল করুক তার উজ্জ্বলতা।
 
সম্পাদনা/রুমানা বৈশাখী